ফলে বিষ, তবু খেতে হয়! by রাজীব আহমেদ

পুষ্টিবিজ্ঞান বলে, সুষম খাদ্যের জন্য একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু বিষের ভয়ে ফল খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুদুর রহমান। তিনি নিজেও ফল খান না, পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকেও খেতে দেন না।


তিনি জেনেছেন, কেবল ফুটপাতের দোকান নয়, অভিজাত চেইনশপেও বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত ফল বিক্রি হচ্ছে। তাই ফল নিয়ে মাসুদুর রহমানের 'আস্থা' একেবারেই নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ৮০ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়। গড়ে ৫০ টাকা কেজি ধরলেও এসব ফলের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। দেশে উৎপাদিত প্রধান তিনটি ফল- আম, কাঁঠাল, আনারস গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে (এপ্রিল থেকে জুলাই) পাকে। এসব ফলের এখন ভরা মৌসুম। কিন্তু মানুষের আস্থাহীনতার মধ্যেই চলছে মৌসুমি ফলের এই বিশাল বাজার। মানুষ কিনছে স্বাস্থ্যের ক্ষতি জেনেই। তবে দেশের মানুষ কিনলেও বিদেশিরা কিনছে না। আন্তর্জাতিক ফলের বাজারে ঢুকতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ পাকিস্তান আম রপ্তানিতে তাদের একচ্ছত্র রাজত্ব ধরে রেখেছে। ভারত, ফিলিপাইন থেকেও আম যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফলবাজারে মানুষের আস্থা ফেরাতে সরকারের কোনো সংস্থারই ধারাবাহিক নজরদারি নেই।
লোক দেখানো কিছু ভেজালবিরোধী অভিযানে খুচরা দোকান মালিকদের জরিমানা করা হয়। কালেভদ্রে র‌্যাব ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো আমের চালান ধরে সেগুলো ধ্বংস করে। কিন্তু এসব পদক্ষেপে ফলে বিষ মেশানো বন্ধ হয় না। জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে অনেকটা চোখ বুজে থাকে সরকারি একাধিক সংস্থা। রাজধানী বা দেশের একটি বাজারও তারা 'বিষমুক্ত' করতে পারেনি।
জানা গেছে, তাজা ফলে অল্প-বিস্তর রাসায়নিক সব দেশেই মেশানো হয়। তবে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে উন্নত দেশে বিক্রেতা থেকে শুরু করে বাগান মালিক, এমনকি রপ্তানিকারক দেশকেও প্রচুর মাশুল গুনতে হয়। সেসব দেশে ভোক্তা অধিকার ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠনগুলো নিজেরা জরিপ করে ক্ষতিকর ফল বা খাদ্য পণ্যের তালিকা প্রকাশ করে ভোক্তাদের সেগুলো না খাওয়ার পরামর্শ দেয়। নিরাপদ বা কম ক্ষতিকর পণ্যের তালিকা প্রকাশ করে তারা ভোক্তাদের বিকল্প পথও দেখায়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের পরিবেশবাদী একটি সংগঠন 'ডার্টি ডজেন' তালিকা প্রকাশ করে সতর্ক করেছে ক্রেতাদের। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি রাসায়নিকযুক্ত পিচ, আপেল, চেরি, স্ট্রবেরি, আমদানি করা আঙ্গুর স্থান পেয়েছে এ তালিকায়। এসব ফল না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি ভোক্তাদেরকে বলেছে, এসব ফলে ২০ ধরনের রাসায়নিক ও কীটনাশক উচ্চমাত্রায় রয়েছে, যা ধুয়ে বা খোসা ছাড়িয়ে খেলেও পুরোপুরি দূর হয় না। অর্গানিক ফল খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ৯০ শতাংশ কম হবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। যাদের অর্গানিক পণ্য কিনে খাওয়ার সঙ্গতি নেই, তাদের জন্য কম মাত্রার রাসায়নিকযুক্ত ফলের তালিকাও দিয়েছে তারা। এ তালিকায় রয়েছে আনারস, আম, পেঁপে ও কলার নাম।
কিন্তু এ দেশে ভোক্তারা ফলে বিষের ব্যাপারে অবগত হলেও সক্রিয় নয় এ ধরনের সংগঠনগুলো। বিষাক্ত ফল বা ভেজাল খাবার খেয়ে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে এরা প্রায় নিশ্চুপ। নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার কথা প্রকারান্তরে স্বীকারও করেন এসব সংগঠনের নির্বাহীরা। এক সংগঠন দায় চাপায় আরেকটির ঘাড়ে। তবে বিদ্যমান আইনের শিথিল প্রয়োগের জন্য সবার অভিযোগের সম্মিলিত তীর সরকারের দিকেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ড. এম এ মতিন বলেন, এ রকম তালিকা প্রকাশ করে ভোক্তাদের সতর্ক করা বা ক্ষতিকর খাবার না খাওয়ার আহ্বান জানানোর কর্মসূচি তাঁদের নেই। তবে নিরাপদ খাবার ও পানীয়বিষয়ক কিছু কর্মকাণ্ড আছে, যা তাঁরা অন্য আরেকটি সংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে করেন। এসব বিষয়ে জনগণকে সোচ্চার ও কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে বাধ্য করার জন্য আরো সংগঠন দরকার বলে মনে করেন তিনি। ড. মতিন বলেন, 'এ ব্যাপারে বেশি দায়িত্ব পালন করার কথা ক্যাবের। কিন্তু সংগঠনটি ব্যর্থ হয়েছে।'
দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় ২০০৮ সালে চীন থেকে আমদানি করা মেলামাইনযুক্ত গুঁড়োদুধ বর্জন করেছিল বাংলাদেশের ভোক্তারা। অ্যানথ্রাক্সের ভয়ে গরুর মাংস এবং বার্ড ফ্লুর ভয়ে পোলট্রি মুরগি কেনাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল শহুরে মানুষ। পরিবেশবাদী বা ভোক্তা অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে একইভাবে বিষাক্ত ফল বর্জনের আহ্বান জানানো যায় কি না জানতে চাইলে ড. মতিন বলেন, এ দেশের ভোক্তারা যথেষ্ট সচেতন। তাঁরা জানেন, ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। কোনো সংগঠন যদি চিহ্নিত করে দেয় কোন কোন বাজারের ফল বিষাক্ত এবং সে ফল না খাওয়ার আহ্বান জানায়, তা হলে সাড়াও পাওয়া যাবে।
তবে ক্ষতিকর রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করে এ পরিবেশকর্মী বলেন, 'আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকতে হবে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও আমাদের মতো কথা বলেন, উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁদের তো আইন প্রয়োগ করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি একদিন অন্তত একটি বাজারেও তাৎক্ষণিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দেন এ বাজারের ফলে বিষ, কেউ এ ফল খাবেন না; এতেও সাড়া পড়বে। অতি মুনাফার লোভে যারা ফলে বিষ মেশায়, তাদের ফল না কিনে শাস্তি দেবে গ্রাহকরাই।'
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, নিশ্চিন্ত হয়ে ফল খাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। কেমিক্যালের প্রয়োগ এখন সর্বত্র। এটা দমন করতে সরকারের ইচ্ছা থাকা প্রয়োজন। বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও সরকার এ ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করতে পারে। কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অপরাধ কমে যাবে। তিনি বলেন, অপরাধ দমনের জন্য উৎসে যাওয়া প্রয়োজন। পাড়ার গলির মুখের কিছু খুচরা ব্যবসায়ীকে ধরে তাঁর আম নষ্ট করে, জরিমানা করে অপরাধ দমন করা যায় না।
ক্যাব কখনো এসব ফল খেতে বারণ করেছে কি না জানতে চাইলে কাজী ফারুক বলেন, অতীতে রোজার আগে ভোক্তাদের কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে না কেনার আহ্বান জানানো হতো। কিন্তু এখন হয় না। কারণ এ দেশের ভোক্তারা সংগঠিত নয়। তাদের সংগঠিত করতে না পারার দুর্বলতাও স্বীকার করেন তিনি। আবার অর্থ সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্যাবের গঠন কাঠামো সংস্কার করে ভিত্তি শক্ত করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে কী পরিমাণ ফল উৎপাদন হয়েছে তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি। তাদের ২০১০-১১ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, ওই বছর দেশে ১৩ লাখ ৭২ হাজার টন আম উৎপাদন হয়েছে। পরের বছর আরো বেশি হবে। বাজারে খুচরা পর্যায়ে আমের দাম ৬০ থেকে শুরু করে ১২০ টাকা। গড় দাম দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৯০ টাকা। এ হিসাবে বছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার শুধু আমই উৎপাদন হয়। দেশের মানুষের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এ ফলটি উৎপাদন, পাকানো ও বাজারজাতকরণ পর্যায়ে ফরমালিন, কার্বাইড ও ইথোফেন নামের রাসায়নিক ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
আম ছাড়াও প্রায় ৫০টি পণ্যের উৎপাদনের হিসাব রাখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ওই হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৫২ হাজার টন কাঁঠাল, প্রায় ৯৮ হাজার টন লিচু, তিন লাখ ৩৫ হাজার টন পেয়ারা, ১৩ লাখ ৩৭ হাজার টন কলা, এক লাখ ৭৫ হাজার টন আনারস ও চার লাখ ২৫ হাজার টন পেঁপে উৎপাদন হয়। ওই বছর দেশে ফলের মোট উৎপাদন হয় ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার টন। দেশের ৯ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ফলের অবদান সোয়া ৪ শতাংশের মতো। অথচ মানুষের আস্থাহীনতার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতির এই অংশটি।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা সোহরাব হোসেন দীর্ঘদিন ধরেই মৌসুমি ফল বিক্রি করে আসছেন। তিনি জানান, পাঁচ-সাত বছর আগে বাজারে আম বিক্রি করতে আনলে অনেক পচে যেত। কিছু আম বেশি পাকা থাকত। কিছু আম কম পাকা থাকত। আবার আমের ওপরের অংশে আগে পাকত, নিচের অংশ পরে। এখন একটি ঝুড়িতে যত আম আসে, সবটার রং একই রকম হয়। সব আমই একই রকম পাকা থাকে। আবার আমের পুরো শরীরটাই একসঙ্গে পাকা রং ধারণ করে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে গাছের সব আম একসঙ্গে পাকে না। রাসায়নিক মেশানো হয় বলেই সব আম একসঙ্গে পেকে যায়। আবার ফলের পুরো অংশ একসঙ্গে পাকা রং ধারণ করে শুধু রাসায়নিকের কারণেই।
ক্রেতা আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'সন্তানদের ফল হিসেবে কলা খেতে দিই। তবে সেটি গ্রামের বাড়ি গাজীপুর থেকে নিয়ে আসা হয়। ওই কলা চাষও হয় নিজেদের জমিতে। এ ছাড়া দেশি ফলের মধ্যে কামরাঙ্গা, আমড়া ইত্যাদি বাজার থেকে কিনে এনে দিই। এগুলো পাকাতে রাসায়নিক মেশানোর আশঙ্কা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাগরময় বড়ুয়া বলেন, 'ভোক্তাদের মতো আমরাও উদ্বিগ্ন, অসহায়। মৌসুমি ফল মানুষ ঝুঁকি নিয়েই খাচ্ছে। রাসায়নিকের ক্ষতির ঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না। তাই আমরা পুষ্টিবিদরা ফল খাওয়ার জন্য এখন আর জোর দিচ্ছি না। আবার না খাওয়ার কথাও বলতে পারছি না।'
ক্ষতির ঝুঁকি কিছুটা কমানোর জন্য ফল পানিতে ঘণ্টাখানেক ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার কথা বলে থাকেন পুষ্টিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা। তবে তাতে ফল কতখানি নিরাপদ হয়, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন।

No comments

Powered by Blogger.