শিরশ্ছেদের ঘটনা-সতর্ক হতে হবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের

সৌদি আরবে এক মিসরীয়কে হত্যার দায়ে সেখানকার আদালত কর্তৃক আটজন বাংলাদেশি তরুণ শ্রমিকের শিরশ্ছেদ করার আদেশ কার্যকর করা নিয়ে সারা দেশে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে অপরাধীর শাস্তি হোক, এটা যেমন এ দেশের মানুষ চায়, তেমনি অন্যদিকে বিচারিক প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আইনের চেয়ে অধিক কঠোর হওয়াও এ দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো দেশে অপরাধীর শাস্তি সে দেশের প্রচলিত আইনে


কার্যকর হবে_এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, একজন মিসরীয়কে হত্যার দায়ে যে আটজনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তার বিচার কি যথাযথ হয়েছে? সৌদি আরবের মতো কঠোর আইনের দেশে বিচারের শুনানিতে অভিযুক্ত ব্যক্তি কতটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান, তা নিয়ে বহু আগে থেকেই বিতর্ক রয়েছে। এই আটজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর খোদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, সৌদি আরবের বিচারব্যবস্থা মানসম্মত নয়। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিরশ্ছেদ করার মতো ঘটনা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো মানদণ্ডেই এটা সম্ভব নয়।
পৃথিবীর সব দেশে আইন সমান নয়। বর্তমান বিশ্বে বহু সভ্য দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে। ফ্রান্সে একসময় গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হতো। সেই ব্যবস্থা উঠে গেছে। এরপর বহু সভ্য দেশেই কিন্তু অপরাধের বিচার হচ্ছে এবং যথাযথভাবেই হচ্ছে। বরং সভ্য দেশগুলোতে বিচারে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় না, যা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেই হয়ে থাকে। মানুষ যখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, তখন সৌদি আরবের মতো দেশগুলো চলছে মধ্যযুগীয় ধারণা নিয়ে। নিশ্চয়ই একটি দেশে হত্যার অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকতে পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে তলোয়ার দিয়ে শিরশ্ছেদ কতটা গ্রহণযোগ্য, তা ভেবে দেখার বিষয়। আরো অনেক মহল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের যে বিচারিক প্রক্রিয়া, তার কতটা পেয়েছে বাংলাদেশের এই আট তরুণ শ্রমিক। অনেকের মনেই সংশয় রয়েছে, আটজনই কি সমান অপরাধে অপরাধী ছিল? একটি বিষয় সবার জানা আছে_বিদেশিদের, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে সৌদি সরকার এবং প্রসিকিউশন বরাবরই অধিক কঠোর। এ বিষয়ে সৌদি আরবে মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেই বিশ্বব্যাপী ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। আরো অভিযোগ আছে, সে দেশে বিচারিক কাজ পুরোটাই হয়ে থাকে আরবি ভাষায়। সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি, বিশেষ করে প্রবাসীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বুঝতে পারেন না এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে ভাষাগত সমস্যার সম্মুখীন হন। যাহোক, সৌদি সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, যেকোনো বিচারিক প্রক্রিয়া বা শুনানির ক্ষেত্রে যেন বাংলাদেশিসহ প্রবাসী নাগরিকরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকটায় তাঁরা নজর রাখবেন। পাশাপাশি, আমরা সব প্রবাসী বাংলাদেশিকে অধিক সতর্ক হতে অনুরোধ জানাই। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়, সে ব্যাপারে তাঁদের সবারই অধিকতর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আরব বিশ্বে সৌদি সরকারেরও ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে অধিকতর যত্নবান হওয়া উচিত। সৌদি আরবের আইনকানুনের সঙ্গে বিশ্বের অপরাপর দেশের, বিশেষ করে সভ্য দেশগুলোর আইনের বহু ফারাক বিদ্যমান। সৌদি আরবে চুরির দায়ে হাতের কবজি কেটে দেওয়ারও রেয়াজ আছে। সুতরাং কোনো বাংলাদেশিকে যেন লঘু পাপে গুরুদণ্ড ভোগ করতে না হয়, সে ব্যাপারে তাঁরা সদা সতর্ক থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.