মুঠোফোনে সরকারি সেবা by এ এম এম শওকত আলী

মুঠোফোনে সরকারি সেবা প্রদান ক্ষমতাসীন সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ-নীতির মধ্যে অন্যতম। কিছুদিন ধরেই সরকারের গৃহীত এ উদ্যোগ প্রায় সব কয়টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলো বাস্তবায়নে লিপ্ত। সরকারের উদ্যোগকে সহায়তার জন্য কিছু উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানও অনুদান দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ডেনমার্কের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ডানিডা)।


এই উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তার আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সংস্থাও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণে লিপ্ত। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইউএনডিপির এ টু আই প্রকল্প বাস্তবায়নে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর (পিএমও) সম্পৃক্ত। তবে এদের কাজ সব কয়টি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে। জানা যায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নব্যবস্থা পিএমও সমন্বয় করছে। সমন্বয় সাধন কতটুকু কার্যকর তা জানা যায়নি। ইউএনডিপির এ টু আই প্রকল্পের আওতায় কৃষি তথ্য সংস্থা এ পর্যন্ত ৯টি এবং ডানিডা সমর্থিত প্রকল্পের আওতায় মোট ১০টি কৃষি তথ্য প্রদানকেন্দ্র স্থাপন ও চালু করেছে।
এ সংস্থার কার্যক্রম প্রচারের বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু ভালো-মন্দের সংবাদ মিডিয়ায় খুব একটা দেখা যায়নি, যেমনটি মাঝেমধ্যে দেখা গেছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। অক্টোবরের দুই তারিখে একটি বাংলা দৈনিকে 'হাসপাতালে আছে মুঠোফোনে স্বাস্থ্যসেবা, জনগণের অজানা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায় যে ২০০৯ সালে দেশের ৪১৮টি হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মুঠোফোনে স্বাস্থ্যসেবা চালু হয়। প্রকাশিত সংবাদটি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলা-সংক্রান্ত। এ জেলার সদর হাসপাতাল, শ্রীপুর, শালিখা ও মহম্মদপুর উপজেলার স্বাস্থ্যদেন্দ্রে মোট চারটি মুঠোফোন রয়েছে। অথচ সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা অনেকেই এসব ফোন সম্পর্কে অবহিত নন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে অবহিত করার কথা। সংবাদ দৃষ্টে মনে হয়, এ কাজটি সঠিকভাবে করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টা এ মুঠোফোনে কর্মরত চিকিৎসক সেবা-সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করবেন। তা কতটুকু কার্যকর, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহ যে একেবারেই অমূলক তা বলা যাবে না। কারণ একাধিক।
এক, উপজেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি সর্বজনবিদিত। বহুকাল ধরেই এ অবস্থা বিরাজমান। দুই, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যাবিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রামাঞ্চলের মানুষ পায় না। তারা এ জন্য হয় হাতুড়ে ডাক্তার বা আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। এ ছাড়া তাদের প্রথম গন্তব্যস্থল হয় নিকটস্থ খুচরা ওষুধের দোকান। তিন, সরকারি চিকিৎসকদের ওই সব অঞ্চলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, যেকোনো নতুন উদ্যোগ গ্রহণের আগে বাস্তবতার নিরিখে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে কোনো সময়ই এটা হয়নি। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অতিউৎসাহী সরকারি কর্মকর্তারা যেকোনো ঘোষিত বিষয়ে কর্মতৎপরতা প্রদর্শনে লিপ্ত হন। সরকারি অর্থে মুঠোফোন ক্রয় করে সরবরাহ করা হয়েছে, কিন্তু ঈপ্সিত ফল অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষি তথ্য সংস্থার কার্যক্রমের কি একই অবস্থা? প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন ব্যতীত কোনো সঠিক তথ্য প্রদান সম্ভব নয়। যে উনিশটি কৃষি তথ্যকেন্দ্রের কথা বলা হয়েছে, এরপর প্রথমে ৭৫টি এবং বর্তমানে ৯৫টি এ ধরনের কৃষি তথ্যকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ বছরের পরিকল্পনায় আরো ১৫০টি কেন্দ্র চালু করা হবে। তবে কৃষি তথ্যকেন্দ্রের কৌশল ভিন্নতর। এরা সরাসরি কৃষকের মাধ্যমে তথ্য প্রদানের জন্য ব্যবহার করে থাকে। সারা দেশে প্রায় ১৮ হাজার গ্রামে কৃষকদের নিয়ে গঠিত আইপিএম বা আইসিএম ক্লাব রয়েছে। কৃষি তথ্য সংস্থা এসব ক্লাবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী এসব ক্লাব বা কৃষকদের অন্য দলভিত্তিক সংগঠন নিজেরাই মুঠোফোনসহ কম্পিউটারের মাধ্যমে কৃষি তথ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, যাতে আগ্রহী কৃষক প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে পারেন। এসব স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তারা পালন করবে। যে ৯৫টি কৃষি তথ্যকেন্দ্র এ সংস্থা চালু করেছে, তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নাম ও মুঠোফোনের নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে নিজস্ব টেলিফোন নির্দেশিকায়। বাংলালিংক এ কার্যক্রমের জন্য ২৫ হাজার সিম কার্ড দিয়েছে বিনামূল্যে। আরো ১০ হাজার সিম এ কম্পানি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কৃষি তথ্য সংস্থার কার্যক্রম মুঠোফোনের মধ্যেই সীমিত নয়। অন্যান্য মাধ্যম হলো_ওয়েবসাইট, সার-সংক্রান্ত সফটয়্যার, কৃষক টিভি, কমিউনিটি রেডিও, আঞ্চলিক আইসিটি ল্যাব ইত্যাদি। মুঠোফোনের মাধ্যমে এরা এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার কৃষককে কৃষি প্রযুক্তিগত তথ্যসেবা প্রদান করেছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর কার্যক্রম, ই-বুক প্রণয়ন, এ পর্যন্ত আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং টমেটোবিষয়ক ই-বুক প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে অনলাইন কৃষক টিভি। তবে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক জায়গায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে এ কথা ঠিক যে কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্য প্রদান ও স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে সেবা প্রদানে তারতম্য অবশ্যই থাকবে। দুই ক্ষেত্রেই একটি বিষয় অভিন্ন। তা হলো, স্বাস্থ্যগত বিষয় দুই ক্ষেত্রেই সমান। কৃষিক্ষেত্রে ফসলসহ বিভিন্ন প্রকারের অন্য শস্য_যার স্বাস্থ্যরক্ষা কাম্য। এর মধ্যে রোগবালাইয়ের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাস্থ্য। অন্যদিকে প্রাণীবিষয়ক ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। সব ক্ষেত্রেই প্রাথমিক তথ্য প্রদান ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাম্য। তবে এ জন্য সাবধানতা অবলম্বন করাও প্রয়োজন। অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে।
আলোচ্য সংবাদ সম্পর্কে যা বলা হলো, তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। মাত্র একটি জেলার চারটি হাসপাতালের করুণ দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এটাই যে সারা দেশে বিরাজমান, তা বলা যাবে না। স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত পরামর্শ টিভি মিডিয়াও চালু করেছে। প্রশ্ন ও উত্তরের বিষয়বস্তু দেখলে বলা যায় যে অনেক ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে জটিল বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা সুচিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করার অনুরোধ প্রশ্নকারীকে করে থাকেন। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বিষয় হলো স্বাস্থ্যশিক্ষা। এর সঙ্গে পুষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিহীনতাও বিভিন্ন ব্যাধির অন্যতম কারণ। অথচ এ বিষয়ে খুব একটা তথ্য জনগণকে দেওয়া হয় না। এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
ডিজিটাল পদ্ধতির সর্বজনীন ব্যবহারের বিষয়ে দ্রুত সুফল অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সময়ের। অধীর হলে সুফলের বিপরীতে কুফল হওয়ারই আশঙ্কা অধিকতর। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের আগেই টেলিমেডিসিন পদ্ধতি চালু হয়েছিল। এ পদ্ধতি কতটুকু সার্থক হয়েছে, সে বিষয়টিও অনুসন্ধানযোগ্য। শহরাঞ্চলের শিক্ষিত ব্যক্তিরা এ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। ছোটখাটো রোগের জন্য তাঁরা টেলিফোনেই সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। গ্রামাঞ্চলেও এখন মোবাইল ফোন যথেষ্ট ব্যবহার হয়। সরকারি ডাক্তারদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের অন্যতম অন্তরায়।
এ পর্যন্ত কেবল দুই খাতের সরকারি সেবা প্রদানের চিত্র পর্যালোচনা করা হয়েছে। অন্যান্য খাত যেমন_আইনশৃঙ্খলা, বিচারাধীন মামলা, ভূমির মালিকানা-সংক্রান্ত বিষয়েও অধিকতর তথ্যের প্রয়োজন। ই-এফআইআর হবে কি না? জিডি দাখিলের কথা প্রচার করা হয়েছে। তা কতটুকু কার্যকর, সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। আর ই-এফআইআর হলেও পুলিশ কি তা ই-এফআইআর-এর পরিবর্তে জিডি হিসেবে গণ্য করবে? এ দুয়ের মধ্যে কী পার্থক্য তা সাধারণ জনগণ জানে না। কাজেই থানা পুলিশই এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.