চরাচর-গারো মাতৃভাষায় শিক্ষার পাঠ্যক্রম

ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, উপজাতি, নৃজাতিগোষ্ঠী কিংবা আদবাসী_যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এসব জাতিগোষ্ঠীর লোকজনের নিজস্ব ভাষা, জীবনাচার ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতার কারণেই তারা আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে পরিচিত। সমাজের মূলস্রোত থেকে এরা আলাদা। সারা বিশ্বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছয় হাজারের ওপর ভাষা রয়েছে। আমাদের দেশেও প্রায় ৪৬ জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে।


এ ভাষায় তারা তাদের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। এ রকমই একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলো গারো। এরা 'মান্দি' নামেও পরিচিত। গারোদের নিজস্ব পরিচয় বহন করে তাদের ভাষা। ভাষার স্বাতন্ত্র্যই তাদের অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। গারোভাষীরা যেভাবে বলে, 'চিংয়া জুমাঙ নিকগা মা'য়নি কুচি পরিজেন, ডাল্লা মান্দি অংয়ে আসঙ্গনি, রাসঙ্গনা কেম খাজেন' (আমরা স্বপ্ন দেখি, মাতৃভাষায় পড়ালেখা শিখে বড় হয়ে দেশের জন্য কাজ করব, নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ চাই), রাষ্ট্রকেই সে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ১৯৮০ সালের আইএলও কনভেনশন, আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র, ২০০৭ সালে জাতিসংঘঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০০৯ সালের শিক্ষানীতিতেও আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। গারোদের নিজস্ব ভাষা আচিক। নিজেদের মধ্যে গারোরা আচিক ভাষায় কথা বলে। কিন্তু গারোদের ভাষার কোনো বর্ণ কিংবা লিখিত রূপ নেই। আমাদের দেশে নিজেদের মাতৃভাষায় পড়ালেখার সুযোগ না থাকায় গারোরা অন্য ভাষায় লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে শিশু বয়সেই তারা হোঁচট খাচ্ছে। অন্য ভাষা বুঝতে না পারার কারণে অনেক সময় শিশু বয়সেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, ভাষার পাশাপাশি গারোরা তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যও হারাচ্ছে। শেরপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল জেলাসহ মধুপুর গড় অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক গারো জনগোষ্ঠীর বাস। গারো ভাষার নিজস্ব বর্ণ নেই,। তাতে কি, সারা বিশ্বে যে ভাষা রাজত্ব করছে, সেই ইংরেজি ভাষারও নিজস্ব কোনো বর্ণ নেই। ইংরেজি বর্ণগুলোও রোমান হরফ থেকে নেওয়া। গারো ভাষার বর্ণমালার জন্যও রোমান হরফ বেছে নেওয়া হয়েছে।
আদিবাসী গবেষক ও লেখক বাঁধন আরেং এবং গারো ল্যাঙ্গুয়েজ এডুকেশন ইন্টারেকশন বাংলাদেশের টিম লিডার ও ভাষা গবেষক সিমিয়ন মিনাল কান্তি সাংমা বলেন, মাতৃভাষায় পড়াশোনা খুবই জরুরি। এতে মনের ভাব সুন্দর করে প্রকাশ করা যায়। মাতৃভাষা জানা থাকলে অন্য ভাষা শেখার ভিত তৈরি হয়। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে 'কমিউনিটি মোবিলাইজেশন' করে গারো বর্ণমালা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে সব গারো অঞ্চলকে 'কাভার' করে। চারটি সংগঠন নিয়ে 'মাল্টি লিটারাল ল্যাংগুয়েজ' নামে একটি 'প্ল্যাটফর্ম' তৈরি করা হয়েছে। এ নিয়ে জাতীয়ভাবে সভা-সেমিনার, কর্মশালা করা হয়েছে। সামার ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়িস্টিক (সিল) এতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের মেঘালয় থেকেও গারো ভাষার বইপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এভাবেই গারো মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরির চেষ্টা চলছে। গারো আদিবাসী নেতা ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন এমপি বলেন, প্রত্যেকেই যার যার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। বর্তমান সরকার সব জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষা সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। এ জন্য শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের সংশ্লিষ্ট ভাষায় শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচর্চা, বিকাশ ও রক্ষায় এ সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। আমরা বাঙালিরা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। গারো, হাজং, কোচ, বানাই, বর্মণ, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণে আমাদের আরো নজর দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
হাকিম বাবুল

No comments

Powered by Blogger.