দুঃসংবাদের আগে দু পঙ্ক্তি by সানাউল হক খান
বেইজিং অলিম্পিক এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সাফ গেমস—এ দুটি চমক-জাগানো ব্যর্থতা (ইভেন্টগত অর্থে তিনটি) নিয়ে আমাদের মিডিয়াকুল তেমন কোনো উত্তপ্ত রচনা সারল্য উপহার দিতে পারেনি, যেগুলো পাঠ করলে সামান্যতম অহংবোধে আঁচড় পড়তে পারত। আসলে হাল-আমলে ক্রিকেটের সঞ্জীবনী ক্ষুধাটায় একটু বেশি আস্বাদিত হয়েছি।
এর কারণ পেশাদারি অভিনিবেশের ছোঁয়াটা আমাদের সীমাবদ্ধ ক্রীড়াপ্রেমকে একটু যেন বেশিই মনেপ্রাণে জাগ্রত রেখেছে, সজীব রেখেছে। ভলিবল, হকি, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি, সাঁতার, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, ভারোত্তোলন, টেবিল টেনিস এমনকি ‘জাতীয় খেলা’ কাবাডির ক্রমাবনমন—কোনো কিছুরই অধোগতির ন্যূনতম অস্থিরতাও আমাদের কলমকে শরমের কাগজে, হতমানে টানতে পারেনি। মূলত সম্প্রসারিত কিংবা বৈচিত্র্যময় খেলাধুলার জগৎটার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের লেখিয়েদের তেমন কোনো মেলবন্ধন ঘটেনি। এরা যতটা চলতি হাওয়ার ঘুড়ি, তার চেয়ে বেশি অগ্রমাগমনের সুড়সুড়িতে পুলকিত। অবশ্য তা হওয়ারই কথা। ক্রিকেটটা তো হচ্ছে! এ কারণেই বোধকরি বিশ্বের নামীদামি দেশগুলো বাংলাদেশের পতাকাটা ভালোই চেনে।
ফুটবল তো নাকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচেবর্তে আছে বাঙালি-রক্তের ধ্রুবসত্য, শারীরিক রসায়নের টানে। কোনো আণবিক-দানবিক শক্তি না হোক, আটপৌরে বাঙালির হারানো ফুটো-পয়সাটা তো পাবে? সে যা-ই হোক, ফুটবল তার পথ হারিয়ে পথ খুঁজছে এটা বোঝা গেলেও বর্তমান আর্থিক মেরুকরণে মিলতে পারেনি। পারবে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কোনো সাধু-সমীকরণেও সেটা পড়ে না। প্রখর পেশাদারি আর অর্থায়নের উত্তাপেও স্যাঁতসেঁতে যেন আমাদের ফুটবল!
এ লেখার প্রারম্ভিক সূত্রটা কিন্তু খোলাসা হলো না।
সংক্ষেপে বলি:
যে কিউবান মুষ্টিযোদ্ধাদের ভয়ে আমেরিকান বক্সাররা ঢোক গিলেছে বারবার, দলগতভাবে ৭-৮টি ওজন ক্যাটাগরিতে যাদের গলায় ঝুলত সুবর্ণ মাল্য, তারা, কী আশ্চর্য, বেইজিং অলিম্পিকে একটিও সোনা পায়নি। বরং ওস্তাদ আর পরামর্শকের ভূমিকা পালন করে একটি ব্রোঞ্জ পাইয়ে দিয়েছে। বিষয়টা ফিদেল কাস্ত্রোর চেয়ে আমাকে বেশি আহত করেছে। সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশক থেকে শূন্য দশকেরও দুটি অলিম্পিকে কিউবার মুষ্টিযুদ্ধে যে শিল্প আর সোনা জেতার কাঙ্ক্ষিত আকুতির সংমিশ্রণ লক্ষ করেছি, তা এককথায় অপূর্ব। সেই কিউবা বেইজিং-এ সোনা জিততে ব্যর্থ। ভাবা যায়?
দ্বিতীয় ব্যর্থতা আরও দুঃখজনক আমার কাছে:
সাফ গেমসের মতো পৃথিবীর দুর্বলতম আসরে সাঁতার ও অ্যাথলেটিকসে স্বর্ণচ্যুত বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের কাছেই নিজে নপুংশক কবিতা হয়েছি বারবার:
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে গাইতে হলো: ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে...’ অথবা আক্ষেপ করতে হলো: ‘কী পাই নি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’ সেদিনের মতো আমার বুকের দীর্ঘশ্বাস, অন্য আর কোন বুকে গুমরেছিল, জানি না। হ্যাঁ সবকিছু হারানোর পরও যেন নিজেকে হারানো এক ভয়াবহ দুঃখ: নদী-নালার দেশ বলেই সাঁতারে সোনা জিতলে, এমন গবেট-উচ্চারণ করতে রাজি নই। খেলাধুলায় যে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতি আর উন্নতির কর্ম-কসরত ঢুকেছে যে পঞ্জিকানির্ভর পরামর্শ ঢুকেছে, তাতে কোনো ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের ধ্যান-দীক্ষা উজ্জীবিত হয়নি, যা হয়েছে, সে শুধু অর্থের অপচয়। এই সিলেবাস আহরণে আমাদের অন্ধ-পারদর্শিতার কাছে বিশ্বের যেকোনো দেশ হার মানবে। সম্ভবত ক্রীড়াবিজ্ঞানে সচকিত বলেই না-লেখার বদ-অভ্যাস আমাকে গিলে ফেলছে ক্রমশ। মন খারাপের বিষ-মাখানো অব্যর্থ বর্শাফলা ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আর আমিও কষে চলেছি সেই অঙ্ক যার ফলাফল বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো শূন্য!
মাঝে মাঝে ভাবি, এ দেশে একটাও কি পাগল নেই, যে সারা দিন খাবে আর ঘুমাবে, ঘুম থেকে উঠে শুধু দৌড়াবে কিংবা সাঁতরাবে অথবা বালির বস্তায় ঘুষি মারতে মারতে নিজেকে নিঃশেষ করে বলবে: একজন ওস্তাদ চাই, একবিংশের ওস্তাদ! নেই? সে পাগলের জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়াব আমিও:
আমার দেহপালক সেও পাগলের ডানা
এই দুঃসংবাদ কার-না জানা?
ফুটবল তো নাকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচেবর্তে আছে বাঙালি-রক্তের ধ্রুবসত্য, শারীরিক রসায়নের টানে। কোনো আণবিক-দানবিক শক্তি না হোক, আটপৌরে বাঙালির হারানো ফুটো-পয়সাটা তো পাবে? সে যা-ই হোক, ফুটবল তার পথ হারিয়ে পথ খুঁজছে এটা বোঝা গেলেও বর্তমান আর্থিক মেরুকরণে মিলতে পারেনি। পারবে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কোনো সাধু-সমীকরণেও সেটা পড়ে না। প্রখর পেশাদারি আর অর্থায়নের উত্তাপেও স্যাঁতসেঁতে যেন আমাদের ফুটবল!
এ লেখার প্রারম্ভিক সূত্রটা কিন্তু খোলাসা হলো না।
সংক্ষেপে বলি:
যে কিউবান মুষ্টিযোদ্ধাদের ভয়ে আমেরিকান বক্সাররা ঢোক গিলেছে বারবার, দলগতভাবে ৭-৮টি ওজন ক্যাটাগরিতে যাদের গলায় ঝুলত সুবর্ণ মাল্য, তারা, কী আশ্চর্য, বেইজিং অলিম্পিকে একটিও সোনা পায়নি। বরং ওস্তাদ আর পরামর্শকের ভূমিকা পালন করে একটি ব্রোঞ্জ পাইয়ে দিয়েছে। বিষয়টা ফিদেল কাস্ত্রোর চেয়ে আমাকে বেশি আহত করেছে। সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশক থেকে শূন্য দশকেরও দুটি অলিম্পিকে কিউবার মুষ্টিযুদ্ধে যে শিল্প আর সোনা জেতার কাঙ্ক্ষিত আকুতির সংমিশ্রণ লক্ষ করেছি, তা এককথায় অপূর্ব। সেই কিউবা বেইজিং-এ সোনা জিততে ব্যর্থ। ভাবা যায়?
দ্বিতীয় ব্যর্থতা আরও দুঃখজনক আমার কাছে:
সাফ গেমসের মতো পৃথিবীর দুর্বলতম আসরে সাঁতার ও অ্যাথলেটিকসে স্বর্ণচ্যুত বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের কাছেই নিজে নপুংশক কবিতা হয়েছি বারবার:
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে গাইতে হলো: ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে...’ অথবা আক্ষেপ করতে হলো: ‘কী পাই নি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’ সেদিনের মতো আমার বুকের দীর্ঘশ্বাস, অন্য আর কোন বুকে গুমরেছিল, জানি না। হ্যাঁ সবকিছু হারানোর পরও যেন নিজেকে হারানো এক ভয়াবহ দুঃখ: নদী-নালার দেশ বলেই সাঁতারে সোনা জিতলে, এমন গবেট-উচ্চারণ করতে রাজি নই। খেলাধুলায় যে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতি আর উন্নতির কর্ম-কসরত ঢুকেছে যে পঞ্জিকানির্ভর পরামর্শ ঢুকেছে, তাতে কোনো ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের ধ্যান-দীক্ষা উজ্জীবিত হয়নি, যা হয়েছে, সে শুধু অর্থের অপচয়। এই সিলেবাস আহরণে আমাদের অন্ধ-পারদর্শিতার কাছে বিশ্বের যেকোনো দেশ হার মানবে। সম্ভবত ক্রীড়াবিজ্ঞানে সচকিত বলেই না-লেখার বদ-অভ্যাস আমাকে গিলে ফেলছে ক্রমশ। মন খারাপের বিষ-মাখানো অব্যর্থ বর্শাফলা ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আর আমিও কষে চলেছি সেই অঙ্ক যার ফলাফল বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো শূন্য!
মাঝে মাঝে ভাবি, এ দেশে একটাও কি পাগল নেই, যে সারা দিন খাবে আর ঘুমাবে, ঘুম থেকে উঠে শুধু দৌড়াবে কিংবা সাঁতরাবে অথবা বালির বস্তায় ঘুষি মারতে মারতে নিজেকে নিঃশেষ করে বলবে: একজন ওস্তাদ চাই, একবিংশের ওস্তাদ! নেই? সে পাগলের জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়াব আমিও:
আমার দেহপালক সেও পাগলের ডানা
এই দুঃসংবাদ কার-না জানা?
No comments