কালান্তরের কড়চা-চাণক্যপুরীর কূটকৌশল এবং বাংলাদেশের বিদেশনীতি-৪ by আবুদল গাফ্ফার চৌধুরী
পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ছিল হিন্দি ও উর্দু ছায়াছবির বাজার। কলকাতার বাংলা ছবিও আসত। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা ছবির বাজার সৃষ্টির কোনো চেষ্টাই মুসলিম লীগ সরকার করেনি। তারা চেয়েছিল, লাহোরে তৈরি উর্দু ছবিই পূর্ব পাকিস্তানের বাজার দখল করুক। কিন্তু মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা পেরে উঠছিল না। ফলে ভারতীয় ছবি (হিন্দি ও বাংলা দুয়েরই) আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তারা চেষ্টা চালাচ্ছিল।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়ের কিছুকাল পর আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা যখন ক্ষমতায়, তখন সেই মন্ত্রিসভার শিল্পমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা ছবি নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্য ঢাকায় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা এফডিসি প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় বাংলা ছবি (এমনকি দু-একটি উর্দু ছবিও) নির্মাণ শুরু হয়। লাহোরে তৈরি নিম্নমানের উর্দু ছবি আর পূর্ব পাকিস্তানে বাজার দখল করতে পারেনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা মনে করলেন এখন আর তাঁদের পায় কে? বাংলাদেশে তাঁদের হিন্দি ছবি পপুলার। তা ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখনো গড়ে ওঠেনি। সুতরাং সহজেই এই বিশাল বাজার তাঁরা দখল করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো এর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু সজাগ ও সতর্ক ছিলেন। তিনি মুম্বাইয়া হিন্দি ছবি যাতে অবাধে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য এ ব্যাপারে বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ছায়াছবিকেও আনার ব্যবস্থা করেন।
ছায়াছবিসংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পর্কে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বৈঠকটি হয় ১৯৭৪ সালে কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। বাংলাদেশের টিমে আমি একজন বেসরকারি সদস্য ছিলাম। ভারত থেকে বাংলাদেশে ছবি আনার কোটা নির্ধারণ এবং বাংলাদেশ থেকেও ভারতে ছবি রপ্তানির সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে এ বৈঠকে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে দিলি্লতে চুক্তিটি হবে। আমাদের সমস্যা ছিল, বাংলাদেশ থেকে যত ছবি আমরা ভারতে পাঠাতে চাই, তত সংখ্যক ছবি তখন ঢাকায় নির্মিত হচ্ছিল না। বাংলাদেশের মফস্বল শহরে তখন সিনেমা হলের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। চাহিদামতো ছবির অভাবে পুরনো হিন্দি ছবি তাতে তখন দেখানো হচ্ছিল। কিছু ইংরেজি ছবিও।
কলকাতা বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিরা যে প্রস্তাব তুললেন, তাতে মুম্বাইয়া হিন্দি ছবিই বারো আনা পাঠানোর কথা বলা হলো। তাতে বাংলা, ওড়িয়া, তামিল ভাষার ছবিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তবে সংখ্যায় খুবই কম। অন্যদিকে ঢাকা থেকে পাঠানো বাংলা ছবির জন্য মান পরীক্ষার শর্ত যুক্ত করা হলো। আমরা এ প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমাদের প্রস্তাব ছিল, ভারত থেকে ছবি আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ অসম্মত নয়। কিন্তু মুম্বাইয়া হিন্দি ছবির বদলে কলকাতার বাংলা ছবি বেশি পাঠাতে হবে। কারণ বাংলাদেশ মুখ্যত বাংলাভাষী দেশ।
১৯৭৪ সালের সেই বৈঠকেও ভারত ২০১১ সালের তিস্তা বৈঠকের মতো আপত্তি তুলে বলেছিল, বাংলাদেশে বাংলা ছবি পাঠানোকে প্রাধান্য দেওয়া হলে ভারতের অন্য রাজ্যগুলো আপত্তি তুলবে। তারা বলবে, বাংলাদেশের সঙ্গে ছায়াছবিসংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তিতে তাদের প্রতি দিলি্লর কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য করেছে। আমরা বলেছি, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের যেমন আসাম, ওড়িশা, মাদ্রাজ, তামিলনাড়ুরও দু-একটি ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু বেশির ভাগ ছবি হোক বাংলা।
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের অবাঙালি আমলারা তাতে কিছুতেই রাজি হতে চাইলেন না। আলোচনা অসমাপ্ত রইল। ওই দিন রাতেই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে দুই দেশের প্রতিনিধিদল এক ভোজসভায় মিলিত হয়। তাতে মুম্বাই ও কলকাতার অনেক চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রী আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। মুম্বাইয়ের চিত্রপরিচালকদের মধ্যে ছিলেন শক্তি সামন্ত এবং কলকাতার অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন যত দূর মনে পড়ে উত্তম কুমার, তরুণ কুমারসহ আরো অনেকে।
এই ভোজসভায় শক্তি সামন্ত বেসরকারি প্রস্তাব তুললেন, বাংলাদেশে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য তিনি এবং মুম্বাইয়ের আরো কিছু শিল্পপতি মিলে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও থানা শহরে (তখন উপজেলা হয়নি) একটি করে সিনেমা হল তৈরি করে দেবেন। বাংলাদেশকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। তবে শর্ত এই যে এই সিনেমা হলগুলোতে নূ্যনপক্ষে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর কেবল মুম্বাইয়া ছবি দেখাতে হবে। এইভাবে মুম্বাইয়ের শিল্পপতিরা তাঁদের লগি্নকৃত টাকাটা তুলে নেবেন এবং সিনেমা হলগুলোর মালিকানা সরকারিভাবে বাংলাদেশের হবে। সরকার ইচ্ছে করলে সেগুলো বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করবে।
এই প্রস্তাব শোনার পর আমার আর সহ্য হয়নি। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, সামন্ত বাবু, আপনার এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা পাবে না, বাংলা ছবিও তৈরি হবে না। তৈরি হবে মুম্বাইয়া ছবির (তখনো বোম্বাই নামটি বদল করা হয়নি) একচেটিয়া বাজার। আপনার কি ধারণা, বালাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষার জন্য যে আত্মদান করেছে, উর্দুর একাধিপত্য রোধ করার জন্য দীর্ঘকাল যে সংগ্রাম করেছে, তা সবই করেছে বাংলাদেশে হিন্দি ভাষা ও বোম্বাইয়া ব্যবসায়ীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য? এরপর ভোজসভায় এ নিয়ে আর কথা ওঠেনি।
ভোজসভার পর উত্তম কুমার ও তরুণ কুমার আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তরুণ কুমার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'দাদা, আপনার কাছে আমরা কলকাতার অভিনয়শিল্পীরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; শক্তি সামন্তের মুখের ওপর সত্যি কথা বলার জন্য। কলকাতায় বাংলা ছবিও আজ হতমান। পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ছায়াছবি_সব কিছু হিন্দির আগ্রাসনে বিপন্ন। আপনারা বালাদেশে এই আগ্রাসন রুখুন, আমাদেরও বাঁচান।'
কলকাতা-বৈঠক অসমাপ্তভাবে শেষ হয়েছিল। আমি ঢাকায় ফিরে এসে সব কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলাম। তিনি আমাদের প্রতিনিধিদলের ভূমিকায় খুশি হয়েছিলেন। জানি না, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন এবং বাংলাদেশে মুম্বাইয়া ছবি এবং এর অপসংস্কৃতির দাপট দেখতেন, তাহলে কী ভাবতেন বা কী করতেন?
ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়েও দিলি্লর চাণক্যপুরীর একই খেলা আমরা দেখেছি। তখনো দিলি্ল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্বার্থ ও অধিকারের ধুয়া তুলেছিল। বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা না হলে এবং বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের দিকে অবাধে পানিপ্রবাহ গড়ালে হুগলি নদীর নাব্যতা একেবারেই কমে যাবে এবং কলকাতা বন্দর ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং রাজ্য সরকারের সম্মতি না নিয়ে গঙ্গার পানির মীমাংসা করা দিলি্লর পক্ষে সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বামফ্রন্ট সরকার দিলি্লর এ যুক্তিতে সম্ভবত প্রথমে প্রতারিত হয়েছিল। পরে তারা দেখতে পায়, বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়ার জন্য এটা দিলি্লর চাণক্যপুরীর কূটকৌশল। হুগলি নদীর নাব্যতা এবং কলকাতা বন্দর রক্ষার নামে বাংলাদেশকে যে পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল, সেই পানি গঙ্গা থেকে বিভিন্ন লিংক ক্যানাল (সংযোগকারী খাল) কেটে বিহার ও উত্তর প্রদেশে মরুমাটি সরস করে কৃষিকাজ উন্নয়নের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। দিলি্লতে তাঁদের সমর্থনে গঠিত দেব গৌড়া মন্ত্রিসভার সময় তিনি বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার ব্যাপারে সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে বিশেষ করে জ্যোতি বসুর সমর্থন লাভে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
বর্তমানে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ঢাকা বৈঠকে যে কাণ্ডটি হয়ে গেল এর পেছনেও দিলি্লর চাণক্যপুরীর খেলা রয়েছে বলে শুধু আমার নয়, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদেরও অনেকেরই ধারণা। দিলি্লর বর্তমান মনমোহন সরকার, বিশেষ করে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশের প্রতি মমতা ও সমর্থন কম নয়। বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেই শেখ হাসিনার কাছে সোনিয়া গান্ধীর চিঠি পাঠানো এর প্রমাণ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই এবং তাঁর দ্বিতীয় দফার সরকার শেষ পর্যন্ত নানা অভিযোগে অভিযুক্ত একট দুর্বল ও আমলাতন্ত্রনির্ভর সরকার বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনে এই সরকার কতটা রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখতে পারবে তা এখনো বিতর্কের বিষয়।
দেখেশুনে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল-মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয় দিলি্লর চাণক্যপুরীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, অথবা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে পড়েছেন। তাঁর জেদ দূর করার ব্যাপারে ঢাকা এবার সজাগ ছিল না এবং কোনো আগাম উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। এ জন্যও অনেকটা দায়ী ঢাকারও আমলা-উপদেষ্টার ওপর একক নির্ভরতা এবং বিদেশ মন্ত্রককে এড়িয়ে চলা। ভারত আমাদের যতই বন্ধুরাষ্ট্র হোক, তার চাণক্যপুরীর অনেক খেলার কথাই বাংলাদেশের অজানা নয়। সুতরাং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নত করার ব্যাপারেও বাংলাদেশের বিদেশনীতি সবল ও প্রাগমেটিক হওয়া দরকার। শেখ হাসিনা জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি কেন বিদেশনীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে আমলা-উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভর করতে চান তা আমার বোধগম্য নয়। (সমাপ্ত)
লন্ডন ১০ অক্টোবর, সোমবার ২০১১
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা মনে করলেন এখন আর তাঁদের পায় কে? বাংলাদেশে তাঁদের হিন্দি ছবি পপুলার। তা ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখনো গড়ে ওঠেনি। সুতরাং সহজেই এই বিশাল বাজার তাঁরা দখল করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো এর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু সজাগ ও সতর্ক ছিলেন। তিনি মুম্বাইয়া হিন্দি ছবি যাতে অবাধে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য এ ব্যাপারে বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ছায়াছবিকেও আনার ব্যবস্থা করেন।
ছায়াছবিসংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পর্কে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বৈঠকটি হয় ১৯৭৪ সালে কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। বাংলাদেশের টিমে আমি একজন বেসরকারি সদস্য ছিলাম। ভারত থেকে বাংলাদেশে ছবি আনার কোটা নির্ধারণ এবং বাংলাদেশ থেকেও ভারতে ছবি রপ্তানির সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে এ বৈঠকে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে দিলি্লতে চুক্তিটি হবে। আমাদের সমস্যা ছিল, বাংলাদেশ থেকে যত ছবি আমরা ভারতে পাঠাতে চাই, তত সংখ্যক ছবি তখন ঢাকায় নির্মিত হচ্ছিল না। বাংলাদেশের মফস্বল শহরে তখন সিনেমা হলের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। চাহিদামতো ছবির অভাবে পুরনো হিন্দি ছবি তাতে তখন দেখানো হচ্ছিল। কিছু ইংরেজি ছবিও।
কলকাতা বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিরা যে প্রস্তাব তুললেন, তাতে মুম্বাইয়া হিন্দি ছবিই বারো আনা পাঠানোর কথা বলা হলো। তাতে বাংলা, ওড়িয়া, তামিল ভাষার ছবিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তবে সংখ্যায় খুবই কম। অন্যদিকে ঢাকা থেকে পাঠানো বাংলা ছবির জন্য মান পরীক্ষার শর্ত যুক্ত করা হলো। আমরা এ প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমাদের প্রস্তাব ছিল, ভারত থেকে ছবি আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশ অসম্মত নয়। কিন্তু মুম্বাইয়া হিন্দি ছবির বদলে কলকাতার বাংলা ছবি বেশি পাঠাতে হবে। কারণ বাংলাদেশ মুখ্যত বাংলাভাষী দেশ।
১৯৭৪ সালের সেই বৈঠকেও ভারত ২০১১ সালের তিস্তা বৈঠকের মতো আপত্তি তুলে বলেছিল, বাংলাদেশে বাংলা ছবি পাঠানোকে প্রাধান্য দেওয়া হলে ভারতের অন্য রাজ্যগুলো আপত্তি তুলবে। তারা বলবে, বাংলাদেশের সঙ্গে ছায়াছবিসংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তিতে তাদের প্রতি দিলি্লর কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য করেছে। আমরা বলেছি, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের যেমন আসাম, ওড়িশা, মাদ্রাজ, তামিলনাড়ুরও দু-একটি ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু বেশির ভাগ ছবি হোক বাংলা।
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের অবাঙালি আমলারা তাতে কিছুতেই রাজি হতে চাইলেন না। আলোচনা অসমাপ্ত রইল। ওই দিন রাতেই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে দুই দেশের প্রতিনিধিদল এক ভোজসভায় মিলিত হয়। তাতে মুম্বাই ও কলকাতার অনেক চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রী আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। মুম্বাইয়ের চিত্রপরিচালকদের মধ্যে ছিলেন শক্তি সামন্ত এবং কলকাতার অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন যত দূর মনে পড়ে উত্তম কুমার, তরুণ কুমারসহ আরো অনেকে।
এই ভোজসভায় শক্তি সামন্ত বেসরকারি প্রস্তাব তুললেন, বাংলাদেশে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য তিনি এবং মুম্বাইয়ের আরো কিছু শিল্পপতি মিলে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও থানা শহরে (তখন উপজেলা হয়নি) একটি করে সিনেমা হল তৈরি করে দেবেন। বাংলাদেশকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। তবে শর্ত এই যে এই সিনেমা হলগুলোতে নূ্যনপক্ষে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর কেবল মুম্বাইয়া ছবি দেখাতে হবে। এইভাবে মুম্বাইয়ের শিল্পপতিরা তাঁদের লগি্নকৃত টাকাটা তুলে নেবেন এবং সিনেমা হলগুলোর মালিকানা সরকারিভাবে বাংলাদেশের হবে। সরকার ইচ্ছে করলে সেগুলো বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করবে।
এই প্রস্তাব শোনার পর আমার আর সহ্য হয়নি। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, সামন্ত বাবু, আপনার এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা পাবে না, বাংলা ছবিও তৈরি হবে না। তৈরি হবে মুম্বাইয়া ছবির (তখনো বোম্বাই নামটি বদল করা হয়নি) একচেটিয়া বাজার। আপনার কি ধারণা, বালাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষার জন্য যে আত্মদান করেছে, উর্দুর একাধিপত্য রোধ করার জন্য দীর্ঘকাল যে সংগ্রাম করেছে, তা সবই করেছে বাংলাদেশে হিন্দি ভাষা ও বোম্বাইয়া ব্যবসায়ীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য? এরপর ভোজসভায় এ নিয়ে আর কথা ওঠেনি।
ভোজসভার পর উত্তম কুমার ও তরুণ কুমার আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তরুণ কুমার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'দাদা, আপনার কাছে আমরা কলকাতার অভিনয়শিল্পীরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; শক্তি সামন্তের মুখের ওপর সত্যি কথা বলার জন্য। কলকাতায় বাংলা ছবিও আজ হতমান। পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ছায়াছবি_সব কিছু হিন্দির আগ্রাসনে বিপন্ন। আপনারা বালাদেশে এই আগ্রাসন রুখুন, আমাদেরও বাঁচান।'
কলকাতা-বৈঠক অসমাপ্তভাবে শেষ হয়েছিল। আমি ঢাকায় ফিরে এসে সব কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলাম। তিনি আমাদের প্রতিনিধিদলের ভূমিকায় খুশি হয়েছিলেন। জানি না, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন এবং বাংলাদেশে মুম্বাইয়া ছবি এবং এর অপসংস্কৃতির দাপট দেখতেন, তাহলে কী ভাবতেন বা কী করতেন?
ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়েও দিলি্লর চাণক্যপুরীর একই খেলা আমরা দেখেছি। তখনো দিলি্ল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্বার্থ ও অধিকারের ধুয়া তুলেছিল। বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা না হলে এবং বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের দিকে অবাধে পানিপ্রবাহ গড়ালে হুগলি নদীর নাব্যতা একেবারেই কমে যাবে এবং কলকাতা বন্দর ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং রাজ্য সরকারের সম্মতি না নিয়ে গঙ্গার পানির মীমাংসা করা দিলি্লর পক্ষে সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বামফ্রন্ট সরকার দিলি্লর এ যুক্তিতে সম্ভবত প্রথমে প্রতারিত হয়েছিল। পরে তারা দেখতে পায়, বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়ার জন্য এটা দিলি্লর চাণক্যপুরীর কূটকৌশল। হুগলি নদীর নাব্যতা এবং কলকাতা বন্দর রক্ষার নামে বাংলাদেশকে যে পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল, সেই পানি গঙ্গা থেকে বিভিন্ন লিংক ক্যানাল (সংযোগকারী খাল) কেটে বিহার ও উত্তর প্রদেশে মরুমাটি সরস করে কৃষিকাজ উন্নয়নের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। দিলি্লতে তাঁদের সমর্থনে গঠিত দেব গৌড়া মন্ত্রিসভার সময় তিনি বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার ব্যাপারে সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন। অবশ্য এ ব্যাপারে বিশেষ করে জ্যোতি বসুর সমর্থন লাভে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
বর্তমানে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ঢাকা বৈঠকে যে কাণ্ডটি হয়ে গেল এর পেছনেও দিলি্লর চাণক্যপুরীর খেলা রয়েছে বলে শুধু আমার নয়, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদেরও অনেকেরই ধারণা। দিলি্লর বর্তমান মনমোহন সরকার, বিশেষ করে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশের প্রতি মমতা ও সমর্থন কম নয়। বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেই শেখ হাসিনার কাছে সোনিয়া গান্ধীর চিঠি পাঠানো এর প্রমাণ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই এবং তাঁর দ্বিতীয় দফার সরকার শেষ পর্যন্ত নানা অভিযোগে অভিযুক্ত একট দুর্বল ও আমলাতন্ত্রনির্ভর সরকার বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনে এই সরকার কতটা রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখতে পারবে তা এখনো বিতর্কের বিষয়।
দেখেশুনে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল-মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয় দিলি্লর চাণক্যপুরীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, অথবা রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে পড়েছেন। তাঁর জেদ দূর করার ব্যাপারে ঢাকা এবার সজাগ ছিল না এবং কোনো আগাম উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। এ জন্যও অনেকটা দায়ী ঢাকারও আমলা-উপদেষ্টার ওপর একক নির্ভরতা এবং বিদেশ মন্ত্রককে এড়িয়ে চলা। ভারত আমাদের যতই বন্ধুরাষ্ট্র হোক, তার চাণক্যপুরীর অনেক খেলার কথাই বাংলাদেশের অজানা নয়। সুতরাং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নত করার ব্যাপারেও বাংলাদেশের বিদেশনীতি সবল ও প্রাগমেটিক হওয়া দরকার। শেখ হাসিনা জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি কেন বিদেশনীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে আমলা-উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভর করতে চান তা আমার বোধগম্য নয়। (সমাপ্ত)
লন্ডন ১০ অক্টোবর, সোমবার ২০১১
No comments