অসময়ের গান by আজিজুস সামাদ আজাদ

রাজনীতি একটি প্রবহমান নদী। এ নদীর স্রোতধারা বিভিন্ন মুখী এবং এই বিভিন্ন মুখী স্রোতধারার কারণে এর গতিপথও পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনশীল প্রবহমান নদীর পথ পরিবর্তনে সক্ষম স্রোতসমূহ শুধু যে সমান্তরাল ধারায় বয়ে চলবে তা নয়, এখানে মুখোমুখি স্রোত, তলদেশের স্রোত, গভীর তলদেশের স্রোতসহ বিভিন্ন মুখী স্রোত


প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রত এবং যার যার অস্তিত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্যে, স্রোতসমূহ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে আর দাবার ছকে বাঁধা এ রাজনীতির খেলায় দিয়ে চলে চাল ও প্রতিচাল। রাজনীতির স্রোতধারা নীতিনির্ধারক শক্তির কেউ যদি মনে করে যে সে একাই চাল দিয়ে যাবে আর প্রতিপক্ষ তার দাবার ঘুঁটি এবং শক্তি ছকে সাজিয়ে বসে থাকবে, তবে সে বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। বর্তমানে জাতীয়-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্রোতধারার আপেক্ষিক প্রতিপক্ষ-বন্ধুপক্ষ যেই হোক না কেন, চালের বিপরীতে শুধু চালই দেবে না, সে চাল দেওয়ার কারণে প্রতিপক্ষের মনে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াও পর্যবেক্ষণ করবে।
জাতীয় রাজনীতিতে নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিতে যেমন কোনো পক্ষই রাজি নয়, তেমনি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নিজ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সিদ্ধান্ত কোনো পক্ষই নেবে না। রাজনীতির প্রবহমান এই স্রোতধারায় কোনো একটি ঢেউ একদমই মূল্যহীন। এখানে নিজ পক্ষের বড় ঢেউগুলোর একটি-দুটি যদি চেষ্টা করে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করতে, তবে সে হয়তো ক্ষণিকের তরে স্রোতের শক্তি কিছুটা কমিয়ে দিতে পারবে; কিন্তু তাও অল্প সময়ের জন্য, তারপর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। স্রোতধারা তৈরির নিয়ামক শক্তির বিপরীতে যদি কোনো ঢেউ কখনো সিদ্ধান্ত নিতেই চায়, তবে তাকে স্রোতধারার বাইরে বলেই ধরে নিতে হবে।
রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই; প্রবাদটি দেশীয় রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে, উপমহাদেশীয় রাজনীতির সীমান্ত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সর্বজনস্বীকৃত। গত প্রায় চার দশকের উপমহাদেশীয় রাজনীতির ইতিহাস বেশ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। এমনকি শুধু বাংলাদেশকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়-আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্রোত ও পাল্টা স্রোতের মধ্যে যে খেলা চলছে এবং সে খেলার ফলে সবার চিন্তা-চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছে, সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় খুঁজতে নমনীয় বা করুণা ভিক্ষারও যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি কোনো পক্ষকে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্ভট চিন্তায় সময় নষ্ট না করে কূটনীতির সব দরজা-জানালা খুলে দেওয়া প্রয়োজন। একটি দেশের যেকোনো কাজের সফলতার পেছনে কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন_১. জনসমর্থন; ২. অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা; ৩. অর্থনৈতিক ও কারিগরি সক্ষমতা; ৪. জাতীয় নীতিনির্ধারক ও চালিকাশক্তিগুলোর সমন্বয় এবং ৫. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব ইত্যাদি। এসব ফ্যাক্টরের ৭৫ শতাংশ পক্ষে থাকলে একটি জাতি সফল হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারবে, আর সবই যদি পক্ষে থাকে, তবে তো কথাই নেই।
আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্রোতের সাংঘর্ষিক অবস্থান সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে। এর মধ্যে কিছু ঢেউ নিজেকে খুব শক্তিশালী ভেবে বা অন্য কোনো ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে নিজের স্রোতের গতিধারা বদলানোর চেষ্টা শুরু করে। প্রতিটি সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা থাকে। সফলতার পাল্লা ভারী হলে নিজ স্রোতের নিয়ামক শক্তির সিদ্ধান্ত মেনে সবার এগিয়ে যাওয়া উচিত। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের আধিভৌতিক অবস্থানের কারণে সরকারের পচা শামুকে পা কাটার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাজারের দরপতন, ডেসটিনি, ইউনিপেটু, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সরকারের কোনো সংযোগ না থাকলেও সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারাকে বিরোধীপক্ষ সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। ড. ইউনূস ও পদ্মা সেতু নিয়ে সময়মতো সব পক্ষের জন্য সম্মানজনক সমাধান না করতে পারায় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেখানে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়নি সেখানে বিশ্বব্যাংকের আনা দুর্নীতির অভিযোগ মোকাবিলায় সরকারের একটি অংশের অনাগ্রহ বা ব্যর্থতা সুস্পষ্ট। অথচ বিএনপি শাসনামলে ডেনিশ রাষ্ট্রদূত যখন সাক্ষ্য-প্রমাণসহ সেই সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সব সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখনো এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি সে সময়কার সরকারের জন্য তৈরি হয়নি।
সরকারি দলের সাংগঠনিক কাঠামো এ মুহূর্তে কোনো বিষয়ে জনমত সংগঠিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী কি না, সেটা নিয়ে ভাবার সময় এখনই। তবে সরকারের ব্যর্থতা যা-ই হোক না কেন, ঘুরেফিরে দেখা যাবে যে বর্তমান সরকারের সব ব্যর্থতার মূলে আছে দু-একটি মন্ত্রণালয়ের খুবই স্থানীয় কিছু সমস্যা। সুতরাং মন্ত্রিসভায় রদবদল করে সরকারের ধমনি-শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আশা করি জাতিকে নতুন দিনের গান শোনাতে পারবে। কিন্তু এই বেলা শেষের অসময়ের গানকে পূরবী রাগের বিরহের সুরে না বাজিয়ে ভৈরবী রাগে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষার সুর সবার হৃদয়ে সঞ্চালিত করে, মৃদু দুন্দুভীর শৌর্য যুক্ত করতে পারলে হয়তো পরিপূর্ণতা পাবে এই প্রচেষ্টা। তখনই আমরা সবাই কবিগুরুর ভাষায় বলতে পারব, 'না জানি কেনরে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ'। নয়তো কবিগুরুর ভাষায়ই বলতে হবে '...এ কাননে এলে অসময়ে; কালিকার গান আজি আছে মৌনী হয়ে'।
লেখক : রাজনীতিক

No comments

Powered by Blogger.