হুমায়ূন আহমেদ একটি স্মৃতি by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

দিন-তারিখ মনে নেই। প্রায় ১৮-২০ বছর আগের কথা। আমি তখন দৈনিক পূর্বকোণে কাজ করি। একদিন জলসা সিনেমা হল (অধুনালুপ্ত) থেকে কেউ একজন ফোন করে জানালেন, আগুনের পরশমণি ছবির মুক্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ, একজন রিপোর্টার পাঠালে ভালো হয়।


আমি রিপোর্টার নই, তখন ফিচার বিভাগে কাজ করি। নিজের আগ্রহেই ছুটে গেলাম জলসা সিনেমা হলে। টিকিট কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। দোতলায় গিয়ে দেখলাম হল ব্যবস্থাপকের কক্ষে হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে ভক্ত-অনুরাগীদের জটলা। তখন বয়স কম, ভিড় পেরিয়ে সোজা তাঁর সামনে গিয়ে নিজের নাম ও সাংবাদিক পরিচয় জানালাম তাঁকে। তিনি তখন অন্যদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত, ইশারায় বসতে বললেন। বসলাম না, এক কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। যথেষ্ট পাত্তা না পেয়ে একটু ক্ষোভ বা অভিমান হয়েছিল, মফস্বলের তরুণ লেখকদের যা হয় (তুমি না হয় অনেক জনপ্রিয় লেখক, তাই বলে আমি কী ফেলনা!)
এর মধ্যে প্রেক্ষাগৃহের একজন কর্মী এসে জানিয়ে গেলেন প্রদর্শনী শুরুর সময় হয়েছে। এবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জটলা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন, ‘চলেন’। আমার হাত ধরেই নেমে এলেন নিচে। প্রেক্ষাগৃহের একেবারে সামনের সারিতে (সে সারিকে তখন বলা হতো ‘থার্ড ক্লাস’) এসে বসলেন একটি আসনে। তাঁর পাশে আমি। হলের একজন কর্মী চা দিয়ে গেলেন দুই কাপ। কী যে সম্মানিত বোধ করেছিলাম সেদিন, আজ এত বছর পরেও তা অনুভব করতে পারি।
আগুনের পরশমণি ছবির প্রদর্শনী শুরু হলো। দেখলাম, নিজের ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন তিনি, এমনকি দু-একবার চোখ মুছছেন দেখে আমি বিস্মিত। ছবি চলছে। মুক্তিযুুদ্ধ নিয়ে ছবি। দর্শক হিসেবে আমিও আবেগাপ্লুত হচ্ছি মাঝে মাঝে। এর মধ্যে হঠাৎ আমার হাতে একটা চাপ দিয়ে বললেন, ‘এই দৃশ্যটা দ্যাখেন... ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেন...।’
পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত কয়েকজন বাঙালির লাশ কবর দেওয়া হচ্ছে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন না করেই মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে লাশ....।
পাশ থেকে ফিসফিস করে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কচুগাছের পাতাগুলো দ্যাখেন... কেমন মোনাজাতের ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে, এই দুর্দিনে মানুষের লাশ দাফন করার সময় মোনাজাত করার কেউ নেই...তাই প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছি আমি...কান্নার মতো বৃষ্টি... মান কচুগাছের বড় বড় পাতাগুলো যেন মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে রেখেছে আকাশের দিকে... খুব অর্থবহ না দৃশ্যটা?’
‘জি স্যার, খুবই অর্থবহ।’
ছবি শেষ হলো। চোখ মুছতে মুছতে বেরোচ্ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ছবিটা খুব ভালো হয়েছে না?’ ‘জি স্যার, খুব ভালো হয়েছে।’
নিজের সৃষ্টি নিয়ে এমন শিশুর আবেগ কোনো বড় লেখকের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এই ক্ষেত্র হুমায়ূন সহজ-সরল অকপট। এই আবেগটাই হয়তো সবচেয়ে বড় পুঁজি ছিল তাঁর। এই আবেগটা পাঠকের মনে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তিনি আজ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক।

No comments

Powered by Blogger.