সংবিধানের হস্তলেখক শিল্পী রউফ by কামাল লোহানী

প্রখ্যাত শিল্পী আবদুর রউফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নবাবপুর রোডের একটি বাড়িতে। তারপর থেকে একসঙ্গে খবরের কাগজ পড়া, দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা, আড্ডা, গল্প ইত্যাদির মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ল। সে সময় সুন্দর হাতের লেখার জন্য তার বেশ সুনাম ছিল।


প্রচ্ছদ আঁকায় তিনি প্রথমদিক থেকেই ছিলেন সুদক্ষ। সাংবাদিক একটি গ্রুপের সঙ্গে তার এবং আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা হলেন_ আতাউস সামাদ, সলিমুল্লাহ, তোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ। স্মৃতি বড়ই মধুর অথচ তা রোমন্থন করা একটু কষ্টকর। তিনি অনেক বড় দায়িত্বপূর্ণ পদে বসেও কখনও কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক ও বল্পুব্দবৎসল। সবাইকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। তার হাসি মুখ আর সুন্দর ব্যবহার দেখে অনেকে ক্ষণিকের দুঃখ-কষ্টের কথা ভুলে যেতেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে খাটতেন। ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার তাগিদে তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে আসেন। সে সময় তার একটাই স্বপ্ন ছিল_ এ দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হবে। বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। মনমানসিকতার দিক থেকে আমরা সবাই ছিলাম অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম নিয়ে রউফ সাহেব কখনও বাড়াবাড়ি করতেন না। তিনি মনে করতেন ধর্ম হলো সাধনার বিষয়। মনমানসিকতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন উদার। তিনি কখনও দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাননি, কখনও হননি। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের একজন বাঙালি মেজর আমাকে ডেকে গোপনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'শেখ সাহেব (বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান) নির্বাচনে জয় লাভ করতে পারবেন কি-না?' প্রকৃতপক্ষে ভদ্রলোকের ওই প্রশ্নটিই ছিল প্রবাসী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতারই নামান্তর। এভাবে প্রবাসী বাঙালিদের একটি অংশ সবসময় দেশকে শত্রুমুক্ত করার কথা ভাবতেন এবং একেএম আবদুর রউফ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ জন্য তিনি রাত-দিন সমানতালে পরিশ্রম করতেন। এ দেশের সংবিধান তার সুন্দর হস্তাক্ষরে তৈরি। জাতীয় সংসদে সংবিধান পাসের দিন তিনি সব এমপির স্বাক্ষর নেন।
মহৎ ব্যক্তিরা কখনও নিজের সুনামের জন্য কিছু করে যান না। অথচ পরবর্তী প্রজন্ম তাদের মহৎ কর্মের উত্তরাধিকার নিয়ে নেয়। এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রকৃত সিদ্ধ। তিনি যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানের হস্তলিপিকার, এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের। ২০১০ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তাকে জানতে পারে, এ জন্য সরকার ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সবার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আজ ১ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আবদুর রউফের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
কামাল লোহানী : ডিজি, শিল্পকলা একাডেমী
 

No comments

Powered by Blogger.