এমএলএম নাকি হলমার্ক? by প্রভাষ আমিন

প্রিয় পাঠক, আপনারা অনুমতি দিলে আমি একটা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি খুলতে চাই। গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় এমএলএম প্রতারণা রোধে আইন প্রণয়নের পর এ ব্যাপারে আমার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউসহ অনেক কুখ্যাত-অখ্যাত, নামি-বেনামি, জাতীয়-আঞ্চলিক এমএলএম কম্পানির বিরুদ্ধে


সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এসেছে। বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই হাজার কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়ার অভিযোগ আছে, নিদেনপক্ষে শত কোটি টাকা তো হাতিয়েছেই। আমার কম্পানি যদি সবচেয়ে খারাপও হয়, শত কোটি টাকা তো জোগাড় করা যাবে আশা করি। মন্ত্রিসভা যে আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে, তাতে অবৈধ এমএলএম কম্পানির নামে প্রতারণার সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড আর ৫০ লাখ টাকা জরিমানা। ১০০ কোটি টাকা কামিয়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা দিলেও আরো থাকবে ৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যদি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজাও হয়, বাংলাদেশের হিসাবে খাটতে হবে সাড়ে তিন বছর। এমনিতে আমার আচরণ ভালো, কারাগারে সেটা অব্যাহত রাখতে পারলে সাজা আরো কমে যাবে। যদি তিন বছরও জেলে থাকতে হয়, তাহলে আমি সেখানে বছরে ৫০ লাখ করে মোট দেড় কোটি টাকা খরচ করব। টাকা থাকলে নাকি জেলখানা আর বাসার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নাকি আর সবই পাওয়া যায়। গরমে আমার অত কষ্ট হয় না।
এবার আসুন হিসাব মিলাই। জরিমানা দিলাম ৫০ লাখ, তিন বছরে কারাগারে ব্যয় হবে দেড় কোটি। তার মানে তিন বছর কারাভোগ করে মুক্ত মানুষ হওয়ার পরও আমার হাতে থাকবে ৯৮ কোটি টাকা। পায়ের ওপর পা তুলে, স্বর্গের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে বাকি জীবন কাটানোর জন্য অনেক টাকা। আমাকে আর কিছুই করতে হবে না। আপনারা যাঁরা বুদ্ধিমান, তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, সরকার নিশ্চয়ই আপনার টাকা বাজেয়াপ্ত করবে। স্যরি, আমি আপনাদের চেয়েও চালাক। মেরে দেওয়া টাকা তো আমি দেশে রাখব না। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়ে সেখানে রাখব। আমাকে ছাড়া বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকার আর কিছুই পাবে না। আর এখন পর্যন্ত এমএলএম প্রতারণার জন্য কারো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে শুনিনি। কাউকে জেলেও যেতে হয়নি। বরং এমএলএম প্রতারণার টাকায় টিভি বানিয়ে, সেখানে প্রতিদিন বক্তৃতা দিয়ে রীতিমতো পাবলিক ফিগারে পরিণত হচ্ছেন। বলুন, এত সুবিধা থাকতে আমি কেন প্রতিদিন আরেকজনের টিভিতে ১২-১৪ ঘণ্টা কলুর বলদের মতো খাটব! ৯৮ কোটি টাকা থাকলে তো আমি একটা টিভির মালিকই বনে যেতে পারি। তবে আমি অত ঝামেলায় যাব না। আরো কিছু বেশি টাকা মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো দ্বীপে সমুদ্রের পাড়ে একটি বাড়ি কিনে সেখানেই কাটিয়ে দেব বাকি জীবন। সঙ্গে থাকবে প্রিয় মানুষ, প্রিয় বই, প্রিয় সিনেমা, প্রিয় গান, প্রিয় পানীয়, প্রিয় খাবার_আহ! আর কী চাই জীবনে! এখন পর্যন্ত এমএলএম প্রতারণার দায়ে কেউ কারাগারে যায়নি। টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও অনেক সুযোগ পাব। তার পরও সর্বোচ্চ ঝুঁকি তিন বছরের কারাবাস মেনেই নিচ্ছি। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, তিন বছরে কারাগারে থাকার কষ্ট ছাড়া এই ব্যবসায় আর কোনো ঝুঁকি নেই। আর একটা ব্যাপার বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে, যাদের টাকা মেরে দেব, তারা আমাকে জোচ্চোর, প্রতারক বলে গালি দেবে, অভিশাপ দেবে। আর যদি কম্পানি খুব বড় হয়ে যায়, তাহলে পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি হবে। তাতে আমার থোড়াই কেয়ার! আমি তো আর সেই গালি শোনার জন্য বসে থাকব না! ওয়েস্ট ইন্ডিজের নির্জন দ্বীপে বসে সেই গালি আমার কান পর্যন্ত পেঁৗছাবে না। আর অভিশাপে আমার অত বিশ্বাস নেই। শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। যাদের টাকা মারব, তাদের জন্য আমার মন একটুও কাঁদবে না। তারা তো লোভের ফাঁদে পা দেবে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এই লোভীদের মৃত্যুই পাওনা। যারা ভার্চুয়াল স্বর্ণ বা সরকারের জায়গায় গাছ লাগানোর জন্য বাড়িঘর বিক্রি করে টাকা দিতে পারে; তাদের টাকা আমি না নিলেও কেউ না কেউ নেবেই।
আচ্ছা আপনারা যখন বলছেন, তখন অতটা অমানবিক না হয় না-ই হলাম। তাহলে এমএলএম কম্পানি না খুলে হলমার্কের মতো গ্রুপ অব কম্পানিজ খুলতে পারি। তারপর কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে খাতির করে কাগজ চালাচালি করে, বায়বীয় রপ্তানি দেখিয়ে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা মেরে দেব। মেরে দিলে কী হবে? কিছুই হবে না। হলমার্কের মালিক তানভীর মাহমুদ টিভি ক্যামেরার সামনে অন রেকর্ড ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা মেরে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। দাবি করেছেন, যত টাকা মেরেছেন, তার ২০ গুণ সম্পত্তি আছে তাঁর। চলুন আবার একটু অঙ্ক মিলাই। দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার ২০ গুণ মানে ৫২ হাজার কোটি টাকা। আহ, স্বপ্নেও তো গুনতে পারছি না। এমন আত্মস্বীকৃত জালিয়াতের কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। তিনটি প্রাডো গাড়ি ব্যবহার করছেন। কয়েক হাজার লোককে চাকরি দিয়েছেন। এই ব্যবসায় গালি খাওয়ার ঝুঁকি নেই। বরং আমার হাজার হাজার কর্মচারী আমার পক্ষে রাস্তা অবরোধ করবে। সরকারও আমাকে কিছু করার আগে দুবার ভাববে। আমি যতটুকু জেনেছি, তানভীর মাহমুদের বিরুদ্ধে যে অনিয়মের অভিযোগ, তা আদালতে প্রমাণিত হলেও সর্বোচ্চ সাজা হবে সাত বছরের কারাদণ্ড। দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার বিনিময়ে সাত বছর জেলে থাকতে আমার অন্তত আপত্তি নেই। আর তানভীর মাহমুদ জেল খাটবেন কোত্থেকে, সব কিছু স্বীকার করার পর এখনো তাঁর বিরুদ্ধে একটা মামলা পর্যন্ত হয়নি। নিধিরাম সর্দার দুর্নীতি দমন কমিশনে একবার হাজিরা দেওয়া ছাড়া এখন পর্যন্ত তানভীর মাহমুদকে আর কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। সরকার নাকি টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে বেশি মনোযোগী। তবে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন অর্ধেকের বেশি টাকা আদায় সম্ভব নয়। তার মানে তানভীর মাহমুদ এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ফেরত দিলেই অর্থমন্ত্রী খুশি থাকবেন। তার মানে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা নিট লাভ। আর ব্যাংকের টাকা দিয়ে ব্যবসা করে তাকে যে ২০ গুণ বানিয়েছি, সেটা তো বোনাস! সব দিয়েথুয়েও ৫০ হাজার কোটি টাকা থাকবে। আর ৫০ হাজার কোটি টাকা থাকলে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সমুদ্রের পাড়ে বাড়ি নয়, আস্ত একটা দ্বীপই কিনে ফেলব। তবে ৫০ হাজার কোটি টাকা আমার মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছে। এমএলএম কম্পানি করে গালি খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ। সবার মুখ বন্ধ করার জন্য এক হাজার কোটি বরাদ্দ থাকবে। নিজের এলাকায় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-এতিমখানা বানিয়ে জনদরদি হয়ে যাব। অভিশাপ নয়, অনেক মানুষের দোয়া পাব। কোনো একটা বড় দলের কাছ থেকে নমিনেশন কিনে নেব। ৫০ হাজার কোটি টাকার মালিকের এমপি হতে সমস্যা হবে না আশা করি। মন্ত্রিসভা রদবদলের সময় কেউ প্রত্যাখ্যান করলে ফাঁকতালে মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারি। কপালে থাকলে ঠেকায় কে! আপনারা বললে একটা টিভি চ্যানেল খুলে আমার মতো বোকাদের সেখানে চাকরি দিতে পারি। সারা দিন নিজের টিভিতে নিজের চেহারা দেখাতে পারি।
এই দেশে সততার দাম কী বলেন! এই যে এত এত দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতির কথা শুনছেন, তাদের কয়জন জেলের ভেতরে আর কয়জন বাইরে? এমনকি ট্রুথ কমিশনে গিয়ে যারা দুর্নীতির কথা স্বীকার করে এসেছিল, তারা কোথায়? রাস্তায় চকচকে দামি গাড়িগুলো কারা চালায়?
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.