রাসায়নিক আমদানি নিয়ন্ত্রিত না হলে ভেজাল কমবে না by ফারজানা লাবনী

কোনো রকম বিধিনিষেধ ছাড়াই রাসায়নিক দ্রব্য খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি হওয়ায় ভেজাল কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি সহজেই তা সংগ্রহের সুযোগ পাচ্ছে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের বেশির ভাগই মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।


অথচ অতি লাভের জন্য অনেক ব্যবসায়ী সেসব রাসায়নিক খাবারে মিশিয়ে বাজারজাত করছে। এসব খাবার খেয়ে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বা দীর্ঘ মেয়াদে রোগে ভুগছে। অনেকেই মনে করছে, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি, উৎপাদন এবং বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণমূলক আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হলে খাবারে ভেজালের পরিমাণ অনেকাংশে কমবে।
সরকারি নজরদারির অভাবে জনবসতির মধ্যে গড়ে উঠেছে হাজারের ওপরে রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা ও গুদাম। রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে প্রাণ দিতে হয়েছিল শতাধিক মানুষকে। এ ঘটনার পর কিছুদিন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি, উৎপাদন এবং বিক্রি সম্পর্কে নানা উদ্যোগের কথা বলেছিলেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। ২০টি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি আজও।
বাংলাদেশ ডাইং, পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির অনুমোদন পেতে উল্লেখযোগ্য কোনো শর্ত আমদানিকারককে পূরণ করতে হয় না। তাই দিন দিন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ী নামধারী কিছু ব্যক্তি রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। এখান থেকে অনেকে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, টেক্সটাইল রং, সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড, ডিটিসহ আরো কিছু রাসায়নিক দ্রব্য ফল, মাছ মাংস, মিষ্টিসহ নানা রকম খাবারে মিশিয়ে বিক্রি করছে।' প্রকৃত রাসায়নিক দ্রব্য আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীরা এ কাজে জড়িত নয় দাবি করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
আবদুস সালাম বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই শিল্প-কারখানায় ব্যবহারে, গবেষণার কাজে এবং বাণিজ্যিকভাবে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়। এ ছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের নজরদারিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও করা হয় সীমিত পরিসরে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে তাদের চাহিদানুযায়ী আমদানি করে। তবে ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, গবেষণার কাজে, চিকিৎসা ক্ষেত্রসহ অন্যান্য খাতে বাণিজ্যিকভাবে যারা আমদানি করে, তাদের কাছ থেকেই মূলত রাসায়নিক কিনে থাকে ভেজালকাজে জড়িতরা। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লাইসেন্স বা বিশেষ কোনো পাস দেখাতে হয় না তাদের।'
দীর্ঘদিন ভেজালবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শারীরিক অসুস্থতায় ওষুধ খাওয়া যতখানি জরুরি তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগ হওয়ার আগে ব্যবস্থা নেওয়া। দু-চারজনের টিম নিয়ে অভিযান পরিচালনায় ভেজাল কার্যক্রম বন্ধ বা কমানো সম্ভব নয়। ভেজালের প্রধান কারণ অতি সহজে রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ করতে পারা। তাই নিয়ন্ত্রণমূলক আইন করে রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। উপযুক্ত কাগজপত্র ছাড়া যাতে কেউ রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।' রাসায়নিক দ্রব্যের বিষয়ে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে কিছু খোঁজখবর করা হয়। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
অভিজ্ঞতার আলোকে ম্যাজিস্ট্রেট আল আমিন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে অতি সহজে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ভেজাল কার্যক্রমও কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির অনুমোদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। আবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয় জড়িত। তাই এ দেশে রাসায়নিক দ্রব্য কিভাবে, কতটা এবং কারা বিক্রি করছে, তা তদারকিরও দায়িত্ব এসব মন্ত্রণালয়ের। এ দায় তারা এড়াতে পারে না।
একই মত জানিয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অতি সহজে খাবারে মেশানোর ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য বাজারে পাওয়া যাওয়ায় খাবারে ভেজালের পরিমাণ বাড়ছে। দু-চারটি অভিযান করে ভেজাল বন্ধ করা যাবে না। এ বিষয়ে সচেতনতা এবং কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রহিমআফরোজ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের গ্রুপ ডিরেক্টর নিয়াজ রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, উন্নত বিশ্বে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন আর রাষ্ট্র পণ্যের মান ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি হচ্ছে, পাড়া-মহল্লার আড়তে বা দোকানে খোলামেলাভাবে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তেমন চোখে পড়ে না। খাবারে মেশানো রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন ও আমদানিতেও নেই কঠোর কোনো বিধিনিষেধ। তাই এসব বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার একটু সচেষ্ট হলেই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। এতে ভেজালকাজ এত সহজে করা সম্ভব হবে না।
রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি, উৎপাদন এবং বিক্রিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী জানতে চাওয়া হলে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাসায়নিক দ্রব্য আমদানিতে তেমন বিধিনিষেধ আরোপ করা নেই। ব্যবসায়ীরা আমদানি নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে পারলেই রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করতে পারে।' তিনি জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাসায়নিক দ্রব্য কারা কিনছে বা খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তদারকি করা হয় না।
শিল্পসচিব মাসুদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অতি সামান্য রাসায়নিক দ্রব্য দেশে উৎপাদন করা হয়, যা শিল্পের সংজ্ঞায় আসে না। শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন বা বিক্রির বিষয়ে তদারকিতে দায়বদ্ধ নয়।'

No comments

Powered by Blogger.