রঙ্গব্যঙ্গ-জ্যোতিষশাস্ত্র এবং মরা গাছে ফুল! by মোস্তফা কামাল
পুরনো দিনের একটি গান আছে, আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে গ্রামোফোনে গানটি বেশ শোনা যেত। আধুনিক জমানায়ও গানটি বিভিন্ন জায়গায় মাঝেমধ্যে শোনা যায়। গানটির একটি কলি হচ্ছে এ রকম_'মরা গাছে ফুল ফুইটাছে ডাল ভাইঙ্গো না রে মালি ফুল ছিঁড়ো না।' নিশ্চয়ই গানটি অনেকের মনে আছে। সেই গানের সুরটিই এখন রাজনীতির ভাঙা রেকর্ডে বেজে চলেছে। হালের রাজনীতি এখন মরা গাছে ফুল ফোটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
এরপর রাজনীতি হয়তো জ্যোতিষীদের হাতে চলে যাবে। এতে অবশ্য বেশি উপকার পাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইদানীং নাকি তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর পড়াশোনাও শুরু করেছেন। কারণ সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করলে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কী বলতে কী বলে ফেলেন! বেফাঁস কথা বলে সরকারকে বিপাকে ফেলেন। বেফাঁস কথা বলে এর আগে কয়েকবার ফেঁসে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়েছেন। একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় কথায় ধমক খাওয়া শোভা পায় না!
জ্যোতিষশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলে সাংবাদিকরা কী প্রশ্ন করবেন আর তার জবাব কী হবে, তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগেই বুঝতে পারবেন। কাজেই সাংবাদিকদের ফেস করতে তাঁর আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
জ্যোতিষশাস্ত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফল হলে আরো কয়েকজন মন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রীসহ আরো কয়েকজন মন্ত্রী নাকি অপেক্ষা করছেন। তাঁদের কেউ কেউ জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর বইপত্রও জোগাড় করতে শুরু করেছেন। ব্যাপারটা আগেকার যুগের রাজা-বাদশাহদের মতোই হবে; আগেকার দিনে যেমন রাজা-বাদশাহরা পুরোপুরি জ্যোতিষীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কখন কী করলে ভালো কিংবা মন্দ হবে, তা বাতলে দিতেন জ্যোতিষীরা। সেই জমানার উদ্দেশে আমরা পাড়ি দিচ্ছি।
আমাদের রাজনীতিও এখন জ্যোতিষীরা ঠিক করে দেবেন। তাঁরা দিনক্ষণ গুনে বলে দেবেন, অমুক দিন অমুক দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামলে পুলিশের পিটুনি খেতে হবে না। বুটের তলায় কারো প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে না।
আমরা অবশ্য জানি, পুলিশের পিটুনি নয়, বিএনপির নেতারা ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি-শার্টের ভাঁজ ভেঙে যাওয়ার ভয়ে রাস্তায় নামেন না। দু-একজন টি-শার্ট কিংবা পোলো শার্ট পরে সাহস করে পুলিশকে কিল-ঘুষি মেরে হিরো হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশির ভাগ নেতাই রাস্তায় নামার চেয়ে ড্রয়িংরুমে বসে রাজা-উজির মারতে বেশি পছন্দ করেন। তাঁরাই অবশ্য খালেদা জিয়াকে হরতাল ডাকার ব্যাপারে প্ররোচিত করেন। এতে সুবিধা হচ্ছে, বিনা শ্রমে আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলা যায়। হরতাল ডেকে ঘরে বসে ভুনা খিচুড়ি খাওয়ার সুযোগও পাওয়া যায়। ভূরিভোজের পর লম্বা একটা ঘুম দেওয়া যায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে বিকেলে চোঙার সামনে বেশ দম্ভ করে বলা যায়, 'হরতাল সফল হয়েছে। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। কাজেই তাদের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।'
সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের নেতারা বলেন, হরতাল সফল হয়নি। বিরোধী দলের ডাকে জনগণ সাড়া দেয়নি।
কিন্তু শুধু কথা বলে তো আর বিরোধী দলের হরতাল বন্ধ করা যাবে না। বিরোধী দল হরতাল ডাকলে জ্যোতিষশাস্ত্র মতে তাদের ঠেকানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য সরকার দেশের কয়েকজন খ্যাতনামা জ্যোতিষীর সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করতে পারে। তাঁরা সময়ে সময়ে সরকারকে রাজনীতির ভবিষ্যদ্বাণী দেবেন। সে অনুযায়ী সরকার তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে।
আন্দোলন জমাতে খালেদা জিয়া এখনই কয়েকজন জ্যোতিষীকে তাঁর উপদেষ্টা বানাতে পারেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী কর্মসূচি দিলে সরকারের পতন ঘটতে খুব একটা সময় লাগবে না। তাঁকেও আর বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে না। আহা রে বেচারি, মসনদ হারিয়ে কী কষ্টেই না আছেন!
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তিনি মরা গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন একটি মরা গাছ। মরা গাছে আর ফুল ফুটবে না।
আসলে কি মরা গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টা কেউ করেছে! চেষ্টা করলে ফুল ফুটতেও তো পারে! সেই সম্ভাবনার কথাই বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, পরিচর্যা করলে আবারও সেই মরা গাছে ফুল ফুটতে পারে। তিনি সুরঞ্জিতের উদ্দেশে বলেন, 'গাছটি তো আপনারাই বপন করেছিলেন। আবার আপনারাই নিজের হাতে গাছটা কেটে ফেলেছেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি মানুষের কাছে একটি সৃজনশীল ব্যবস্থা ছিল। এটিকে জনগণ পানি দিয়ে আবার বাঁচিয়ে তুলবে। কারণ বাংলাদেশের মাটি অনেক উর্বর।'
বিএনপি নেতা ফখরুলের কথার সূত্র ধরেই বলি, এই মাটিতে যেমন সোনা ফলে, আবার এই মাটিতে আগাছাও বেশি জন্মায়। সেই আগাছা ছেঁটে ফেলতে না পারলে সোনার ফসল ঘরে তোলা কিন্তু মুশকিল হয়ে যাবে! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে আগাছাগুলো ছেঁটে ফেলি!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
জ্যোতিষশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলে সাংবাদিকরা কী প্রশ্ন করবেন আর তার জবাব কী হবে, তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগেই বুঝতে পারবেন। কাজেই সাংবাদিকদের ফেস করতে তাঁর আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
জ্যোতিষশাস্ত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফল হলে আরো কয়েকজন মন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রীসহ আরো কয়েকজন মন্ত্রী নাকি অপেক্ষা করছেন। তাঁদের কেউ কেউ জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর বইপত্রও জোগাড় করতে শুরু করেছেন। ব্যাপারটা আগেকার যুগের রাজা-বাদশাহদের মতোই হবে; আগেকার দিনে যেমন রাজা-বাদশাহরা পুরোপুরি জ্যোতিষীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কখন কী করলে ভালো কিংবা মন্দ হবে, তা বাতলে দিতেন জ্যোতিষীরা। সেই জমানার উদ্দেশে আমরা পাড়ি দিচ্ছি।
আমাদের রাজনীতিও এখন জ্যোতিষীরা ঠিক করে দেবেন। তাঁরা দিনক্ষণ গুনে বলে দেবেন, অমুক দিন অমুক দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নামলে পুলিশের পিটুনি খেতে হবে না। বুটের তলায় কারো প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে না।
আমরা অবশ্য জানি, পুলিশের পিটুনি নয়, বিএনপির নেতারা ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি-শার্টের ভাঁজ ভেঙে যাওয়ার ভয়ে রাস্তায় নামেন না। দু-একজন টি-শার্ট কিংবা পোলো শার্ট পরে সাহস করে পুলিশকে কিল-ঘুষি মেরে হিরো হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশির ভাগ নেতাই রাস্তায় নামার চেয়ে ড্রয়িংরুমে বসে রাজা-উজির মারতে বেশি পছন্দ করেন। তাঁরাই অবশ্য খালেদা জিয়াকে হরতাল ডাকার ব্যাপারে প্ররোচিত করেন। এতে সুবিধা হচ্ছে, বিনা শ্রমে আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলা যায়। হরতাল ডেকে ঘরে বসে ভুনা খিচুড়ি খাওয়ার সুযোগও পাওয়া যায়। ভূরিভোজের পর লম্বা একটা ঘুম দেওয়া যায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে বিকেলে চোঙার সামনে বেশ দম্ভ করে বলা যায়, 'হরতাল সফল হয়েছে। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। এই সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। কাজেই তাদের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।'
সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের নেতারা বলেন, হরতাল সফল হয়নি। বিরোধী দলের ডাকে জনগণ সাড়া দেয়নি।
কিন্তু শুধু কথা বলে তো আর বিরোধী দলের হরতাল বন্ধ করা যাবে না। বিরোধী দল হরতাল ডাকলে জ্যোতিষশাস্ত্র মতে তাদের ঠেকানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য সরকার দেশের কয়েকজন খ্যাতনামা জ্যোতিষীর সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করতে পারে। তাঁরা সময়ে সময়ে সরকারকে রাজনীতির ভবিষ্যদ্বাণী দেবেন। সে অনুযায়ী সরকার তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে।
আন্দোলন জমাতে খালেদা জিয়া এখনই কয়েকজন জ্যোতিষীকে তাঁর উপদেষ্টা বানাতে পারেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী কর্মসূচি দিলে সরকারের পতন ঘটতে খুব একটা সময় লাগবে না। তাঁকেও আর বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে না। আহা রে বেচারি, মসনদ হারিয়ে কী কষ্টেই না আছেন!
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তিনি মরা গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন একটি মরা গাছ। মরা গাছে আর ফুল ফুটবে না।
আসলে কি মরা গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টা কেউ করেছে! চেষ্টা করলে ফুল ফুটতেও তো পারে! সেই সম্ভাবনার কথাই বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, পরিচর্যা করলে আবারও সেই মরা গাছে ফুল ফুটতে পারে। তিনি সুরঞ্জিতের উদ্দেশে বলেন, 'গাছটি তো আপনারাই বপন করেছিলেন। আবার আপনারাই নিজের হাতে গাছটা কেটে ফেলেছেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি মানুষের কাছে একটি সৃজনশীল ব্যবস্থা ছিল। এটিকে জনগণ পানি দিয়ে আবার বাঁচিয়ে তুলবে। কারণ বাংলাদেশের মাটি অনেক উর্বর।'
বিএনপি নেতা ফখরুলের কথার সূত্র ধরেই বলি, এই মাটিতে যেমন সোনা ফলে, আবার এই মাটিতে আগাছাও বেশি জন্মায়। সেই আগাছা ছেঁটে ফেলতে না পারলে সোনার ফসল ঘরে তোলা কিন্তু মুশকিল হয়ে যাবে! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে আগাছাগুলো ছেঁটে ফেলি!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments