কৃষকের হাতে হাতকড়া কেন? by লুৎফর রহমান রনো
আমাদের দেশের একজন সম্মানিত সমাজসচেতন শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাঁর একটি কলামে লিখেছিলেন_'অনেকেই বলেন, বাঙালি রাজনীতিসচেতন।' তিনি এর কারণ হিসেবে বলেছেন, বাঙালি জাতি সুদীর্ঘকাল ধরে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই করে আসছে স্বাধীনতার জন্য বা অধিকার আদায়ের জন্য, তাই রাজনীতিসচেতন হওয়াটাই স্বাভাবিক...। কিন্তু আসলেই কি তা-ই, বাঙালি জাতি অন্যান্য জাতির তুলনায় অধিক রাজনীতিসচেতন?
আমি এ কথা মন থেকে মানতে পারছি না। রাজনীতিসচেতন হলে এ দেশের সাধারণ মানুষের দুর্গতি ঔপনিবেশিক সময়ের মতোই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় থাকত না। বিজাতীয় শাসকদের বিদায়ের পর স্বজাতির শাসকরা বিজাতীয় শাসন-শোষণের পদ্ধতি অবিকল জারি রাখতে পারত না। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে চেতনা নিয়ে এ জাতি লড়াই শুরু করেছিল, সেই মাস্টারদা, প্রীতিলতার চেতনাপুষ্ট জাতি তার সর্বশেষ শক্তি উৎসর্গ করেছিল একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে। তার পর থেকে তিন প্রজন্মের সময় অতিক্রান্ত হতে চলেছে, আমাদের রাজনীতির বাতাসে বাড়ছে অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ। যে পরিবেশে জাতির গণতান্ত্রিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া অতিশয় কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এ জন্যই বলছি, স্বাধীনতা-উত্তরকালে 'রাজনীতিসচেতনতা' কথাটির অন্তর্নিহিত সত্য আর অবশিষ্ট নেই। বরং সচেতনতা শব্দের আড়ালে রাজনৈতিক অন্ধত্ব ও উন্মত্ততা জেঁকে বসেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষর মধ্যে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি সময়ের সঙ্গে এগোচ্ছে, আর আমরা পেছনের দিকে যাচ্ছি। সৌদি আরবে মেয়েদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আরব বিশ্বের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের গণ-অভ্যুত্থানের খবর আমরা জানি। সেসব গণজাগরণই সৌদি রাজতন্ত্রের বোধোদয় ঘটিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমান্বয়ে আংশিক বা পুরোপুরি রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র রয়েছে, এমন দেশও গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। আমাদের দেশের স্বৈর ও সেনাশাসনের অবসান হয়েছে ঠিকই, তবু গণতন্ত্র যেন অদৃশ্য; শুধু নথিপত্রে, দেশের সংবিধানে, দলের ম্যানিফেস্টোতে গণতন্ত্রের আক্ষরিক অস্তিত্ব ছাড়া কিছু নেই কোথাও। গণতন্ত্রের মর্ম অতি সাধারণ অর্থে যা বোঝায় তা হলো, প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। তবে যার বেশি আয়-রোজগার আছে সে ভালো খাবে, যে গরিব সে তো অপুষ্টিতে ভুগবে_এ অসংগতি ও বৈষম্য মেনে নিচ্ছে মানুষ। এই অমানবিক বৈষম্য মেনে নেওয়াটা হলো সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা মেনে চলা_অন্যথায় শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে রাষ্ট্র জেলে ঢোকাতে পারে। সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক পৃথিবীর এই আইন অতি শান্ত মনে মেনে নিচ্ছে, কিন্তু এই বৈষম্য বাদে বাদবাকি যেসব গণতান্ত্রিক অধিকার, তা কি রাষ্ট্র নিশ্চিত করে থাকে? আইন সবার জন্য সমান কি? চিকিৎসা-শিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক সেবা ও নাগরিক নিরাপত্তা কি রাষ্ট্র সবার জন্য সমানভাবে সংরক্ষণ করছে? না।
একটি দৈনিক পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ বেরিয়েছে_একজন কৃষকের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যাংক সার্টিফিকেট মামলা করেছে, একজন পুলিশ সদস্য হাতকড়া পরিয়ে কৃষক আজিজার রহমানকে নিয়ে যাচ্ছে। হাজত থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তিনি পরের জমি চাষ করে সংসার চালাতেন। আলু চাষের জন্য ১০ হাজার টাকা কৃষিঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু আলুর দাম পড়ে যায় এবং নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ায় তিনি ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই তাঁকে জেলে যেতে হচ্ছে। অথচ আমরা জানি, এসব ব্যাংক শিল্পপতি ও তথাকথিত উদ্যোক্তাদের (রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রাপ্ত সুবিধা) শত শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যায়, পরিশোধে ব্যর্থ সেসব নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। কখনো পত্রিকায় আমরা তেমন সুসংবাদ পড়িওনি। অতিসম্প্রতি শেয়ারবাজারের অর্থ লোপাট নিয়ে কত কিছুই হয়ে গেল। তদন্ত কমিটি হলো, দোষীদের চিহ্নিত করা হলো। কিন্তু কারো হাতেই হাতকড়া পরানোর সৎসাহস দেখাতে পারেনি রাষ্ট্র। অথচ ১০ হাজার টাকার জন্য ওই কৃষককে হাতকড়া পরাতে এতটুকু লজ্জাও হয়নি ওদের। এসব অভাবি কৃষকই খেয়ে না খেয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন। তাঁদের শ্রমে-ঘামে ফলানো সবজি তাঁরা বিক্রি করেন ২০ টাকা কেজি দরে। তাঁদের উৎপাদন খরচ তাতে ওঠে না। অথচ শহরের মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফা ঠিকই গুনে নিচ্ছে কেজি প্রতি ৫০ টাকা মূল্যে বিক্রি করে। তো ওই গরিব কৃষকদের আর কতভাবে শোষণ-শাসন করবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা ধনীদের লালন-পালনকারী পদ্ধতির রাষ্ট্রব্যবস্থা? তার পরও তাঁরা লাইন বেঁধে ভোট দেন এই বাঙ্ েবা ওই বাঙ্।ে সাধারণ মানুষ জানে না, গণতন্ত্র বা নাগরিক অধিকার সেসব বাঙ্ েবন্দি। নাগরিক অধিকার আর স্বাধীনতা ধনী ও দলের নেতা-চেলা-চামচাদের জন্য। কোথায় তবে রাজনৈতিক সচেতনতা?
এখন যে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তা কি এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে? আলবত না। ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতায় যাওয়ার 'ফাইনাল খেলা' আসন্ন তাই। এ খেলায় যদি বিরোধী দলের আবার ভরাডুবি হয়, তবে তারেক-কোকো শাহজাদাদ্বয়ের কী হবে, অপরদিকে ওঁত পেতে থাকা জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী, স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠীর খেলার মাঠ যে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে_এসব ধান্ধা ও দুর্ভাবনা থেকেই রাজনীতির মাঠ গরম হচ্ছে। এই সচেতনতাটুকু আমাদের খুবই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক
একটি দৈনিক পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ বেরিয়েছে_একজন কৃষকের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যাংক সার্টিফিকেট মামলা করেছে, একজন পুলিশ সদস্য হাতকড়া পরিয়ে কৃষক আজিজার রহমানকে নিয়ে যাচ্ছে। হাজত থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তিনি পরের জমি চাষ করে সংসার চালাতেন। আলু চাষের জন্য ১০ হাজার টাকা কৃষিঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু আলুর দাম পড়ে যায় এবং নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ায় তিনি ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই তাঁকে জেলে যেতে হচ্ছে। অথচ আমরা জানি, এসব ব্যাংক শিল্পপতি ও তথাকথিত উদ্যোক্তাদের (রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রাপ্ত সুবিধা) শত শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যায়, পরিশোধে ব্যর্থ সেসব নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। কখনো পত্রিকায় আমরা তেমন সুসংবাদ পড়িওনি। অতিসম্প্রতি শেয়ারবাজারের অর্থ লোপাট নিয়ে কত কিছুই হয়ে গেল। তদন্ত কমিটি হলো, দোষীদের চিহ্নিত করা হলো। কিন্তু কারো হাতেই হাতকড়া পরানোর সৎসাহস দেখাতে পারেনি রাষ্ট্র। অথচ ১০ হাজার টাকার জন্য ওই কৃষককে হাতকড়া পরাতে এতটুকু লজ্জাও হয়নি ওদের। এসব অভাবি কৃষকই খেয়ে না খেয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন। তাঁদের শ্রমে-ঘামে ফলানো সবজি তাঁরা বিক্রি করেন ২০ টাকা কেজি দরে। তাঁদের উৎপাদন খরচ তাতে ওঠে না। অথচ শহরের মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফা ঠিকই গুনে নিচ্ছে কেজি প্রতি ৫০ টাকা মূল্যে বিক্রি করে। তো ওই গরিব কৃষকদের আর কতভাবে শোষণ-শাসন করবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা ধনীদের লালন-পালনকারী পদ্ধতির রাষ্ট্রব্যবস্থা? তার পরও তাঁরা লাইন বেঁধে ভোট দেন এই বাঙ্ েবা ওই বাঙ্।ে সাধারণ মানুষ জানে না, গণতন্ত্র বা নাগরিক অধিকার সেসব বাঙ্ েবন্দি। নাগরিক অধিকার আর স্বাধীনতা ধনী ও দলের নেতা-চেলা-চামচাদের জন্য। কোথায় তবে রাজনৈতিক সচেতনতা?
এখন যে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তা কি এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে? আলবত না। ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতায় যাওয়ার 'ফাইনাল খেলা' আসন্ন তাই। এ খেলায় যদি বিরোধী দলের আবার ভরাডুবি হয়, তবে তারেক-কোকো শাহজাদাদ্বয়ের কী হবে, অপরদিকে ওঁত পেতে থাকা জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী, স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠীর খেলার মাঠ যে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে_এসব ধান্ধা ও দুর্ভাবনা থেকেই রাজনীতির মাঠ গরম হচ্ছে। এই সচেতনতাটুকু আমাদের খুবই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক
No comments