চরাচর-ঢাকার জট, জটের ঢাকা
ট্রাফিক জ্যামে নাকাল ঢাকার সবাই। যিনি বাসে যাচ্ছেন তিনিও সামনে এগোতে না পেরে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছেন, আবার যিনি প্রাইভেট কারে চেপেছেন তাঁর অবস্থাও অন্য রকম নয়। এসব দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যিনি হেঁটে রওনা হয়েছেন তাঁর অবস্থা আরো খারাপ। দোকানদার মালপত্র রেখেছেন তাঁর দোকানের সামনের ফুটপাতে, বড় ব্যবসায়ী বা কর্মকর্তা রেখেছেন তাঁর গাড়ি, আর হকাররা তো আছেই। এ ছাড়াও পথচারীদের জন্য নতুন উৎপাত হিসেবে দেখা
দিয়েছে মোটরবাইক চালকরা। রাস্তার জ্যাম সহ্য করতে না পেরে তাঁরা বাইক তুলে দিচ্ছেন ফুটপাতে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে আর কয়েক দিন পরই 'মনুষ্যজ্যাম'-এ মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে একই স্থানে। এমন পরিস্থিতি দেখেছি কয়েক দিন আগেই ফার্মগেটের ওভারব্রিজ পার হতে গিয়ে। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে_ ১. অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ২. অসচেতনতা এবং ৩. অবৈধ পার্কিং। এর মধ্যে প্রথম দুটি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু তৃতীয় সমস্যাটির সমাধান কঠিন নয়। বাংলাদেশের অনেক সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি, কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। আর অবৈধ পার্কিং বন্ধ করতে পারলে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম কমে যাবে বারো আনা। অবৈধ পার্কিং বন্ধ হলে শহরের ট্রাফিক জ্যাম কমে যাবে এ দাবি করার সময় একটি ঘটনা বলে নেওয়া যেতে পারে। আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু খায়রুল বাশার শামীম, বাসা ঢাকার বেগুনবাড়িতে। তাঁর বাসার সামনেই একটি ওষুধের দোকান আছে। মালিকের বাসা দোকান থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে। দোকানদার ভদ্রলোক প্রতিদিন ১০টায় তাঁর প্রাইভেট কার নিয়ে দোকানে আসেন, ১টায় আবার গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে যান। বিকেলেও তিনি এভাবেই দোকান-বাসায় যাতায়াত করেন। গাড়িটি যথারীতি পার্ক করা থাকে দোকানের সামনে রাস্তায়। অবৈধ পার্কিংয়ের সুযোগ থাকায় পাওয়া যাবে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ। আর ঢাকা শহরে যদি এমন ২০ হাজার গাড়ি শুধু দেখানোর জন্য রাস্তায় পার্ক করে রাখা হয় তবে জ্যাম লাগতে আর কিছুর দরকার পড়ে কি? শুধু দোকানদার নয়, এমন লাখো গাড়ি অবৈধ পার্ক করে রাখা হয় স্কুল, মার্কেট, হাসপাতাল, অফিসপাড়ায়। বাস-ট্রাকের দুর্নাম রয়েছে অফুরন্ত, তাই ওদের কথা না হয় বাদই দিলাম। গাড়িচালকরা তো এখন অবৈধ পার্কিং শব্দটাই ভুলতে বসেছে। এসব অবৈধ পার্কিংয়ে যে জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কাজের সন্ধানে ছুটে চলা মানুষ। ধরুন, এই লেখা যখন লিখছি অথবা পড়ছি তখন ঢাকায় এক লাখ গাড়ি অবৈধ পার্কিংয়ে রয়েছে। হঠাৎ এ গাড়িগুলো উধাও হয়ে গেল, কেমন দেখাবে ঢাকা শহরকে? ফাঁকা হয়ে যাবে শহর! বেড়ে যাবে বাস-কারের গতি! আমরাও দ্রুত পেঁঁৗছে যাব গন্তব্যে! পরিবহন ব্যবসা মাস্তানি খাত থেকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে! ফলে এ সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে। 'জ্যামের শহর' দুর্নাম ঘুচবে ঢাকা শহরের কপাল থেকে। অবৈধ পার্কিং বন্ধে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে না তা নয়। নিউমার্কেট থেকে বাজার বাড়িতে নেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাতায়াত, হাসপাতালে রোগী বহন ইত্যাদি কাজ একটু কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এসব স্থানে এখন গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু অবৈধ পার্কিং বন্ধ হলে যে সুযোগ সৃষ্টি হবে তা সমস্যার তুলনায় নগণ্য। কারণ তখন প্রয়োজনেই সমাধান হবে পার্কিং সমস্যা। ইদানীং ঢাকা শহরের প্রায় সব বাড়ির গেটেই একটি নোটিশ ঝোলানো দেখা যায়। নোটিশে লেখা থাকে 'অতিথির গাড়ি বাইরে রাখুন', যা অতিথির জন্য অপমানজনক। কিন্তু এটা কেউ দেখেও দেখেন না, কারণ রাস্তায় অবৈধ পার্কিংয়ের সুযোগ আছে। যখন এ সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে তখন বন্ধ হয়ে যাবে নিমন্ত্রণের রীতিনীতিও। নিমন্ত্রণপত্রে লিখতে হবে_'...গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে' অথবা 'হেঁটে আসুন'। তেমনি মার্কেট, হাসপাতাল, স্কুলে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে হারাতে হবে গ্রাহক। প্রতিযোগিতার যুগে তা নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না। সাইফুল ইসলাম
No comments