আরেক আলোকে-অতঃপর উপদেষ্টা সমাচার by ইনাম আহমেদ চৌধুরী

পদ্মা সেতু নিয়ে নাটকের যেন আর শেষই হচ্ছে না। বরং মঞ্চে নতুন নতুন দৃশ্যপটের অবতারণা ও পরিবর্তন হচ্ছে। কিছুকাল আগে আমি সমকালেই লিখেছিলাম 'পদ্মা হঠাৎ অনেক দূর'। এখন পদ্মা, হনুজ দূর অস্ত_ আরও অনেক দূর। গতকাল তো প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেই দিলেন_ এই সরকার আমলে পদ্মা সেতু হবে না,


এমনকি বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করলেও। এটা অনস্বীকার্য যে, নিজস্ব সম্পদে বা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক শর্তাধীনে এই সেতু নির্মাণ দেশকে এমন ফাঁদে ও ঋণ-আবর্তে নিক্ষেপ করবে, যা থেকে বহুকাল নিষ্কৃতি হবে না এবং যার জন্য আগামী বহু প্রজন্ম শুধু অর্থকষ্টই পাবে তা নয়, আমাদের বর্তমান কর্তাদের অভিশাপই দিতে থাকবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঋণদান প্রক্রিয়াকে অদ্ভুতভাবে ঘোলা করে একে অবিশ্বাস্য এক জটিলতায় ফেলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সম্পাদন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তারপরও হঠাৎ করে পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল প্রকল্পে ব্যতিক্রমী অবস্থার কেন সৃষ্টি হলো?
আমি যখন ইআরডি সচিব ছিলাম, তখন যমুনা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে সমঝোতা, দর কষাকষি করতে হয়েছে এবং আমি নির্ভয়ে ও নিদ্বর্িধায় বলতে পারি, ঋণদাতাদের সঙ্গে চুক্তি শুধু নির্বিঘ্নে স্বাক্ষরই নয়, প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়েছে। সেটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ ঋণ চুক্তি ও মেগা প্রকল্প। সেই অভিজ্ঞতার রেশ ধরে আমার ধারণা ছিল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে আরও ভালোভাবে, বুঝেশুনে ও দেশের স্বার্থ অনুকূল রেখে কাজ করতে পারবে। কিন্তু হা-হতোস্মি! সরকার কী খেলাই না দেখাল!
প্রি-টেন্ডার পর্যায়ে যখন দুর্নীতির 'নির্ভরযোগ্য' অভিযোগ পেয়ে বিশ্বব্যাংক কয়েকটি শর্ত আরোপ করল, তখন যুগ্মভাবে এসব তদন্ত করে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে অনায়াসে পেঁৗছা যেত! তা না করে 'ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না' জাতীয় অবস্থান নিয়ে একের পর এক বিয়োগান্ত ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে সরকার। আমার মনে হয় না বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো অপমানজনক ছিল; বরং দুর্নীতি পরিহার জরুরি ছিল। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক একাধিক বিস্তৃত চিঠিও দিয়েছে। এগুলো আমলে নিয়ে তদন্তের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করে তুললে কী ক্ষতি হতো! সরকারের পক্ষে বারবারই বলা হচ্ছে যে দুর্নীতি হয়নি। দুর্নীতির সন্দেহ করা হয়েছে মাত্র। যে কোনো অপরাধের তদন্ত তো সন্দেহ দিয়েই শুরু হয়!
শেষ বেলায় এসে শর্ত মানা হলো বটে; শেষ রক্ষা বোধ হয় হলো না। গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, উপদেষ্টা মসিউর রহমান যেতে চাচ্ছেন না। তিনি বরং এক অর্থে সরকারের জন্যই আরও বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। রেখেঢেকে হলেও সাংবাদিকদের কাছে তো তেমন কথাই বলছেন। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে বহুবার পদত্যাগ করতে রাজি আছি, তাতে যদি পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়। কিন্তু দিলি্লফেরত হয়ে তার কণ্ঠে দেখছি আরেক সুর! এটা কী জন্য হলো বোঝা যাচ্ছে না।
প্রকাশ, দিলি্লর প্রতি আমাদের এই উপদেষ্টার অহেতুক দুর্বলতা আছে। আমাদের মনে আছে, তিনি এককালে বলেছিলেন_ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রস্তাবিত ট্রানজিটের চার্জ চাওয়া নাকি অসভ্যতা হবে। এমন বক্তব্য নিঃসন্দেহে দেশের স্বার্থবিরোধী। কারণ, এ ধরনের একপক্ষীয় সুবিধা প্রদান দ্বিপক্ষীয় গৃহীত ব্যবস্থায় থাকা অবিশ্বাস্য। সে যাই হোক, তিনি যদি পদ্মা সেতু প্রশ্নে পতদ্যাগ করা না করার ব্যাপারে দিলি্ল থেকেই মন্ত্রণা পেয়ে থাকেন তাহলে বলব, এই অবস্থান আর যাই হোক, দেশের স্বার্থের অনুকূল হয়নি।
উপদেষ্টা মসিউর রহমানের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং বহিঃসম্পদ বিভাগে কাজ করার (ইআরডি) দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তিনি যদি সমালোচিত মঞ্চ থেকে সরে যেতেন, তাহলে কারও কোনো সন্দেহ থাকত না। তদন্তে আসল সত্য দেশবাসী জানতে পারত। এখন যখন সরতে চাচ্ছেন না, সন্দেহ তো ঘনীভূতই হবে। তিনি কি দেখেননি সময়ের এক সমালোচনায় সাড়া দিয়ে সরে দাঁড়ালে, অসময়ের দশ সমালোচনার ভার বইতে হয় না। মসিউর রহমানের বোঝা উচিত যে, বিশ্বব্যাংকের ওপর দোষারোপ করে বা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে আসলে দাতা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে একটি গ্রহীতা দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিই কেবল ঘটানো হচ্ছে।
মসিউর রহমান যেভাবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তুলেছেন, তাও কিন্তু কম গুরুতর নয়। আমি যতদূর বুঝি, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান এই অভিযোগ সহজভাবে নেবে না। এখন নিশ্চয়ই সরকারও বুঝতে পেরেছে যে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কর্তাব্যক্তিদের ঢালাও সমালোচনা পরিস্থিতির অবনতিতেই সহায়তা করেছে। ড. রহমান এর মধ্য দিয়ে যে কেবল বিশ্বব্যাংককে অভিযুক্ত করেছেন তা নয়। সরকারও কিন্তু ছাড় পায় না। তার অভিযোগের বিটুইনস দ্য লাইন হচ্ছে, সরকারের মধ্যেই রয়েছে বিশ্বব্যাংকের গুপ্তচর। কথিত গুপ্তচররা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে না থাকলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচার করা সম্ভব নয়। এক উপদেষ্টার এ ধরনের অবস্থান ও বক্তব্য অবশ্যই দেশের স্বার্থবিরোধী। এতে শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্প নয়, বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর সব প্রকল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এই অবনমিত সম্পর্কের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব উন্নয়ন প্রকল্পেই পড়তে পারে। কেননা এসবের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা ধরে নিতে পারে যে সরকার দুর্নীতিবান্ধব।
সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে যদিও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল পদ্মা সেতু সংক্রান্ত সম্ভাব্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগের ভিত্তিতে। কিন্তু কয়েক দিন আগে তারই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের (অভিযোগের অঙ্গুলি তো প্রতিষ্ঠানের দিকে) আরেকজন কর্তাব্যক্তিকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হলো। এখন এই কারণে যদি বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের আন্তরিকতার অভাব দেখতে পায়, তাহলে কি দোষ দেওয়া যাবে?
বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত দিচ্ছে মনে রাখতে হবে সবই হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধের খাতিরে। আমরাও দেখছি দেশে বর্তমানে যে ধরনের দুর্নীতি চলছে, তা অবিশ্বাস্য। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্র আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। আমি এর তালিকা ক্ষুদ্র নিবন্ধে দিতে চাইছি না। কারণ সেই তালিকা সবারই জানা। আমরা প্রশাসন, ব্যাংকিং, যোগাযোগ, রাজস্ব, শিক্ষা_ এমনকি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বেমালুম দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে ফেলেছি। এখন যদি দাতারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে, অস্বাভাবিক হবে?
এই অবস্থায় যেখানে দুর্নীতিকরণের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে (বিশ্বব্যাংক ও কানাডা সরকারের কাছে) সেখানে অনর্থক, জেদি, একগুঁয়ে, আত্মবিধ্বংসী আচরণের কোনো মানে নেই। যদি উপদেষ্টা মসিউর রহমান ছুটিতে যেতেন, অসুবিধা কী হতো! যদি তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হতেন, তাহলে সসম্মানে ফিরে আসতে পারতেন। কেন সুযোগটা নিলেন না!
এটা হয়তো ঠিক, তিনি ছুটিতে গেলেই বিশ্বব্যাংক মনে করবে বাংলাদেশ দুর্নীতিবিরোধী, সেটা নয়। দুর্নীতি নিয়ে, জিরো টলারেন্স নিয়ে আমাদের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যা বলেছেন, তা থেকে সরকারকে দুর্নীতিবান্ধব মনে হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে অন্তত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, সরকারের অবিবেচক অবস্থানের কারণে জনগণ তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে।
কেবল কি বঞ্চনা? নিরুপায় শিক্ষামন্ত্রী যখন সিলেটে ভস্মীভূত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখে চোখের পানি ফেলেন; প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা যখন ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ভয় পান, তখন জনগণের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া ওপায় থাকে না।

ইনাম আহমেদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.