নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে by শাকুর মজিদ

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কবে কী করে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে জড়িয়ে গেলাম, মনে করতে পারছি না। একসময় টের পেলাম যে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ আড্ডায় যে চার-পাঁচজন মানুষকে তিনি চান, আমি তাঁদের মধ্যে পড়ে গেছি। এমনও সপ্তাহ গেছে বিগত এই সাড়ে চার বছরে যে সাত দিনই সন্ধ্যায় তাঁর ঘরে আড্ডায় বসেছি।


আড্ডা মাঝেমধ্যে কমে আসত, সপ্তাহে তিন দিন। এরপর লেখালেখির চাপ পড়ে গেলে সপ্তাহে এক দিন, বৃহস্পতিবার। কিন্তু কখনো কখনো মঙ্গলবারও ফোন আসত। মাজহার ফোন করে বলে, স্যার বলছেন, আজ বৃহস্পতিবার। সুতরাং চলে আসো।
হুমায়ূন আহমেদ শামুকের মতো কঠিন একটা আবরণ বাইরে ঘিরে রেখে যেতেন। তাঁর সাক্ষাৎ বা দর্শনপ্রার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে যতই বাড়তে থাকল, ততই তিনি নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিলেন। তাঁর দখিন হাওয়ার আড্ডায় এমনও দেখেছি যে, খুব বেশি দিন তিনি কাউকে তেমন সহ্য করতে পারেননি। দীর্ঘদিনের আড্ডার সঙ্গীরাও হঠাৎ করে প্রবেশাধিকার পেতে বঞ্চিত হয়ে যেতেন। শিশুর মতো সহজ সরল ভাষায় নিজেকে খুলে ধরতেন। মুখে তা-ই বলতেন, মনে যা বিশ্বাস করতেন এবং কাজে যা করতেন।
১২টি কেমোথেরাপি দেওয়ার পর আমেরিকার ডাক্তার বললেন, এখন তাঁর কোলনটি অপারেশন করে ফেলে দেওয়ার উপযোগী হয়ে গেছে। অপারেশন হবে এক মাস পর। কুড়ি দিনের ছুটিতে তিনি দেশে যেতে পারেন। দেশে আসবেন চারটি কারণে—১. মাকে দেখবেন, ২. বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন, ৩. নুহাশপল্লীতে সময় কাটাবেন আর ৪. পাতলা ঝোলের ছোট ছোট গোল আলু দিয়ে শিং আর কই মাছ খাবেন।
যথারীতি আগমন ঘটল বাংলাদেশে। ভোররাতেই বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির হয়ে যাই আমরা। ভিআইপি লাউঞ্জের বাইরে ওত পেতে থাকা টেলিভিশন ক্যামেরার লাইন। হুমায়ূন আহমেদ সপরিবারে হাসিমুখে এসে নামেন। লাউঞ্জে বসে আড্ডা মারেন। আমার আইপ্যাড টেনে নিয়ে দাবা খেলায় বসে যান কম্পিউটারের সঙ্গে। আধা ঘণ্টা পর সকালের আলো যখন একটু ফুটে এসেছে, তখন ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি হন সাংবাদিকদের।
এমনিতে সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতেন হুমায়ূন আহমেদ। কোনো টেলিভিশনের স্টেশনে গিয়ে তিনি ইন্টারভিউ দিয়েছেন এমন কোনো দৃশ্য আমার দেখা নেই। শাওনকে বিয়ে করার পর থেকে সাংবাদিকদেরও এড়িয়ে চলা শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি তাঁর অবস্থানকে সরিয়ে এনেছে। প্রায় কুড়িটি ক্যামেরাকে একসঙ্গে তাক করা দেখে প্রথমেই যে কথাটি বলেন, তা হচ্ছে: ‘আমি অভিভূত।’
শব্দের জাদুকর এই লেখকের অসামান্য ক্ষমতা ছিল মানুষকে মুগ্ধ করার। শুধু তাঁর লেখায় নয়, তাঁর অনেক আচরণ ও ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষের মুগ্ধতাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিত। কিন্তু আজ এই প্রথম আমি দেখি যে তিনি নিজেই নিজেতে মুগ্ধ।
বিমানবন্দরে তাঁর বেশিক্ষণ থাকা হয় না সেদিন। তিনি চলে যাবেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে। সেখানে আছেন মা, বোন আর পাতলা ঝোলের জিয়ল মাছের তরকারি। সেদিন কোনো সাংবাদিকদেরও ভিড়তে দেওয়া হয়নি নুহাশপল্লীতে। এ সময়টা ছিল তাঁর একান্ত নিজের ও পরিবারের। আর কিছু একান্ত বন্ধুর। বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ছাড়ার আগে প্রাণবন্ত হুমায়ূন বলেন, চলো, নুহাশপল্লীতে। আগে ক্যানসার হাসপাতালটা করতে হবে। আলোচনা আছে। নুহাশপল্লীতে আমার প্রথম যাওয়া প্রায় সাড়ে চার বছর আগে, ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে। মাজহার আর মাসুম আমাকে নিয়ে যখন পৌঁছেন, তখন প্রায় সন্ধ্যারাত। আজ আমাদের রাতে থাকার কথা। রাতের খাবারের পর হঠাৎ দেখি, তিনি বুলবুলকে বলেন একটা টর্চ নিয়ে আসতে। একটা দুর্লভ গাছে ফুল ফুটেছে। ফুলটা দেখতে হবে।
মানুষ মুগ্ধ হয়, এমন কাজ পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। মানুষকে মুগ্ধ করানোর কত শত গল্প কতবারই না তাঁর কাছে শুনেছি। একই গল্প বারবার শুনেও কখনো বিরক্ত লাগত না। তার কারণ, গল্প বলার একটা মোহময়ী ক্ষমতা তাঁর কাছে ছিল। যেকোনো সাধারণ বিষয়কে অসাধারণ করে বলতে পারার ক্ষমতা যে শুধু তাঁর লেখায়ই ছিল, তা নয়, তাঁর সঙ্গে যাঁরা আড্ডা মেরেছেন, তাঁরাই ভালো জানতেন। আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করাতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। পরদিন সকালবেলা ঢাকায় ফিরব তার উপায় নেই। নুহাশপল্লীর পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে, মাছ ধরা পড়ল। সেটাকে নিজ হাতে তুলে আনতে হবে। এরপর এটা রান্না হবে, এটা খেয়ে তবেই ঢাকায় ফেরা। এমন আবদারকে অবহেলা করতে পারে এমন সাহস অনেকেরই থাকতে পারে, আমার ছিল না।
দুপুরে থাকার আয়োজন হয়। পুকুরপাড় থেকে ফেরত এসে দেখি নুহাশপল্লীর বড় চৌবাচ্চাটায় পানি ভরা হয়েছে। অর্গানিক ফর্মে ডিজাইন করা এবড়োখেবড়ো সুইমিং পুলের দুটি স্তর। এক পাশে কতগুলো পাথর বিছানো। পাথরগুলো টেবিল আর টুল হয়ে আছে। পাথরগুলোতে বসলে বুকপানিতে আধডোবা হওয়া যায়। টেবিলটা পানির ওপর। এখানে বসে দাবা খেলতে হবে। শরীরের তিন ভাগ পানির নিচে, এক ভাগ ওপরে।
আমরা পানিতে নামি। মাজহারের কাছে শুনেছি, একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আগমন উপলক্ষে এই চৌবাচ্চায় বিশাল আসর বসেছিল। ঢাকা থেকে অনেক নামীদামি মানুষও গিয়েছিলেন। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে এখানে বসে দাবাও খেলেছিলেন অনেকে।
আমরা দিনের আলোয় আবার নুহাশপল্লীতে গাছ দেখতে বের হই। গাছের বর্ণনাগুলো তিনি যখন দিতেন এবং গাছের বৈজ্ঞানিক নাম, তার উৎপত্তি ও ব্যবহারের কথা বলতেন; তখন মনে হতো, বোধহয় এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী গাইডের সঙ্গে কোনো বোটানিক্যাল গার্ডেনে শিক্ষাসফরে এসেছি।
নানা রকমের গাছ। কোনোটা ফুলের, কোনোটা ফলের, কোনোটা ওষুধের। মাঝেমধ্যেই পানির আধার। কোথাও বিভিন্ন রকমের মূর্তি, ভাস্কর্য। পুরো চত্বরটি শেষ করে এসে সামনের বিশাল মাঠটির দিকে রওনা হই।
এই মাঠের মাঝখানে মার্বেল পাথরের একটা বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম। তার তিন দিকে ঘেরা ফুলগাছ। মাঝখানের এই পাটাতনটি বানানো হয়েছিল তাঁর মায়ের জন্য, তিনি নুহাশপল্লীতে এলে যেন এখানে বসে নামাজ পড়তে পারেন। দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদ লাগবে সত্যি, কিন্তু আসর, মাগরিব, এশায় কোনো সমস্যা নেই। তাঁর মা যখন এই মার্বেলের বাঁধানো পাটাতনে বসে নামাজ পড়বেন, তখন তিন দিক থেকে ফুলের ঘ্রাণ এসে যেন তাঁর নাকে লাগে—এমন ব্যবস্থা এখানে। সাপের চিন্তা নেই, চারপাশে কার্বোলিক এসিড ছাড়া আছে। সাপ আসবে না।
নুহাশপলীতে জীবিত হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিন ছিল ২৫ মে, ২০১২। আগের দিন থেকে আমরা হাজির। আমরা মানে বেশি লোক নয়, অন্যপ্রকাশের মাজহার, মাসুম, কমল আর অবসর-এর আলমগীর রহমান। কথা ছিল, রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসব ঢাকায়। কিন্তু সে রাতে হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি নামছে নুহাশপল্লীর বাঁশঝাড়ে, মাঠে, বাগানে। বৃষ্টি থামলে মেঘের আড়াল থেকে কখনো বা ঝলসানো চাঁদ। এই জ্যোৎস্না আর বৃষ্টি, তার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আড্ডা আমাকে ঢাকায় ফিরতে ভুলিয়ে দেয়। বৃষ্টি থামলে আমরা পুকুরপাড়ে চলে আসি। সেখানে দুটি নতুন কটেজ বানানো হয়েছে। কটেজগুলোর প্রশস্ত বারান্দা দিঘিমুখী। একটির মধ্যে ফ্লোরের ওপর আমরা সবাই বসে পড়ি। শাওন গান করে। হুমায়ূন আহমেদ নানা রকম চুটকি বলেন। আসরের কোথাও কিন্তু মনে হয়নি যে, মরণব্যাধিকে বুকে চেপে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষই আমাদের আড্ডার মধ্যমণি।
মাঝরাতের দিকে আমরা ঘরে ফিরে আসার আগে আরেকবার এসে বসি নুহাশপল্লীর মাঝখানের নামাজের জায়গাটাতে। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাত, জ্যোৎস্না, চাঁদ মিলেমিশে একাকার।
পরদিন ২৫ মে, ২০১২, অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। ঘরের এসি কাজ করেনি। আমি ভোরের ঠান্ডা বাতাস নেওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি, হুমায়ূন আহমেদ একা একা হাঁটছেন। আজ রাতেই ঢাকা ফিরবেন, হয়তো সে কারণে ভোরের আলোর নুহাশপল্লীটাকে দেখে নেওয়ার জন্য তাঁর এই পায়চারি। সকাল তখন সাতটাও হয়নি। একটি টেলিভিশনের দুটি গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে। গেটের কাছ থেকেই ট্রাইপডে ক্যামেরা ফিট করে তাক করে আছে স্যারের দিকে। সুইমিং পুলের পাশে একটা চৌচালা দেয়ালছাড়া ছাউনি। এখানে কফি এসেছে। সাংবাদিকদের এবার বারণ করা হলো, এখন যেন কেউ না আসেন এদিকে। সকাল নয়টা হতেই নুহাশপল্লীর ভেতরে কুড়িটির মতো গাড়ি ঢুকে গেছে। ছয়-সাতটা টেলিভিশনের ক্রু, পত্রিকার সাংবাদিক, সম্পাদক, ফটোগ্রাফার। কেউ কেউ এসেছেন পুরো পরিবার নিয়ে। কেউ কেউ নিজে রান্না করে নিয়ে এসেছেন।
এই কুড়ি দিনের সফরে হুমায়ূন আহমেদের নিজের ঘরে রান্না হয়নি একবারও। সব খাবারই এসেছে বন্ধুবান্ধব-স্বজনদের কাছ থেকে। শুধু নুহাশপল্লীর রন্ধনশালাটা ব্যস্ত হতো, দুই কিস্তিতে যে কদিন সেখানে ছিলেন। সকাল ১০টা থেকে সাংবাদিকদের নিয়ে সফরে বের হন হুমায়ূন আহমেদ। যেতে যেতে নানা কথা। এটাই সাক্ষাৎকার। প্রায় সব সাংবাদিকই চাইছেন একান্তে কিছু কথা নিতে। সবার সে সুযোগ নেই। নিষাদকে নিয়ে একবার এসে বসেন বড় কুয়োটার পাশে। কুয়োর সামনে একটি চৌবাচ্চায় এক মৎস্যকন্যার ভাস্কর্য। পাঁচ বছরের ছেলে নিষাদকেও দেখান কিছু গাছ, কিছু ফুল।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছান দিঘির কাছে। এই দিঘির একটি নামও দিয়েছেন তিনি। দিঘি লীলাবতী। লীলাবতী নামে তাঁর এক কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের গর্ভে। সন্তানটি জন্মের সময় মারা গিয়েছিল। এই মেয়ের নামে নাম রেখেছেন দিঘির। তার পাড়ে শানবাঁধানো ঘাটের পাশে মার্বেল পাথরে লিখে রেখেছেন এপিটাফ, রবীন্দ্রনাথের লাইন—‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’।
হুমায়ূন আহমেদ এই স্মৃতিস্তম্ভটি দুই হাতে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে থাকেন। দূরে তির তাক করে রাখা শিকারিদের মতো ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা, তাঁর কোনো দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি পাশে। কয়েক মিনিট পর বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম।
লোকটিকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু এবার দেখি, তাঁর চোখ দুটো কেমন যেন ছলছল করে আসছে। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের কাছে হাত রাখলেন। আমি মন ভোলানোর জন্য দিঘিতে কী কী মাছ আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করি। হুমায়ূন আহমেদ আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দরকার মনে করেন না।

No comments

Powered by Blogger.