সহজ-সরল-আমার কাছে চিকিৎসক ও ধ্যানী যোগী সমার্থক শব্দ by কনকচাঁপা
প্রশ্ন আছে-ডিম আগে না মুরগি আগে? বিজ্ঞান বলেছে ডিম আগে। তাই সই। কিন্তু আমাদের সাধারণের মনে 'মনে হয়' ডিমের লেজে মুরগি-মুরগির লেজে ডিম। চিন্তা করতে যাঁদের অলসতা তাঁরা ভাবেন দুর ছাই! ডিম আগে এলেই কী মুরগি পাছে এলেই কী-দুটো একসঙ্গে খেতে পারলেই হলো। আহা, আমিও যদি এমন ভাবতে পারতাম। তবে কি আমি চিন্তাবিদ? উঁহু, মোটেই না। আমি ভীতুর ডিম। এ দেশের অরাজকতা দেখে দেখে রেগেমেগে অগি্নশর্মা না হয়ে ভয়ে
কুঁকড়ে যাচ্ছি। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা-তার প্রশ্নপত্র ফাঁস! আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্রদের সেরাদের সেরারাই এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। পড়তে পড়তে চোখের আগায় চশমা বাসা বাঁধে। বই আর মা ছাড়া কিছু চেনেন না এই পৃথিবীর। তাঁদের মতো ছাত্রদের প্রশ্ন ফাঁস হতে হবে কেন? তাঁরা কি পড়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন? হায় আল্লাহ-তাঁরা যদি না পড়াশোনা করেন ডাক্তার হয়ে তো মাথা ব্যথার স্থানে চোখ ব্যথার ওষুধ দেবেন-ফোঁড়া কাটতে গিয়ে পায়ের রগ কেটে ফেলবেন। কী ভয়ংকর! আমার প্রশ্ন, যারা ফাঁস করার জন্য প্রশ্নপত্র ছাপাল, তারা আগে দোষী না যারা সেই প্রশ্ন নেওয়ার জন্য ভুয়া প্রশ্ন তৈরির মানুষগুলোর কাছে ধরনা দিল তারা আগে দোষী? দোষী যে দুই পক্ষই তা তো বোঝাই যাচ্ছে; কিন্তু কারা বেশি দোষী তা সঠিকভাবে জানতে ইচ্ছা হয়। আর খুবই আশ্চর্য হই এই ভেবে, একটা ছাত্রছাত্রী তখনই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেন যখন তাঁরা ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি বিষয়ে ১০০-তে ১০০ পান। প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম-দ্বিতীয় হন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান-এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পান, নিদেনপক্ষে এ প্লাস পান। তো এ রকম ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক সারা জীবন এত খাটনি করে একটা কঠিন সাধনায় রত থেকে (মা-বাবার সাধনাই তো) শেষমেশ ঘরের পৈঠায় এসে আছাড় খাবেন? এ তো মানবতার অপমান! এর চেয়ে বড় কোনো অপমান নিজে নিজেকে করা যায়, আমার জানা নেই। এর চেয়ে ভয়ংকর লাগছে একটা কথা-১০ লাখ টাকা, ছয় লাখ টাকা দিয়ে শুধু ভর্তির প্রশ্ন। বাকি বছর পড়াশোনা-কোচিং-নোট-কাপড়চোপড়-ইন্টার্নির পর আরো পড়াশোনার পর প্র্যাকটিস সব মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকা যদি একজন ছাত্রের পেছনে যায়, সে মা-বাবা তো চাইবেনই সন্তান ক্লিনিকে বসেই দুহাতে সেই টাকা কামিয়ে মা-বাবার ঋণ পরিশোধ করে-তারপর নিজের বাড়ি, গাড়ি, বিয়ে, ব্যাংক, খামারবাড়ি এবং পরিশেষে তৃপ্ত একটা জীবন পাবে। তো ডাক্তার হয়ে সেবা? কখন করবেন? তিনি কি কোনো দরিদ্র রোগী দেখে ফি নেওয়া বাদ দিতে পারবেন? নিজেই তো তাঁর পেশার কাছে বার্ষিক ইজারা উসুলে প্রাণান্তকর কসরতে রত। তখন তাঁকে ডাক্তার হয়েও খুনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এ জীবনে খাটানো টাকা তাঁকে তুলতেই হবে! কিন্তু হে হবু চিকিৎসকরা, আপনারা জানেন কী আমাদের দেশে নানা পেশার মানুষের মধ্যে ডাক্তারদের এখনো যে কী সম্মান? তা বলে বোঝানো যাবে না। স্রষ্টা তাঁদের হাত দিয়েই তো আমাদের সুস্থ রাখেন, প্রাণভিক্ষা দেন। প্রাইভেট কলে একজন ডাক্তার বাড়ি এলে তাঁর ব্যাগটি আমরা কিছুতেই তাঁকে বইতে দিই না-জাতিগতভাবেই। আবার তাঁকে ব্যাগ বহন করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছে দিই কেন? এ সম্মান তাঁর প্রাপ্য। অ্যাপ্রোন পরা একজন ডাক্তার আমাদের কাছে একজন মুনি-ঋষির মতো। ধ্যানী কিন্তু সর্বদা জাগ্রত আমাদের সেবায়। সে সম্মান, ভালোবাসা তাঁরা তাঁদের পারঙ্গম ক্ষমতা দিয়েই আদায় করে নেন। কিন্তু ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পাস করা ডাক্তার তাঁদের ডিগ্রির সমাহারের পাশে কি (প্রশ্নপত্র ফাঁস গ্রুপ) এমন লেখা থাকবে? তা তো থাকবে না। তখন? খোলা গর্তের চেয়ে চোরাবালি কি বেশি ভয়ংকর নয়? কি দরকার বাবা? সারা বছর, সারা জীবন এত ফার্স্ট হওয়া, এত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, শেষমেশ এই পরীক্ষায় একটু খেটেখুটে পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেই কি ভালো না! কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মানে শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের খাতায় নাম ওঠানো না-নিজের কাছেও উত্তীর্ণ হওয়া। নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে না দিতে পারলে নিজের কাছে উত্তীর্ণ হওয়া যায় কী? আমাদের 'জীবনের লক্ষ্য' রচনায় আমরা কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, এমন অনেক লেখাই লিখেছি। তার সঙ্গে আরো লিখেছি আমরা দেশসেবা কর, সত্যবাদী হব, বিনয়ী হব। ওই রচনাগুলো যাঁরা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাঁরা কিন্তু তাঁদের ওই কল্পিত রূপরেখাতেই ভবিষ্যতে আমাদের চিত্রিত করতে চেয়েছেন। শুধু মুখস্থ করে নম্বর পাওয়ার জন্য তাঁরা এই লেখাগুলো লেখেননি। আমরা কি অপ্রয়োজনীয় কোচিং সেন্টারে না দৌড়াদৌড়ি করে পাঠ্য বইগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে, যথার্থই সেই মতো জীবন আঁকতে পারি না?
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments