আমাদের উচ্চশিক্ষার হাল by গোলাম কবির
সাধারণভাবে আমরা নাচ-গান-নাটক তথা বিনোদনের মাধ্যমগুলোকে সংস্কৃতির আওতায় নিয়ে আসি। তবে জীবন-সংস্কৃতির পরিধি ওই মুষ্টিমেয় বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের যাপিত জীবনের পুরোটাই সংস্কৃতির আওতায় আসে। এ কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিক সংস্কৃতি, ব্যবসায়িক সংস্কৃতি, কৃষি সংস্কৃতি বা রাষ্ট্রীয় সব
কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহায়ক কর্মীবাহিনীর সংস্কৃতি- এককথায় আমলার সংস্কৃতি যেমন আছে, তেমনি আছে শিক্ষার সংস্কৃতি। আমাদের বিবেচনায় শিক্ষার সংস্কৃতি সবার ঊধর্ে্ব। কারণ এর মাধ্যমে একটি জাতির পরিচয় ব্যাপকভাবে পরিস্ফুট হয়।
আগ্রাসী ব্রিটিশ শক্তির লক্ষ্য ছিল, এ দেশীয় অনুগত শিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা। সে উদ্দেশ্যে উনিশ শতকে কলকাতায় এবং বিশ শতকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তারা, যা ছিল তাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ছিল মুক্ত জ্ঞানচর্চা। ইতিহাস বলে, এই মুক্ত জ্ঞানচর্চা তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল আব্বাসীয় যুগের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জাতি, ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে পণ্ডিতবর্গ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সব বিষয় মুক্ত পরিমণ্ডলে চর্চা করতেন। আমরা ইতিহাসের সেই গভীরে যাব না, তবে বলব, কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদা এ অঞ্চলে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং শিক্ষার সংস্কৃতি প্রসারে যে অবদান রেখেছিল, তা অক্ষুণ্ন থাকেনি। কেন তা আর থাকল না, তার জবাবে হয়তো কেউ কেউ বলবেন সময়ের পরিবর্তন বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা। আমরা তা অস্বীকার না করে এর সঙ্গে আমাদের ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ সংযোজন করতে চাই।
সবার জানা, রাষ্ট্রীয় অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা বিত্তবানদের নিঃস্বার্থ অর্থায়ন জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষার সংস্কৃতিতে কী অপরিসীম অবদান রাখে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে যেসব জাতি অগ্রাধিকার দিয়েছে, তারা সেখান থেকে তাদের সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত করতে সমর্থ হয়েছে। আমরা তার কতটুকু পেরেছি, তা খতিয়ে দেখতে হলে কেবল সময় এবং মূল্যবোধের কথা ভাবলেই চলবে না। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু সমুন্নত রাখতে পেরেছি অথবা না রাখতে পারার কারণে আমাদের অবস্থান কোথায়, তা বোধ করি বিচার করার সময় হয়েছে।
প্রথমেই আমরা কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছি। সে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগ। তারপর কিছু মানুষের অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তের বিষময় ফল হিসেবে আমরা পেলাম পাকিস্তান- আমাদের জাতীয়তার সিদ্ধান্ত অসমাপ্ত রেখেই। বাঙালি, পাঠান, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এককাতারে শামিল করার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন, 'অতীত ভুলে গিয়ে এখন আমরা পাকিস্তানি।' তাঁর জানা উচিত ছিল, ঘোষণা দিয়ে জাতীয়তার পরিচয় নির্ধারণ করা যায় না। এই খিচুড়ি জাতীয়তার নাগপাশে পূর্ব বাংলার ভাগে প্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমাদের নবীন দেশের জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র ভরসাস্থল। তাতেও আমাদের জাতীয়তার সংকট কাটল না। পাকিস্তানি তাহজিব-তমদ্দুন প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশীয় কিছু শিক্ষিত মানুষ তাদের সঙ্গে হাত মেলাল। বাংলা ভাষার ব্যবচ্ছেদে উঠেপড়ে লাগল তারা। সাতচলি্লশের আগেই ভিনদেশি মানুষ উর্দুকে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক তথা শাসন, পঠন-পাঠন প্রভৃতির একমাত্র বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। একুশ সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করলেও বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে রইল পাকিস্তানি চক্রের কলোনিসুলভ দমনের জাঁতাকলে। পরের ইতিহাস সবার জানা যে কিভাবে একুশের পথ ধরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে যেমন ভিনদেশিরা আমাদের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করতে চেয়েছিল, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার সময় ভিনদেশে বসে আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশি করার পক্ষে রায় দিয়েছিল কেউ কেউ। হাজার বছরের স্বীকৃত বাঙালি জাতীয়তাকে তারা আবার পাকিস্তানি লেবাস লাগিয়ে বাংলাদেশি করতে চেয়েছিল, পারেনি; কিন্তু হাল ছাড়েনি।
আমরা আবার ফিরে যাই পাকিস্তান-পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখা যাবে, ওই সময় বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন চেতনার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে নিজেদের পরিশীলিত করার সাধনা গতি পাচ্ছিল। পাকিস্তান-উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ধারা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও একেবারে অবরুদ্ধ হয়নি। তাই তখনকার দিনে যাঁরা শিক্ষা-সংস্কৃতির পুরোধা ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই প্রগতিশীল। তাঁদের কেউ কেউ এখনো কর্মতৎপর, তবে ছোট হয়ে আসছে তাঁদের সংখ্যা।
জাতীয়তার সংকটের দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আট বছরের মাথায়। শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার মানসে ধর্মীয় পরিচয়টুকু বাদ দিয়ে যার নাম হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। একঝাঁক সংস্কৃতি-সচেতন শিক্ষক একে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন; কিন্তু পঁচাত্তরের পর জাতীয়তার বিভ্রান্তিতে আত্মপরিচয়ের শেকড় সন্ধান বাধাগ্রস্ত হলো। যার ধারাবাহিকতা আজও বহমান। বাঙালির ঘরে ফেরা বন্ধুর হয়ে গেল। আলোচ্য প্রেক্ষাপট সামনে রেখে আমরা আজকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটু উঁকি দিয়ে আসব।
সচেতন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝে, যেখানে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী এবং আলোচিত মানুষের সমাবেশ ঘটবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মেধাবীদের সমাবেশ ঘটেছিল। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে তাতে ভাটা পড়ে। এর অন্যতম কারণ, আত্মপরিচয় তথা জাতীয় চেতনার শেকড়বিচ্যুতি।
সবার জানা পঁচাত্তরের পর রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের ঘটনাপুঞ্জ। রাজনীতির আবরণে দেশের শাসনব্যবস্থা ধারা পরিবর্তন করে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। রাজনীতি কঠিন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ান বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু শিক্ষক। ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও '৯০ পর্যন্ত সে ধারা বজায় থাকে। '৯০-এর পর শুরু হয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা। 'এফিলিয়েটেড' বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভার কমানোর জন্য নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত হলো। এখানেও আগের সহযোগিতাকারী ঘরানার শিক্ষকরা নিজেদের জায়গা করে নিলেন। আমরা লক্ষ করেছি, '৭৩-এর অ্যাক্ট প্রবর্তিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা খোলাখুলিভাবে লাল-নীল-সাদা-হলুদসহ নানা বাহারি নামে রাজনৈতিক সংগঠনের একেকটি কার্যালয়ে রূপান্তরিত হলো। ফলে জ্ঞানচর্চা কিংবা সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের দিকটি উপেক্ষিত হতে থাকল। সম্ভবত এ দিকটি লক্ষ করেই দূরদর্শী রাজনীতিকরা আশঙ্কা করেছিলেন, স্বাধীন দেশের এই অভূতপূর্ব আইন কতখানি তার সম্মান রক্ষা করে চলতে পারবে, সে ব্যাপারে।
স্বাধীনতার পর মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং তাৎক্ষণিক বেশি টাকা উপার্জনের বিদ্যা অর্জনের জন্য উদ্বাহু হয়ে ওঠে। তারা বুয়েট, মেডিক্যাল কিংবা আইবিএ-বিবিএতে পড়ার জন্য বেশি আগ্রহী হয়। যারা সেখানে সুবিধা করতে পারে না (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া), তারাই অবিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি, রাবি, জাবি, চবি) ভর্তি হয়। লেখা বাহুল্য, ১৯৬২ সালের পর শিক্ষাকে বহুমুখী করার জন্য মাধ্যমিককে প্রধানত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্যে বিভক্ত করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ মেধাবী ছাত্র বিজ্ঞান শাখায় পড়তে শুরু করে। বাকিরা কলা ও বাণিজ্য শাখায়। এদের মধ্যে যারা মেধাবী তারা কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। এখনো হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় পড়ার পর মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, এমনকি বিজ্ঞানের ভালো কোনো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না করতে পেরে অনেকটা ইচ্ছার প্রতিকূলে অন্যান্য অনুষদে ভর্তি হয়। এদের অনেকে প্রথম শ্রেণীও পেয়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পথ খুলে যায়। এমনকি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হতে পারে না, তারা বাইরে থেকে অনার্স পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার পর একটা পিএইচডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ছাত্রজীবনে তেমন মেধার পরিচয় না দেওয়া সত্ত্বেও একটা পিএইচডির গুণে রাতারাতি মেধাবী হওয়া সহজ নয়। এ সত্য বোধ করি বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা শিক্ষার সংস্কৃতিতে বড় রকমের অবদান পাওয়া কঠিন।
আমরা জানি, প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চাকরির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুমুখী যাচাই-বাছাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সর্বাপেক্ষা মেধাবীদের কেবল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে এমনটি চলে এলেও এর অবসান হওয়া দরকার। কেননা, শিক্ষার সংস্কৃতিকে এখন রাজনীতির সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছে। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসছে, তাদের সমর্থকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষার পাদপীঠগুলোতে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রথম ও অন্যতম পদক্ষেপ হওয়া দরকার নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতির পরিবর্তন। ড. শহীদুল্লাহর মতো বরেণ্য ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত প্রফেসর হয়ে নিয়মিত চাকরি শেষ করতে পারেননি। এখন যেদিকে তাকাই, প্রফেসর আর প্রফেসর। তা হোক, এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু দেখতে হবে যেন যথাযোগ্য ব্যক্তি ওই অভিধায় অভিহিত হতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, সুতরাং প্রাথমিক নিয়োগের সময় ধারাবাহিকভাবে সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ বা শ্রেণী অথবা সমপর্যায়ের যোগ্যতা থাকা বাধ্যতামূলক হতে হবে। নিরপেক্ষ বাছাই-ব্যবস্থায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে (শূন্যপদে নিয়োগের সময়) পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা, আত্মীয়তার সূত্র বা অন্য কোনো সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি যেন প্রাধান্য না পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এমনিভাবে প্রতিটি ধাপে পদোন্নতির সময় এমন কিছু নিয়ম-নীতি থাকবে, যার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায় যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কতটুকু পারদর্শী হয়ে উঠেছেন।
আমাদের বিশ্বাস, কঠিন হলেও জাতীয় স্বার্থে এসব নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করা গেলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হতে পারবে অচিরেই। সেই সঙ্গে লাল-নীলের সমারোহ কমবে এবং কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারাও বন্ধ হবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
আগ্রাসী ব্রিটিশ শক্তির লক্ষ্য ছিল, এ দেশীয় অনুগত শিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা। সে উদ্দেশ্যে উনিশ শতকে কলকাতায় এবং বিশ শতকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তারা, যা ছিল তাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ ছিল মুক্ত জ্ঞানচর্চা। ইতিহাস বলে, এই মুক্ত জ্ঞানচর্চা তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল আব্বাসীয় যুগের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জাতি, ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে পণ্ডিতবর্গ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সব বিষয় মুক্ত পরিমণ্ডলে চর্চা করতেন। আমরা ইতিহাসের সেই গভীরে যাব না, তবে বলব, কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদা এ অঞ্চলে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং শিক্ষার সংস্কৃতি প্রসারে যে অবদান রেখেছিল, তা অক্ষুণ্ন থাকেনি। কেন তা আর থাকল না, তার জবাবে হয়তো কেউ কেউ বলবেন সময়ের পরিবর্তন বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা। আমরা তা অস্বীকার না করে এর সঙ্গে আমাদের ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ সংযোজন করতে চাই।
সবার জানা, রাষ্ট্রীয় অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা বিত্তবানদের নিঃস্বার্থ অর্থায়ন জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষার সংস্কৃতিতে কী অপরিসীম অবদান রাখে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে যেসব জাতি অগ্রাধিকার দিয়েছে, তারা সেখান থেকে তাদের সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত করতে সমর্থ হয়েছে। আমরা তার কতটুকু পেরেছি, তা খতিয়ে দেখতে হলে কেবল সময় এবং মূল্যবোধের কথা ভাবলেই চলবে না। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু সমুন্নত রাখতে পেরেছি অথবা না রাখতে পারার কারণে আমাদের অবস্থান কোথায়, তা বোধ করি বিচার করার সময় হয়েছে।
প্রথমেই আমরা কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছি। সে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগ। তারপর কিছু মানুষের অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তের বিষময় ফল হিসেবে আমরা পেলাম পাকিস্তান- আমাদের জাতীয়তার সিদ্ধান্ত অসমাপ্ত রেখেই। বাঙালি, পাঠান, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এককাতারে শামিল করার জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন, 'অতীত ভুলে গিয়ে এখন আমরা পাকিস্তানি।' তাঁর জানা উচিত ছিল, ঘোষণা দিয়ে জাতীয়তার পরিচয় নির্ধারণ করা যায় না। এই খিচুড়ি জাতীয়তার নাগপাশে পূর্ব বাংলার ভাগে প্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমাদের নবীন দেশের জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র ভরসাস্থল। তাতেও আমাদের জাতীয়তার সংকট কাটল না। পাকিস্তানি তাহজিব-তমদ্দুন প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশীয় কিছু শিক্ষিত মানুষ তাদের সঙ্গে হাত মেলাল। বাংলা ভাষার ব্যবচ্ছেদে উঠেপড়ে লাগল তারা। সাতচলি্লশের আগেই ভিনদেশি মানুষ উর্দুকে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক তথা শাসন, পঠন-পাঠন প্রভৃতির একমাত্র বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। একুশ সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করলেও বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে রইল পাকিস্তানি চক্রের কলোনিসুলভ দমনের জাঁতাকলে। পরের ইতিহাস সবার জানা যে কিভাবে একুশের পথ ধরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে যেমন ভিনদেশিরা আমাদের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করতে চেয়েছিল, তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার সময় ভিনদেশে বসে আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশি করার পক্ষে রায় দিয়েছিল কেউ কেউ। হাজার বছরের স্বীকৃত বাঙালি জাতীয়তাকে তারা আবার পাকিস্তানি লেবাস লাগিয়ে বাংলাদেশি করতে চেয়েছিল, পারেনি; কিন্তু হাল ছাড়েনি।
আমরা আবার ফিরে যাই পাকিস্তান-পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেখা যাবে, ওই সময় বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন চেতনার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে নিজেদের পরিশীলিত করার সাধনা গতি পাচ্ছিল। পাকিস্তান-উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ধারা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও একেবারে অবরুদ্ধ হয়নি। তাই তখনকার দিনে যাঁরা শিক্ষা-সংস্কৃতির পুরোধা ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই প্রগতিশীল। তাঁদের কেউ কেউ এখনো কর্মতৎপর, তবে ছোট হয়ে আসছে তাঁদের সংখ্যা।
জাতীয়তার সংকটের দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আট বছরের মাথায়। শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার মানসে ধর্মীয় পরিচয়টুকু বাদ দিয়ে যার নাম হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। একঝাঁক সংস্কৃতি-সচেতন শিক্ষক একে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন; কিন্তু পঁচাত্তরের পর জাতীয়তার বিভ্রান্তিতে আত্মপরিচয়ের শেকড় সন্ধান বাধাগ্রস্ত হলো। যার ধারাবাহিকতা আজও বহমান। বাঙালির ঘরে ফেরা বন্ধুর হয়ে গেল। আলোচ্য প্রেক্ষাপট সামনে রেখে আমরা আজকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটু উঁকি দিয়ে আসব।
সচেতন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝে, যেখানে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী এবং আলোচিত মানুষের সমাবেশ ঘটবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মেধাবীদের সমাবেশ ঘটেছিল। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে তাতে ভাটা পড়ে। এর অন্যতম কারণ, আত্মপরিচয় তথা জাতীয় চেতনার শেকড়বিচ্যুতি।
সবার জানা পঁচাত্তরের পর রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের ঘটনাপুঞ্জ। রাজনীতির আবরণে দেশের শাসনব্যবস্থা ধারা পরিবর্তন করে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। রাজনীতি কঠিন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ান বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু শিক্ষক। ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও '৯০ পর্যন্ত সে ধারা বজায় থাকে। '৯০-এর পর শুরু হয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা। 'এফিলিয়েটেড' বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভার কমানোর জন্য নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত হলো। এখানেও আগের সহযোগিতাকারী ঘরানার শিক্ষকরা নিজেদের জায়গা করে নিলেন। আমরা লক্ষ করেছি, '৭৩-এর অ্যাক্ট প্রবর্তিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা খোলাখুলিভাবে লাল-নীল-সাদা-হলুদসহ নানা বাহারি নামে রাজনৈতিক সংগঠনের একেকটি কার্যালয়ে রূপান্তরিত হলো। ফলে জ্ঞানচর্চা কিংবা সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের দিকটি উপেক্ষিত হতে থাকল। সম্ভবত এ দিকটি লক্ষ করেই দূরদর্শী রাজনীতিকরা আশঙ্কা করেছিলেন, স্বাধীন দেশের এই অভূতপূর্ব আইন কতখানি তার সম্মান রক্ষা করে চলতে পারবে, সে ব্যাপারে।
স্বাধীনতার পর মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং তাৎক্ষণিক বেশি টাকা উপার্জনের বিদ্যা অর্জনের জন্য উদ্বাহু হয়ে ওঠে। তারা বুয়েট, মেডিক্যাল কিংবা আইবিএ-বিবিএতে পড়ার জন্য বেশি আগ্রহী হয়। যারা সেখানে সুবিধা করতে পারে না (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া), তারাই অবিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি, রাবি, জাবি, চবি) ভর্তি হয়। লেখা বাহুল্য, ১৯৬২ সালের পর শিক্ষাকে বহুমুখী করার জন্য মাধ্যমিককে প্রধানত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্যে বিভক্ত করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ মেধাবী ছাত্র বিজ্ঞান শাখায় পড়তে শুরু করে। বাকিরা কলা ও বাণিজ্য শাখায়। এদের মধ্যে যারা মেধাবী তারা কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। এখনো হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় পড়ার পর মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, এমনকি বিজ্ঞানের ভালো কোনো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না করতে পেরে অনেকটা ইচ্ছার প্রতিকূলে অন্যান্য অনুষদে ভর্তি হয়। এদের অনেকে প্রথম শ্রেণীও পেয়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পথ খুলে যায়। এমনকি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হতে পারে না, তারা বাইরে থেকে অনার্স পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার পর একটা পিএইচডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ছাত্রজীবনে তেমন মেধার পরিচয় না দেওয়া সত্ত্বেও একটা পিএইচডির গুণে রাতারাতি মেধাবী হওয়া সহজ নয়। এ সত্য বোধ করি বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা শিক্ষার সংস্কৃতিতে বড় রকমের অবদান পাওয়া কঠিন।
আমরা জানি, প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চাকরির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুমুখী যাচাই-বাছাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সর্বাপেক্ষা মেধাবীদের কেবল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে এমনটি চলে এলেও এর অবসান হওয়া দরকার। কেননা, শিক্ষার সংস্কৃতিকে এখন রাজনীতির সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছে। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসছে, তাদের সমর্থকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষার পাদপীঠগুলোতে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রথম ও অন্যতম পদক্ষেপ হওয়া দরকার নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতির পরিবর্তন। ড. শহীদুল্লাহর মতো বরেণ্য ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত প্রফেসর হয়ে নিয়মিত চাকরি শেষ করতে পারেননি। এখন যেদিকে তাকাই, প্রফেসর আর প্রফেসর। তা হোক, এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু দেখতে হবে যেন যথাযোগ্য ব্যক্তি ওই অভিধায় অভিহিত হতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, সুতরাং প্রাথমিক নিয়োগের সময় ধারাবাহিকভাবে সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ বা শ্রেণী অথবা সমপর্যায়ের যোগ্যতা থাকা বাধ্যতামূলক হতে হবে। নিরপেক্ষ বাছাই-ব্যবস্থায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে (শূন্যপদে নিয়োগের সময়) পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা, আত্মীয়তার সূত্র বা অন্য কোনো সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি যেন প্রাধান্য না পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এমনিভাবে প্রতিটি ধাপে পদোন্নতির সময় এমন কিছু নিয়ম-নীতি থাকবে, যার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায় যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কতটুকু পারদর্শী হয়ে উঠেছেন।
আমাদের বিশ্বাস, কঠিন হলেও জাতীয় স্বার্থে এসব নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করা গেলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হতে পারবে অচিরেই। সেই সঙ্গে লাল-নীলের সমারোহ কমবে এবং কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারাও বন্ধ হবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
No comments