চিকিৎসা-মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করুন by মোঃ গোলাম রব্বানী
জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগ চিকিৎসা অবহেলা করে কখনোই তা অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন। বর্তমান বাস্তবতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করে এর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। সারাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব)
জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬.১ ভাগ যে কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় (মানসিক রোগে) আক্রান্ত। এদের মধ্যে নিউরোটিক ডিসঅর্ডার শতকরা ৮.৪ ভাগ। বিষণ্নতা ৪.৬ ভাগ ও সাইকোটিক ডিজঅর্ডার ১.১ ভাগ। অন্যদিকে শিশু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর (বয়স ৫-১৭ বছর) ঢাকা বিভাগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ১৮.৪ ভাগ শিশু যে কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, মৃগীরোগ ও মাদকাসক্তির শতকরা হার যথাক্রমে ৩.৮, ২.০ ও ০.৮ ভাগ।
বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কর্মরত জনবল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মরত জনবল ০.৪৯ জন, এর মধ্যে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীতে ০.০৭ জন, যা নিতান্তই অপ্রতুল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে। মানসিক রোগ চিকিৎসায় বরাদ্দকৃত বিছানার সংখ্যা ৮২৮ এবং মানসিক রোগের জন্য হাসপাতালে অবস্থানের গড় সময়কাল ২৯ দিন। বর্তমানে স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শতকরা ০.৪ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দকৃত। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে এ বাজেট কমপক্ষে শতকরা ০৫ ভাগ হওয়া উচিত। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব আরোপ করে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগানে। কারণ মানসিক রোগের কারণে যে কর্মক্ষয় ও স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয় তা প্রতিরোধে এ বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসে (ইঅচ) দেশে কর্মরত সব মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের (মনোচিকিৎসক) প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংগঠন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব চাইল্ড, এডলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সোসাইটি নামক বিভিন্ন সংগঠন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পেশাগত গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করছে।
৪টি সমন্বিত সামরিক হাসপাতাল ও ১টি সামরিক মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগের বিশেষায়িত সেবার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ১৯টি সরকারি ও ৪২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগেরই মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ রয়েছে। কিন্তু জরুরি মানসিক রোগ চিকিৎসা সেবা শুধু জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকায় বিদ্যমান। পর্যায়ক্রমে এ ধরনের জরুরি সেবার পরিধি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় মানসিক রোগ ও চিকিৎসার প্রতি জনগণের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এরপর রয়েছে পর্যাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসক ও মনোবিদসহ বিভিন্ন জনবলের অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় রেফারেল ব্যবস্থার ঘাটতি, মানসিক রোগীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ব্যবস্থার অভাব ও গবেষণা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড স্বল্পতা।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নকল্পে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্তকরণ। এ ছাড়াও কমিউনিটির জনসাধারণের জন্য এ সেবা সহজলভ্য করা, জেলা হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৫-১০টি বিছানা সংরক্ষণ করে আলাদা ইউনিট গঠন, কমিউনিটিতে পুনর্বাসন সেবার সুযোগ, বিভিন্ন সেবাদানের সমন্বয়ে গঠিত সেবা কার্যক্রম, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিদ্যমান আইনের হালনাগাদ করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগ চিকিৎসা বিষয়ে জনসচেতনতা কর্মসূচি আরও বেগবান করা। মেন্টাল হেলথ অ্যাক্টের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, যেটি আইন হিসেবে গৃহীত হওয়ার ও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে মানসিক রোগীর মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে।
ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে সফল করতে প্রয়োজন এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ। এর অংশ হিসেবে সাইকিয়াট্রি ও বিহেভিয়ারল সায়েন্স বিষয়টিকে এমবিবিএস শিক্ষা কার্যক্রমে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সাইকিয়াট্রি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রিক নার্সিং, অকুপেশনাল থেরাপিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স কারিকুলাম প্রবর্তন ও ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ করা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে অন্যান্য বিষয়ের মতো সাইকিয়াট্রিতে এমডি কোর্সে ডিগ্রি কোর্সের সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া এমবিবিএস চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণে সাইকিয়াট্রিতে সময় বৃদ্ধি করে ১ মাস করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ইমাম, স্থানীয় নেতা, কবিরাজ ও পীর-ফকিরসহ ট্রাডিশনাল হিলারদের প্রশিক্ষণ, মানসিক রোগ চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা জরুরি।
প্রতি বছর ১০ অক্টোবর সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য 'মহৎ উদ্যোগ নিন : মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করুন'। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে এ দিবসের প্রবর্তন করে। সম্প্রতি এ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী 'গ্রেট পুশ ফর মেন্টাল হেলথ' নামক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করেছে, যার মূলনীতি হলো_ 'একতা, দৃশ্যমানতা, অধিকার এবং প্রতিকার'। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে সরকারি পর্যায়ে গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে মানসিক রোগ অসংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক কর্মসূচিতে অন্যান্য রোগের মতো সমান গুরুত্ব পায়। কারণ এটি গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, বিপুল জনগোষ্ঠী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, যাদের বেশিরভাগ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। এ চিকিৎসাসেবার ঘাটতি পূরণে মানসিক চিকিৎসাসেবায় জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি অপরিহার্য। এ বছর জাতিসংঘ সদর দফতর নিউইয়র্কে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত অসংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও অধিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন_ দরিদ্র, দুর্যোগপীড়িত, বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা, মাদকসেবী, উদ্বাস্তুসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা ইতিমধ্যেই কিছু ক্ষেত্রে শুরু করা হয়েছে, যেমন_ শিশু, দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ইত্যাদি।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ উন্নতির ভিশন বাস্তবায়নের স্বাস্থ্য অধিদফতরে মানসিক রোগের আলাদা পরিচালকের পদ সৃষ্টি করা রুরাল কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ টিম গঠন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকায় কেন্দ্রীয় সাইকিয়াট্রিক রেজিস্ট্রার ও ডাটাবেইস সংরক্ষণ, সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন, বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ চিকিৎসার একটি সমন্বিত রেফারেল সিস্টেম তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যার কেন্দ্রে থাকবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা। উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় মানসিক রোগের ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করে তা অব্যাহত রাখতে হবে।
জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগ চিকিৎসা অবহেলা করে কখনোই তা অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন। বর্তমান বাস্তবতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করে এর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আমাদের জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতির লক্ষ্য অর্জন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।
অধ্যাপক ডা. মোঃ গোলাম রব্বানী : পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট
বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কর্মরত জনবল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মরত জনবল ০.৪৯ জন, এর মধ্যে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রতি লাখ জনগোষ্ঠীতে ০.০৭ জন, যা নিতান্তই অপ্রতুল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে। মানসিক রোগ চিকিৎসায় বরাদ্দকৃত বিছানার সংখ্যা ৮২৮ এবং মানসিক রোগের জন্য হাসপাতালে অবস্থানের গড় সময়কাল ২৯ দিন। বর্তমানে স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শতকরা ০.৪ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দকৃত। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে এ বাজেট কমপক্ষে শতকরা ০৫ ভাগ হওয়া উচিত। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব আরোপ করে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগানে। কারণ মানসিক রোগের কারণে যে কর্মক্ষয় ও স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয় তা প্রতিরোধে এ বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসে (ইঅচ) দেশে কর্মরত সব মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের (মনোচিকিৎসক) প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংগঠন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব চাইল্ড, এডলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সোসাইটি নামক বিভিন্ন সংগঠন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পেশাগত গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করছে।
৪টি সমন্বিত সামরিক হাসপাতাল ও ১টি সামরিক মেডিকেল কলেজে মানসিক রোগের বিশেষায়িত সেবার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ১৯টি সরকারি ও ৪২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগেরই মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ রয়েছে। কিন্তু জরুরি মানসিক রোগ চিকিৎসা সেবা শুধু জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকায় বিদ্যমান। পর্যায়ক্রমে এ ধরনের জরুরি সেবার পরিধি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় মানসিক রোগ ও চিকিৎসার প্রতি জনগণের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এরপর রয়েছে পর্যাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসক ও মনোবিদসহ বিভিন্ন জনবলের অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় রেফারেল ব্যবস্থার ঘাটতি, মানসিক রোগীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ব্যবস্থার অভাব ও গবেষণা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড স্বল্পতা।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নকল্পে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্তকরণ। এ ছাড়াও কমিউনিটির জনসাধারণের জন্য এ সেবা সহজলভ্য করা, জেলা হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৫-১০টি বিছানা সংরক্ষণ করে আলাদা ইউনিট গঠন, কমিউনিটিতে পুনর্বাসন সেবার সুযোগ, বিভিন্ন সেবাদানের সমন্বয়ে গঠিত সেবা কার্যক্রম, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিদ্যমান আইনের হালনাগাদ করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগ চিকিৎসা বিষয়ে জনসচেতনতা কর্মসূচি আরও বেগবান করা। মেন্টাল হেলথ অ্যাক্টের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, যেটি আইন হিসেবে গৃহীত হওয়ার ও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে মানসিক রোগীর মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে।
ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে সফল করতে প্রয়োজন এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ। এর অংশ হিসেবে সাইকিয়াট্রি ও বিহেভিয়ারল সায়েন্স বিষয়টিকে এমবিবিএস শিক্ষা কার্যক্রমে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সাইকিয়াট্রি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রিক নার্সিং, অকুপেশনাল থেরাপিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স কারিকুলাম প্রবর্তন ও ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ করা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে অন্যান্য বিষয়ের মতো সাইকিয়াট্রিতে এমডি কোর্সে ডিগ্রি কোর্সের সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া এমবিবিএস চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণে সাইকিয়াট্রিতে সময় বৃদ্ধি করে ১ মাস করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিতে সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ইমাম, স্থানীয় নেতা, কবিরাজ ও পীর-ফকিরসহ ট্রাডিশনাল হিলারদের প্রশিক্ষণ, মানসিক রোগ চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা জরুরি।
প্রতি বছর ১০ অক্টোবর সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারের এ দিবসের প্রতিপাদ্য 'মহৎ উদ্যোগ নিন : মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করুন'। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে এ দিবসের প্রবর্তন করে। সম্প্রতি এ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী 'গ্রেট পুশ ফর মেন্টাল হেলথ' নামক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করেছে, যার মূলনীতি হলো_ 'একতা, দৃশ্যমানতা, অধিকার এবং প্রতিকার'। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিকে সরকারি পর্যায়ে গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, যাতে মানসিক রোগ অসংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক কর্মসূচিতে অন্যান্য রোগের মতো সমান গুরুত্ব পায়। কারণ এটি গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, বিপুল জনগোষ্ঠী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, যাদের বেশিরভাগ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। এ চিকিৎসাসেবার ঘাটতি পূরণে মানসিক চিকিৎসাসেবায় জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি অপরিহার্য। এ বছর জাতিসংঘ সদর দফতর নিউইয়র্কে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত অসংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও অধিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন_ দরিদ্র, দুর্যোগপীড়িত, বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা, মাদকসেবী, উদ্বাস্তুসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা ইতিমধ্যেই কিছু ক্ষেত্রে শুরু করা হয়েছে, যেমন_ শিশু, দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ইত্যাদি।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ উন্নতির ভিশন বাস্তবায়নের স্বাস্থ্য অধিদফতরে মানসিক রোগের আলাদা পরিচালকের পদ সৃষ্টি করা রুরাল কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ টিম গঠন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকায় কেন্দ্রীয় সাইকিয়াট্রিক রেজিস্ট্রার ও ডাটাবেইস সংরক্ষণ, সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন, বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ চিকিৎসার একটি সমন্বিত রেফারেল সিস্টেম তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যার কেন্দ্রে থাকবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা। উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় মানসিক রোগের ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করে তা অব্যাহত রাখতে হবে।
জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক রোগ চিকিৎসা অবহেলা করে কখনোই তা অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন। বর্তমান বাস্তবতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করে এর বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আমাদের জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতির লক্ষ্য অর্জন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।
অধ্যাপক ডা. মোঃ গোলাম রব্বানী : পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট
No comments