নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ-পাঠক! বাড়ি আছো? by হুমায়ূন আহমেদ
(নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের এই লেখাটি ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলো ডট কমের পাঠকদের জন্য লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।) প্রায় চার দশক আগের কথা। আমি পড়ি ঢাকা কলেজে। থাকি সাউথ হোস্টেলে। প্রধান আনন্দ—বলাকা সিনেমা হলে কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা।
একটা ভয়ের সিনেমা দেখে ভয়ে ও আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলাম। রাতে ঘুমাতে পারি না, দুঃস্বপ্ন দেখি। ছবির নাম পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম। এডগার অ্যালেন পো’র গল্প। ছবির সঙ্গে গল্পকারের নাম মাথায় ঢুকে গেল। ঢাকা কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করার আগেই তাঁর বই প্রায় সবই পড়ে ফেললাম। একসময় আবিষ্কার করলাম, এই লেখক শুধু গল্প-উপন্যাসই লেখেন না, কবিতাও লেখেন। তাঁর কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় আমেরিকায় পড়াশোনা করতে যাওয়ার পর। দ্রুত তিনি আমার পছন্দের তালিকায় চলে আসেন।
একসময় অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি শুধু যে আমার প্রিয় কবি তা না, তিনি জীবনানন্দ দাশেরও প্রিয় কবি। জীবনানন্দ দাশের অতি বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর উত্স এডগার অ্যালেন পো’র কবিতা ‘টু হেলেন’। এডগার অ্যালেন পো’র ‘হেলেন’ হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। পাঠক! দুটি কবিতা পাশাপাশি নিয়ে বসুন।
ভালো কথা, এডগার অ্যালেন পো কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথের ‘একই গাঁয়ে’ আর এডগার অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’ একই কবিতা। একটি ইংরেজিতে লেখা, অন্যটি বাংলায়। রবীন্দ্রনাথের ‘রঞ্জনা’ আসলে অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’। রবীন্দ্রভক্তরা আমার ওপর রাগ করলেও কিছু করার নেই। মহান লেখকেরাও ধার করেন।
পশ্চিমবঙ্গের লেখক হর্ষ দত্ত খোলাখুলি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নেওয়া হয়েছে মেটারলিংকের ব্লু বার্ড থেকে।
হর্ষ দত্তের মতে, অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আংলা আর সেলমা লাগেরলফের লেখা দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারস অব নিলস প্রায় হাত ধরাধরি করে চলেছে। বিষ্ণু দের অনেক কবিতায় গাঢ় ছায়া ফেলেছেন টি এস এলিয়ট। সুকুমার রায়ের প্রচুর ছড়া এডওয়ার্ড লিয়র ও লুইস ক্যারলের প্রত্যক্ষ প্রভাবে লেখা।
বিতং করে সাহিত্য চুরি (প্লেজিয়ারিজম) নিয়ে লিখছি কেন? কারণ অবশ্যই আছে। অতি সম্প্রতি আমি জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির বই একের পর এক পড়ে যাচ্ছি (সৌজন্যে: সুমন রহমান, কানাডা)। এই লেখক ১৯৪৯ সালে টোকিওতে জন্মেছেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। তিনি প্রথম বইতেই জাপানি পাঠকদের হূদয় হরণ করেন। এখন তিনি নেমেছেন পৃথিবীর পাঠকদের হূদয় হরণের কাজে। সফল হয়েছেন তো বটেই। তাঁর প্রতিটি বই (গল্প ও উপন্যাস) নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলারের তালিকায় আছে। তাঁর উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর ৩০টি ভাষায়।
এই লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি, গল্প নির্মাণ এবং চরিত্র তৈরির সঙ্গে বাংলাদেশি একজন লেখকের লেখার আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখা যায়। কে জানে কী সমস্যা!
যা-ই হোক, আমি ঠিক করেছি এই লেখকের একটি গল্পের ভাব চুরি করে একটা গল্প আমার মতো করে লিখব। গল্পটার নাম ‘ফ্রগ সেভ্স টোকিও’।
মূল গল্পের শুরুর কয়েকটা লাইন এ রকম:
কাতাগিরি দেখল তার অ্যাপার্টমেন্টে প্রকাণ্ড এক ব্যাঙ। ছয় ফুটের মতো লম্বা, শক্ত-সমর্থ শরীর। কাতাগিরি ব্যাঙের বিশাল শরীর দেখে হতভম্ব।
ব্যাঙ পরিষ্কার গলায় বলল, আমি একটা ব্যাঙ।
কাতাগিরি দরজার সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কথা বলার শক্তি নেই।
ব্যাঙ বলল, আমি তোমাকে আহত করার জন্য এখানে আসিনি। ভয় পেয়ো না। দয়া করে ভেতরে আসো। দরজাটা বন্ধ করো।
এক হাতে ব্রিফকেস অন্য হাতে গ্রোসারি ব্যাগ নিয়ে কাতাগিরি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্যাঙ বলল, মি. কাতাগিরি! দরজাটা বন্ধ করো, জুতা খোলো। একটু তাড়াহুড়া করো। আমার হাতে সময় কম।
আমেরিকায় এসে আর কিছু করি বা না করি, প্রচুর পড়ছি। মনে হচ্ছে, আমি কোথাও অবসর কাটাতে গেছি। আমার সামনে সমুদ্র, আমি নারকেলগাছের ছায়াতে বসে আছি, হাতে বই। পাশে রাখা আছে পছন্দের পানীয় (মার্গারিটা হতে পারে)। বিরক্ত করার জন্য কেউ নেই। আমি ক্লান্তিহীন পড়েই যাচ্ছি।
এইখানে এই তরুর তলে
তোমায় আমায় কৌতূহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র।
অল্প কিছু আহার মাত্র।
আরেকখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিয়ে।
(ওমর খৈয়াম)
অনুবাদ: সৈয়দ মুজতবা আলী
এখানে আমাকে বিরক্ত করার কেউ নেই। যখন পড়তে বসি বা লিখতে বসি, আমার দুই পুত্রকে ঘর থেকে বের করে তাদের মা দরজা বন্ধ করে দেয়।
পৃথিবীতে আছে লাখ লাখ অপূর্ব সব বই। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় বইয়ের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই পড়তে পারে। ষাট বছর যার আয়ু, সে যদি জন্মের দিন থেকেই প্রতিদিন একটা করে বই শেষ করে, তাহলে ষাট বছরে সে পড়বে মাত্র একুশ হাজার ছয় শ বই। আমার হিসাবে কোনো বুভুক্ষু সর্বগ্রাসী পাঠকেরও এক জীবনে দশ হাজার বই পড়া সম্ভব নয়। তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের নায়কের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘জীবন এত ছোট কেন?’
পাদটীকা
পুত্র নিষাদ আমাকে বলল, বাবা, তোমার শরীর খুবই খারাপ। তুমি কখনো একা বাথরুমে যাবে না। আমি তোমাকে হাত ধরে নিয়ে যাব। বাথরুম শেষ হওয়ার পর হাত ধরে নিয়ে আসব। যতক্ষণ বাথরুম শেষ না হয়, আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। ছোটদের লজ্জা করতে নেই। ঠিক আছে, বাবা?
আমি বললাম, ঠিক আছে। ক্যানসার ব্যাধিটির প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। এই রোগের কারণেই পুত্রের কাছ থেকে এত সুন্দর কিছু কথা শুনলাম।
(জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক)
একসময় অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তিনি শুধু যে আমার প্রিয় কবি তা না, তিনি জীবনানন্দ দাশেরও প্রিয় কবি। জীবনানন্দ দাশের অতি বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর উত্স এডগার অ্যালেন পো’র কবিতা ‘টু হেলেন’। এডগার অ্যালেন পো’র ‘হেলেন’ হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। পাঠক! দুটি কবিতা পাশাপাশি নিয়ে বসুন।
ভালো কথা, এডগার অ্যালেন পো কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথের ‘একই গাঁয়ে’ আর এডগার অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’ একই কবিতা। একটি ইংরেজিতে লেখা, অন্যটি বাংলায়। রবীন্দ্রনাথের ‘রঞ্জনা’ আসলে অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’। রবীন্দ্রভক্তরা আমার ওপর রাগ করলেও কিছু করার নেই। মহান লেখকেরাও ধার করেন।
পশ্চিমবঙ্গের লেখক হর্ষ দত্ত খোলাখুলি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নেওয়া হয়েছে মেটারলিংকের ব্লু বার্ড থেকে।
হর্ষ দত্তের মতে, অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আংলা আর সেলমা লাগেরলফের লেখা দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চারস অব নিলস প্রায় হাত ধরাধরি করে চলেছে। বিষ্ণু দের অনেক কবিতায় গাঢ় ছায়া ফেলেছেন টি এস এলিয়ট। সুকুমার রায়ের প্রচুর ছড়া এডওয়ার্ড লিয়র ও লুইস ক্যারলের প্রত্যক্ষ প্রভাবে লেখা।
বিতং করে সাহিত্য চুরি (প্লেজিয়ারিজম) নিয়ে লিখছি কেন? কারণ অবশ্যই আছে। অতি সম্প্রতি আমি জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির বই একের পর এক পড়ে যাচ্ছি (সৌজন্যে: সুমন রহমান, কানাডা)। এই লেখক ১৯৪৯ সালে টোকিওতে জন্মেছেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। তিনি প্রথম বইতেই জাপানি পাঠকদের হূদয় হরণ করেন। এখন তিনি নেমেছেন পৃথিবীর পাঠকদের হূদয় হরণের কাজে। সফল হয়েছেন তো বটেই। তাঁর প্রতিটি বই (গল্প ও উপন্যাস) নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলারের তালিকায় আছে। তাঁর উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর ৩০টি ভাষায়।
এই লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি, গল্প নির্মাণ এবং চরিত্র তৈরির সঙ্গে বাংলাদেশি একজন লেখকের লেখার আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখা যায়। কে জানে কী সমস্যা!
যা-ই হোক, আমি ঠিক করেছি এই লেখকের একটি গল্পের ভাব চুরি করে একটা গল্প আমার মতো করে লিখব। গল্পটার নাম ‘ফ্রগ সেভ্স টোকিও’।
মূল গল্পের শুরুর কয়েকটা লাইন এ রকম:
কাতাগিরি দেখল তার অ্যাপার্টমেন্টে প্রকাণ্ড এক ব্যাঙ। ছয় ফুটের মতো লম্বা, শক্ত-সমর্থ শরীর। কাতাগিরি ব্যাঙের বিশাল শরীর দেখে হতভম্ব।
ব্যাঙ পরিষ্কার গলায় বলল, আমি একটা ব্যাঙ।
কাতাগিরি দরজার সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কথা বলার শক্তি নেই।
ব্যাঙ বলল, আমি তোমাকে আহত করার জন্য এখানে আসিনি। ভয় পেয়ো না। দয়া করে ভেতরে আসো। দরজাটা বন্ধ করো।
এক হাতে ব্রিফকেস অন্য হাতে গ্রোসারি ব্যাগ নিয়ে কাতাগিরি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্যাঙ বলল, মি. কাতাগিরি! দরজাটা বন্ধ করো, জুতা খোলো। একটু তাড়াহুড়া করো। আমার হাতে সময় কম।
আমেরিকায় এসে আর কিছু করি বা না করি, প্রচুর পড়ছি। মনে হচ্ছে, আমি কোথাও অবসর কাটাতে গেছি। আমার সামনে সমুদ্র, আমি নারকেলগাছের ছায়াতে বসে আছি, হাতে বই। পাশে রাখা আছে পছন্দের পানীয় (মার্গারিটা হতে পারে)। বিরক্ত করার জন্য কেউ নেই। আমি ক্লান্তিহীন পড়েই যাচ্ছি।
এইখানে এই তরুর তলে
তোমায় আমায় কৌতূহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র।
অল্প কিছু আহার মাত্র।
আরেকখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিয়ে।
(ওমর খৈয়াম)
অনুবাদ: সৈয়দ মুজতবা আলী
এখানে আমাকে বিরক্ত করার কেউ নেই। যখন পড়তে বসি বা লিখতে বসি, আমার দুই পুত্রকে ঘর থেকে বের করে তাদের মা দরজা বন্ধ করে দেয়।
পৃথিবীতে আছে লাখ লাখ অপূর্ব সব বই। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় বইয়ের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই পড়তে পারে। ষাট বছর যার আয়ু, সে যদি জন্মের দিন থেকেই প্রতিদিন একটা করে বই শেষ করে, তাহলে ষাট বছরে সে পড়বে মাত্র একুশ হাজার ছয় শ বই। আমার হিসাবে কোনো বুভুক্ষু সর্বগ্রাসী পাঠকেরও এক জীবনে দশ হাজার বই পড়া সম্ভব নয়। তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের নায়কের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘জীবন এত ছোট কেন?’
পাদটীকা
পুত্র নিষাদ আমাকে বলল, বাবা, তোমার শরীর খুবই খারাপ। তুমি কখনো একা বাথরুমে যাবে না। আমি তোমাকে হাত ধরে নিয়ে যাব। বাথরুম শেষ হওয়ার পর হাত ধরে নিয়ে আসব। যতক্ষণ বাথরুম শেষ না হয়, আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। ছোটদের লজ্জা করতে নেই। ঠিক আছে, বাবা?
আমি বললাম, ঠিক আছে। ক্যানসার ব্যাধিটির প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। এই রোগের কারণেই পুত্রের কাছ থেকে এত সুন্দর কিছু কথা শুনলাম।
(জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক)
No comments