জলাবদ্ধতার বহুমাত্রিক চিত্র by এ এম এম শওকত আলী

অতীতে নগরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দৃশ্যমান ছিল। বিগত এক দশকে এর বিস্তৃতি ঘটে গ্রামাঞ্চলে; মূলত যশোর ও সাতক্ষীরার কিছু উপজেলায়। ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে বলা যায়, এখানে জলাবদ্ধতার মূল কারণ প্রায় ভরাট হওয়া ৩২টির মতো খাল। এসব খালই ছিল প্রাকৃতিক জল নিরসনের ধারক ও বাহক।


জল নিষ্কাশনের জন্য এ মাধ্যম ছিল পরিবেশবান্ধব ও নির্ভরযোগ্য। এর জন্য সরকারের কোনো ব্যয়ও হতো না। ভারি বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি সত্ত্বেও জল প্রবহমান খালগুলো থেকে শহরের আশপাশের নদীতে চলে যেত। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে খাল ভরাট হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সাম্প্রতিককালের ভূমিদস্যুদের কর্মকাণ্ড। এরা আশপাশের জমিসহ খালের অংশবিশেষ ছলে-বলে-কৌশলে দখল করে নেয়।
বিগত কয়েক বছরে এটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। সরকারি নীতিনির্ধারকদের ওপর কিছু অরাষ্ট্রীয় সংগঠন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপের সৃষ্টি করে। এর ফলে সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। অল্পকিছু সাফল্যও অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। বর্ষা মৌসুমে এখন শহরের রাস্তায় জলাবদ্ধতার বিষয়টি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কয়েক ঘণ্টার জন্য এ রূপ স্থায়ী হয়। এতে ঢাকার জনগণ যেন অভ্যস্ত হয়ে এ দুর্দশা মেনে নিয়েছে। তবে কথা বললে বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। মূল কারণ, যারা স্কুল-কলেজে বা অফিসে, কি বাজারে যায়, তাদের জন্য অত্যধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। যারা হেঁটে যায়, তাদের গতিও শ্লথ হয়। দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকরা জানতে চায়, কে বা কারা জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। এ কাজ কি ঢাকা ওয়াসার? না রাজউকের? না সিটি করপোরেশনের? এ নিয়ে মিডিয়ায় প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। জানা যায়, বিভিন্ন সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের একে অপরকে দোষারোপের কাহিনী। এ ধরনের পারস্পরিক দোষারোপের খেলায় আর যা-ই হোক, জনস্বার্থের সুরক্ষা হয় না। এটাই বাস্তবতা।
পক্ষান্তরে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতাদের দায়িত্বের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরা সব সময়ই জনসেবক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁরা নিজ এলাকায় দায়িত্বশীল ও সচেতন হলে ভূমিদস্যুদের কর্মকাণ্ড অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব ছিল। অর্থাৎ কমিউনিটি পর্যায়ে তাঁদের দায়িত্বশীল আচরণ। এ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা তাঁদেরই দায়িত্ব। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশি কর্মকাণ্ডে হয়তো ফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। এমনো দেখা গেছে, যেদিন কোনো সরকারি জায়গা থেকে দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তার অল্প কয়েক দিন পর উচ্ছেদ করা ব্যক্তি জায়গাটি পুনর্দখল করেছে। এলাকাভেদে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমেই দখলমুক্ত জায়গা স্থায়িত্ব লাভ করবে। তবে এর সঙ্গে যোগ করা যায়- বর্তমানের জীর্ণশীর্ণ খালগুলো যদি প্রতিবছর সংস্কার করা হতো এবং এ-সংক্রান্ত জমির মালিকানার দলিল-দস্তাবেজ হালনাগাদ করা হতো, তাহলে আরো সফলতা অর্জন সম্ভব ছিল। খালগুলো রক্ষা করা যেত। বলা বাহুল্য, বার্ষিক ভিত্তিতে এ ধরনের সংস্কার অতীতে হয়নি; যার দুর্ভোগ এখন সবাইকে সইতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়ও উল্লেখ করা যায়। খাল-বিলের আশপাশে বসবাসকারীরা গৃহের বর্জ্য খাল-বিলে ফেলে দেয়। অনেকে অবশ্য বলতে পারেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এ প্রতিষ্ঠান আইন দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। বর্জ্য তো নগরবাসী ঘরে রাখতে পারে না। এর সঙ্গে আরো যোগ হবে যে তারা এ কাজের জন্য করপোরেশনকে কর পরিশোধ করে। এর ফলে হয়তো তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা ও সমর্থন করা যায়, কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত বা বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা যায় না। বর্ষায় যখন জলাবদ্ধতা হয়, নগরবাসী ওয়াসাকে গালমন্দ দিতে শুরু করে। ওয়াসার কথা হলো, জল নিষ্কাশনের কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই। বিনিয়োগও নেই। তবে এ বিষয়টি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে জানা সম্ভব যে অতীতে এ সম্পর্কে কিছু পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল। তবে এগুলো ছিল মহাপরিকল্পনা। যার বাস্তবায়ন অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল।
ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামও কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। ঢাকার বেগুনবাড়ী খালের অনুরূপ চট্টগ্রামের চাকতাই খাল এখন জীর্ণশীর্ণ- নিয়মিত সংস্কারের অভাবে। গত সপ্তাহে অতিবৃষ্টির প্রভাব টিভি মিডিয়া ভালোভাবেই প্রচার করেছে। দেখা গেছে যে নগরের কিছু রাস্তায় হাঁটু পর্যন্ত পানি। বৃষ্টি থামার পর অবশ্য তা নেমে যায়। তবে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর। প্রাথমিকভাবে কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সময়মতো গ্রহণ না করার জন্য করপোরেশনকে দোষারোপ করে। ৩০ জুন একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে করপোরেশন সর্বমোট ১৪৪ কিলোমিটার খাল খনন করেছে। এর মধ্যে চাকতাইসহ ছোট-বড় আরো অনেক খাল ছিল। ওই কর্মকর্তা স্থায়ী প্রতিকারের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। তবে বলা যায় যে এ বিষয়টি প্রয়োজনীয় হলেও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য যথেষ্ট নয়। সময়মতো কাজও করা প্রয়োজন।
পল্লী অঞ্চলের জলাবদ্ধতা ভিন্নতর ও অনেকাংশে ভয়ংকর। জলাবদ্ধতার ফলে কৃষকরা জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ এর ফলে তারা ফসল উৎপাদন করতে পারে না। এ ছাড়া তাদের ঘরের বাইরে যাওয়াও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। ২০০৮ সালের আগে যশোরের কেশবপুর উপজেলায় জলাবদ্ধতার বিষয় জানা গিয়েছিল। ২০০৭ সালে আইলার আঘাতের পর এখন সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলাও জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকেই বিষয়টি দৃশ্যমান। তবে ভবদহ বিলের কথাই মিডিয়ায় বেশি প্রচারিত হয়েছে। এ বিষয়ে নগরের সঙ্গে পল্লী অঞ্চলের একটি সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য। তা হলো, গ্রামবাসী জানে না যে এ দায়িত্ব কোন সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের। এটা কি পানি উন্নয়ন বোর্ড, না এলজিইডি অথবা দুই প্রতিষ্ঠানেরই? ২০০৮ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল।
কিছুটা তারতম্য থাকলেও আরেকটা সাদৃশ্য হলো, জলমগ্ন হলে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাটের ক্ষতি। প্রয়োজন হয় সংস্কারের। অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের, যা সময়মতো করা সম্ভব হয় না। এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই। বিতর্কের বিষয় রাস্তা নির্মাণের বা পূর্ব সংস্কারের গুণগত মান। শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তা নির্মাণ ও পুনঃসংস্কারের সরকারি সংস্থা একাধিক। জনপথের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর সঙ্গে রয়েছে এলজিইডি। মহানগরীতে কিছু রাস্তা আবার সিটি করপোরেশনের। একই মহানগরীতে তিন সংস্থা কাজ করে। ফলে জনগণ জানে না, কোন রাস্তা কার অধিক্ষেত্রভুক্ত। এ নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ঢাকা মহানগরীর কিছু রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজউকের। মূলত নির্মাণাধীন আবাসন প্রকল্পে এমন কিছু রাস্তা রয়েছে। সংস্কারের অভাবে পল্লী অঞ্চলের রাস্তাই সবচেয়ে নিম্নমানের। প্রাথমিক পর্যায়ে রাস্তা নির্মাণের সময় যত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়, সংস্কারের প্রয়োজনের সময় তা দৃশ্যমান হয় না। এ কারণে গ্রামবাসীকে অনেক দুর্ভোগ সইতে হয়।
বেসামরিক কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাজ ফলপ্রসূ না হলে সামরিক বাহিনীকে তলব করা হয়। হয়তোবা একাধিক সামরিক শাসনের ফলেই এ রীতি সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিককালের ঘটনাই প্রমাণ করে যে জলাবদ্ধতা থেকে জনগণ এখনো মুক্তি পায়নি। এ বিষয়টি নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারিগরি কৌশলের শিরোনাম হলো, জোয়ারভাটাবিশিষ্ট নদীব্যবস্থাপনা (Tidal River Management)। মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় যে ১৯৬০ সালে তৎকালীন পানি ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বা ওয়াপদা এ অঞ্চলে এ কৌশল বাস্তবায়ন করে। বর্তমানে এ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কোনোটাই এখনো সফল হয়নি। হয়তোবা প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
১৯৬০ সালে ওয়াপদা কর্তৃক জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নির্মিত স্থাপনা কতবার সংস্কার করা হয়েছে, সে হিসাবও পাওয়া যাবে না। বর্তমানে যেগুলো বাস্তবায়নাধীন, সেগুলোর ভবিষ্যৎ যদি একই ধরনের হয়, তাহলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে যশোর ও সাতক্ষীরার অধিবাসীরা কোনো দিনই মুক্তি পাবে না। বিষয়টি সরকার ভেবে দেখতে পারে। একই যুক্তি মহানগরীর জন্য প্রযোজ্য। তবে এ ক্ষেত্রে খালগুলোর নিয়মিত সংস্কারের প্রয়োজন হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজন হবে এলাকাভিত্তিক নগরবাসীদের সক্রিয়তা।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.