সংসদে ও সচিবদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ॥ সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন- ০ সকলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত- ০ মন্ত্রিসভার আকার ও প্রকার নিয়ে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন- ০ বাংলাদেশে দ্বিতীয় ওয়ান ইলেভেন হতে দেয়া হবে না

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা চলতি সংসদ বহাল রেখে আগামী নির্বাচন হচ্ছে না এমন ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারপ্রধান রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তাব দেন, রাষ্ট্রপতি সেই অনুযায়ী নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে সংসদ বহাল রেখে তো আর নির্বাচন হবে না।


আমার যখন সময় আসবে আমি রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব দেব। তখন বর্তমান মন্ত্রিসভা থাকবে, নাকি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা হবে, সংসদ ভেঙ্গে দেবেন কি না, সবই রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। নির্বাচনকালীন সরকারের আকার রাষ্ট্রপতিই ঠিক করবেন। এছাড়া সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে দ্বিতীয় ওয়ান ইলেভেন হতে দেয়া হবে না। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে।
দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের মতো সরকার আসলে তারা যে নির্বাচন দেবে তার গ্যারান্টি কোথায়? বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে যে কোন ধরনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে ফিরে এসেছে, তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাসী। আমরা জনগণের ভোট চুরির রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। জনগণ চাইলে আছি, নইলে নেই। কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না।
স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদের সমাপনী দিনে প্রধানমন্ত্রীর ত্রিশ মিনিটের নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এমাজউদ্দিন প্রামাণিকের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনায় ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আবার যদি এ ব্যবস্থা আসে, আর যদি ক্ষমতা না ছাড়ে তাহলে জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে। আবার যদি ওয়ান ইলেভেনের একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে তবে সংবিধান কার্যকর থাকবে না। ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন-ইয়াজউদ্দিনের মতো আরেকটি সরকার ক্ষমতায় এসে যদি থেকে যায়, নির্বাচন যে দেবে তার গ্যারান্টি কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দলসহ যারা বিভিন্ন টকশোতে তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে টেলিভিশন ফাটিয়ে ফেলছেন, তারা কী ওয়ান ইলেভেনের পরবর্তী ভয়াবহ অবস্থার কথা ভুলে গেছেন? ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়ে ছিল, তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল- তারা ছাড়া দেশের এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ নেই যে তারা নির্যাতনের শিকার হননি। এ কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সারাদেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রবল দাবি ওঠে।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে যিনি সরকারপ্রধান থাকেন, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের নির্দেশ দেন। আর নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে ২০০৫ সালে আমরা ২৩ দফা সুপারিশ করেছিলাম। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন এখন যথেষ্ট শক্তিশালী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ অবলম্বনকারীদের উদ্দেশ্যে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ’৭৫-পরবর্তী কোন দলীয় সরকারের অধীনে এমন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কখনও হয়নি। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে। সরকার কোথাও কোন হস্তক্ষেপ করেনি। কোথাও ফল পাল্টিয়ে আমরা নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করিনি। কারণ আমরা জনগণের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাস করি। ৬ হাজার নির্বাচনের একটিতেও কেউ কোন অভিযোগ আনতে পারেনি। এতেই প্রমাণিত হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী অবস্থানে থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে যাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই
মূল প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জানামতে বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সকল সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান রয়েছে বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার একটি বিতর্কিত নির্বাচন করে। যে নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষ বর্জন করেছিল। সারাদেশে সেনা মোতায়েন করে নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ সুপ্রীমকোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে। জাতীয় সংসদে সর্বদলীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক গত বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিভক্তি ভোটে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে বিধায় এ ব্যবস্থা চালু নেই। সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পূর্বে ২০ মে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল, যা সফল হয়নি বলে গণতন্ত্র রক্ষা পায়। ২০০১ সালে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিনই ১৩ সচিবকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করে এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন করে। বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে হত্যা খুন ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার ভোটার লিস্টে থাকা অবস্থায় নির্বাচনের প্রচেষ্টা নেন। ফলে সরকারের উপদেষ্টারা পদত্যাগ করেন। আবার তিনি নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। কয়েক দফা এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে ১/১১-এর ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, সেনা সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়ে তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিনের স্থলে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় থেকে যায়। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে। ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল স্তরের মানুষ গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। দেশব্যাপী যুদ্ধাবস্থা না থাকা সত্ত্বেও দু’বছর ধরে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে। দল ভাঙ্গা ও নতুন দল গড়ার খেলাও শুরু হয়। এ অবস্থায় জনগণ দেশে ও বিদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের ভেতর ও আন্তর্জাতিক চাপে ফখরুদ্দীন সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সংসদের উপ-নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পেরেছে যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। কাজেই মহাজোট সরকারের অধীনে যে কোন ধরনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে ফিরে এসেছে বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন নেই।
পদ্মা সেতু নির্মাণ
হবেই
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করবই। এক ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের মানুষের এই সর্বনাশ হয়েছে। ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যে ব্যক্তির (ড. ইউনূস) প্রতি দরদ দেখাতে ফজলুল আজিম সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেছিলেন, তাঁর কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণে সরকারের হাতে দু’ধরনের ডিজাইন রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দাতাগোষ্ঠী এগিয়ে আসলে নিচে রেল আর ওপরে সেতু অর্থাৎ ডবল ডেকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। আর না আসলে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত কম খরচের শুধু সড়ক সেতু নির্মাণ করা হবে। নিজস্ব অর্থায়নে কোন সারচার্জ বসাতে হবে না। দেশ-বিদেশ থেকে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারব। সরকারের প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। সেখান থেকে এক বিলিয়ন ডলার খরচ করা কোন ব্যাপারই নয়। যেহেতু পদ্মা নদী খরস্রোতা। তাই বন্যার সময় কাজ শুরু সম্ভব নয়, শীতকালে অবশ্যই নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড
হামলার বিচার
এ্যাডভোকেট সানজিদা খানমের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে প্রকাশ্য দিবালোকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা করা হয়। আমি কোনভাবে বেঁচে গেলেও আমরা হারিয়েছি আমাদের নেত্রী আইভি রহমানসহ অনেক নেতা-কর্মীকে। শত শত নেতা-কর্মী এখনও শরীরে গ্রেনেডের স্পিøন্টার নিয়ে যনন্ত্রণাকাতর দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে।
তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার মানসেই জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটিয়েছে। দেশটাকে একটি জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই এ ধরনের সন্ত্রাসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। তিনি আরও বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বে যারা বিশ্বাস করে না তাদের পক্ষেই এসব জঘন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করার উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা করেছিল। তারপর তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা করেছিল। দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রেনেড হামলাসহ যে সকল হামলা সংঘটিত হয়েছে সে সকল ঘটনায় দায়ের করা মামলার মধ্যে কিছু মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট মামলার বিচার কাজ অব্যাহত আছে।
সচিবদের সঙ্গে
প্রধানমন্ত্রী
ৎসচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে দ্বিতীয় ‘ওয়ান ইলেভেন’ সৃষ্টি হতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বুধবার সচিবালয়ে সচিব কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। বৈঠকে সচিবরা ৩ বছরের বেশি সময় ধরে সচিবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সিনিয়র সচিব করা, সিনিয়র সচিবদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান, ভারপ্রাপ্ত সচিবদের সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান, বঞ্চিতদের পদোন্নতি প্রদান, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতনভাতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দাবি পর্যালোচনার আশ্বাস দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বৈঠকে সচিবদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো আমাদের দেশেও নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে। কোন অবস্থায় মানুষের ভোটের আমানত নষ্ট হতে দেয়া হবে না। সকলে যাতে সুন্দর ও শান্তিুপূর্ণভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোন অবস্থায় দেশে দ্বিতীয় ওয়ান ইলেভেন সৃষ্টি হতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক কথাটি শুধু সংবিধানে সীমাবদ্ধ না রেখে সকল ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আর এ লক্ষ্যে আপনাদের সেবামূলক মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক তাঁর নির্বাচনী অভিজ্ঞতার বর্ণনা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশন সচিব বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সাড়ে ৬ হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন রয়েছে ১২টি। তিনি বলেন, এবার সারাদেশে মোট সাড়ে ৭ শতাংশ ভোটার বাড়ছে। পুরনো ভোটারদের মধ্যে কমেছে মোট ৪ লাখ।
সোয়া চার ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত সচিব কমিটির বৈঠকে মোট ২৮ সচিব বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বৈঠকটি পরিচালনা করেন এবং স্বাগত বক্তব্য দেন। একের পর এক সচিবদের বক্তব্য শুনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা তো সুন্দর বক্তব্য দেন। কিন্তু যে রিপোর্ট প্রদান করেন তা মনে হয় পড়েও দেখেন না।
বৈঠকে সচিবরা তাঁদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। এর মধ্যে তাঁরা বলেন, কিছু সচিবকে সিনিয়র সচিব করা হয়েছে। এতে সচিবদের এবং সিনিয়র সচিবদের ভিন্ন বলে মনে হয়। তাঁরা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরও কিছু সিনিয়র সচিব করার দাবি তোলেন। এ সময়ে অপর এক সচিব ৩ বছর যাবত যাঁরা সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের সিনিয়র সচিব পদে উন্নীত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে সিনিয়র সচিবের মর্যাদার কারণে এবং চিহ্নিত করতে তাঁদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে সচিবরা তাঁদের দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত সচিবরা বলেন, স্যার-আমরা একদিকে বসেছি। আমরা সকলে ভারপ্রাপ্ত সচিব। তাঁরা সচিব পদে পদোন্নতির দাবি জানান। একই সঙ্গে বঞ্চিতদের পদোন্নতির দাবিও জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দাবি পর্যালোচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতনভাতা বাড়ানোর দাবি জানানো হয়।
সচিবরা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন কর্মকর্তার পদায়নের কারণে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে সৃষ্ট ‘স্থান সঙ্কট’ নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। নির্বাচনের আর এক বছর বাকি থাকতে বুধবার সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে তিনি প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন এবং সচিবরা নানা সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। সচিবালয়ের ‘স্থান সঙ্কট’ নিরসনে সচিবরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে এক নির্দেশনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবছর বর্ষায় অর্থবছর শুরু হয় বলে ওই সময় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজগুলো করা সম্ভব হয় না। তবে প্রকল্পের নথিপত্রের কাজগুলো ওই সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেলার জন্য সচিবদের নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাগজপত্রের কাজ শেষে শুকনো মৌসুমে অবকাঠামোগত কাজগুলো করতে হবে। এতে অর্থের অপচয় বন্ধ এবং জনগণের উপকার হবে।
সচিবরা অভিযোগ করে বলেন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন খাতের অর্থ মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে চলে যায়। এতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা বলেন, দাতারা প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করে দেয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অন্য প্রোফাইলের কপি করতে। একটি প্রোফাইলে বিহারের নাম উল্লেখ ছিল। সে ক্ষেত্রে বাংলায় প্রোফাইল করলে আর কপি করার সুযোগ থাকে না।
সচিবদের প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দেশে সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আপনাদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণ সকল ক্ষমতার মালিকÑ কথাটি শুধু সংবিধানে নয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সে লক্ষ্যে আপনাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সচিব কমিটির বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবেন। বিভাগীয় মামলা এবং অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। সরকারী কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমরা তথ্য অধিকার কমিশন গঠন করেছি। কমিশনকে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় জনগণকে প্রদত্ত অধিকার সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতেও আপনারা ভূমিকা রাখবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। কিন্তু এই সাফল্য যথাযথভাবে প্রচার পাচ্ছে না। মিডিয়ার মাধ্যমে এই সাফল্য প্রচার করতে হবে। তাতে আমাদের ভাল কাজ জনগণ জানতে পারবে।
জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে সরকার ই-গবর্ন্যান্স কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি সরকারী অফিসে ডিজিটাল নথি ব্যবস্থাপনার কাজ শুরু হয়েছে। সকল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চালু হয়েছে ই-সেবা কার্যক্রম। এ কার্যক্রমকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে আপনারা বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন বলে প্রত্যাশা করি।
তিনি বলেন, একুশ শতকের উপযোগী একটি দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং সরকারী কাজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯-এ উন্নীত করা হয়েছে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারী সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। বিগত অর্থ বছর পর্যন্ত ১২৪ কর্মকর্তাকে গাড়িসেবা নগদায়ন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এলেও জনসংখ্যাকে এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আবাসন, শিল্প ও বাণিজ্যের কাজে ভূমি ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিবছর আবাদী জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করে কমে আসছে। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমির স্বল্পতা ও এর সর্বোত্তম ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ভূমি ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করার জন্য অনলাইনে ভূমি রেকর্ড সংরক্ষণ হাল নাগাদকরণ, ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা, ডিজিটাল নকশা ও খতিয়ান প্রণয়ন এবং প্রচলিত রেকর্ডের (খতিয়ান) পরিবর্তে ভূমি মালিকানা সনদ প্রবর্তন করার লক্ষ্যে সার্বিক ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.