ভর্তি ফরম ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ by মিঠুন গোস্বামী
ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া ও তৎপরতার দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি দিলে সহজেই বোঝা যায়, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সংকোচন কত উলঙ্গভাবে ঘটছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর সব শিক্ষার্থীরই নিশ্চয়তা থাকা দরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার।
কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ আসন না রেখে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় হর্তাকর্তারা চালুনির ফুটো দিয়ে বের করে দেয় কম টাকার পকেটধারী অভাগা (!) শিক্ষার্থীদের।
পরীক্ষা শেষ না হতেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। তা যেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শিক্ষার্থীদের মেধা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হয় না। শুধু যার সর্বোচ্চ উত্তর হয়েছে, আসনের ভিত্তিতে তাকেই ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। যাকে আমরা ভাগ্য বা চান্স বলে থাকি। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো যেমন হামলে পড়ে লুটে নেয় বিপুল অঙ্কের টাকা, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভর্তি ফরম বিক্রির মাধ্যমে সম্পন্ন করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য।
সাধারণত দেখা যায়, আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মেধা থাকা সত্ত্বেও তাদের পক্ষে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে কোচিং করা তো দূরের কথা ফরম কিনে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই এ পর্যায়ে এসে যারা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালো ফল করেছে তাদের অনেকেই ঝরে পড়ে।
এবারও এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৯ লাখ ২৬ হাজার ৮১৪ জন শিক্ষার্থী, যা গতবারের তুলনায় ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে মাত্র ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৩৫টি। এ বছর পাস করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ হবে গত বছর পাস করা শিক্ষার্থীরাও, যারা গতবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি। ২০১২-১৩ সেশনে ভর্তি পরীক্ষার ফরমের মূল্য অন্যান্যবারের মতো এবারও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বাড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। প্রশ্ন উঠেছে, ভর্তি পরীক্ষা নিতে খরচের পরিমাণ কত? এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্ন করলে জবাবে তারা জানায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ফরমের মূল্য কম। আগের চেয়ে খরচ বেড়েছে অথবা বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তাই এর দামও বেড়েছে_ এমন খোঁড়া যুক্তি আর হয় না। অথচ আগে যেখানে অ্যানালগ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হতো, বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তি ফরম পূরণের ফলে এই বাবদ খরচ কম হয়। এতে কোচিং সেন্টারগুলোর ফরম বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আগের চেয়ে ফরমের মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কিনলেই হয় না। তারা প্রায় সব স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কেনে; এগুলোর মধ্যেও আবার রয়েছে বিভিন্ন ইউনিট, যা শিক্ষাকে প্রতিনিয়ত বাণিজ্যের দিকেই প্রসারিত করছে। আর এভাবেই গরিব মেহনতি মানুষের সন্তানদের শিক্ষা থেকে বিশেষত উচ্চশিক্ষা থেকে ঝরিয়ে ফেলে দিয়ে শিক্ষা সংকোচনের ধারাবাহিকতাই রক্ষা পাচ্ছে।
স মিঠুন গোস্ব্বামী
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট
mitun37@student.sust.edu
No comments