বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ না হলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না- সেমিনারে ড. মিজানুর

মানবাধিকার প্রশ্নে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে বিচারবহির্ভূত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।


তিনি বলেন, ২০০৯ সালে জাতিসংঘ দেয়া ৪২টি প্রস্তাবের মধ্যে যে ৩৫টি প্রস্তাব বাংলাদেশ মেনে নিয়েছিল তার মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও অপূর্ণতা রয়ে গেছে।
মানবাধিকার বিষয়ক দুদিনের সেমিনার শেষে বুধবার সন্ধ্যায় সোনারগাঁও হোটেলে এসব কথা বলেন তিনি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুইজারল্যান্ডের এ্যাম্বাসেডর আরস হেরিন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। মূল বক্তব্য উপস্থাপন ও সঞ্চালনা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য কাজী রিয়াজুল হক। এ ছাড়া সেমিনারে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনরা বক্তব্য রাখেন।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, ২০০৯ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ৪২টি প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ৩৫টি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সেসব প্রস্তাবের মধ্যে অনেক বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আটকাবস্থায় মৃত্যু। আটকাবস্থায় মৃত্যু শূন্যের কোটায় এনে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল করার আহ্বান জানান তিনি। তা ছাড়া সংখ্যালঘুসহ কিছু কিছু বিষয়ে মানবাধিকার বিষয়ে যে তারতম্য রয়েছে তা কমিয়ে আনার প্রয়োজন। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে মানবাধিকার উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক, সামজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু নাগরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এখনও ব্যর্থতা রয়েছে। তিনি বলেন, মানবাধিকার নিশ্চত করতে হলে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশের প্রয়োজন রয়েছে। যা এখনও নিশ্চত হয়নি।
সুইজারল্যান্ডের এ্যাম্বাসেডর আরস হেরিন বলেন, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে যেসব প্রস্তাব বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, ক্রসফায়ারে মৃত্যুছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ক্রমান্বয়ে আরও উন্নতি হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বলেন, বাংলাদেশের পথচলার সময় অন্য দেশের তুলনায় দীর্ঘ নয়। সে তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি হয়েছে। আস্তে আস্তে আরও উন্নতি হবে বলেও আশা প্রকাশ্য করেন তিনি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরও কার্যকর করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবেন বলে উল্লেখ করেন।
সেমিনারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে দায়দায়িত্ব নেয়ার প্রতি উদাসীনতার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কোন ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। কে আইন বানাচ্ছে আর কে তৈরি করছে, বোঝা যাচ্ছে না। সরকার দায়দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তিনি বলেন, মানবাধিকার কোন বিমূর্ত ধারণা নয়। মানবাধিকার হলো স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির। সেখানে ভয় বা শঙ্কা থাকবে না। সুলতানা কামাল বলেন, এখন কোন বিচারের ব্যাপার জানতে চাইলে কোন কোন মন্ত্রী বলেন, কালই বিচার হয়ে যাবে। যদিও সেটি তাঁর জানার কথা না। আবার কোন বিচারককে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা বলেন, আইনের খসড়া তৈরির কাজ চলছে। এ ব্যাপারটি খুব অদ্ভুত।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, গত তিন বছরে দেশে ১৫৩টি আইন পাস হয়েছে, যার মধ্যে ৭৫টি সংশোধনী আইন। এদের মধ্যে ছয়টি আইন জনগণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কিন্তু বাস্তবায়ন না হলে জনগণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি আরও বলেন, আমেরিকায় ৯৬ ভাগ হত্যার বিচার হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৯০ ভাগ আসামি জামিনে মুক্তি পায়। এমন হলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
অন্য এক সেমিনারে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার বাংলাদেশী মেয়ে পতিতালয়ে রয়েছে। তাদের দেশে আনার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এসব নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, শুধু তা নয়, দেশের এক কোটি নাগরিক দেশের বাইরে থাকে এত বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর জন্য সরকারের উদ্যোগ যথাযথ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এরোমা দত্ত বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন আইন থাকতে পারে না। এমন হলে নারীরাই ভিকটিম হয়। তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে সংসদকে কার্যকর করতে হবে। নির্বাচনে হেরে কোন দল সংসদে না গেলে জনগণের আশার প্রতিফলন ঘটে না। সংসদ অনেক সময় এক দলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দুই দিনব্যাপী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। দুদিনের সেমিনারে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিরা নিজের অভিমত তুলে ধরেন।

No comments

Powered by Blogger.