আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা জোরদার করতে হবে-মুদ্রানীতি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়

রীতিমাফিক আরেকটি অর্ধবার্ষিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য এটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই সময়কালে দেশের অর্থনীতিতে অর্থের জোগান-পরিস্থিতি কী রকম হবে বা ঋণ সরবরাহ কোন কোন দিকে ধাবিত হবে, তার একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।


এতে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বাড়বে। ঋণ সরবরাহ বাড়ার মানে হলো উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের অর্থায়নকে জোরদার করা। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিময়তা বাড়ানোর প্রত্যাশা করা হয়। তবে সব খাতে সমানভাবে ঋণ দেওয়া যে যাবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। মূলত কৃষি এবং অধিকতর উৎপাদনশীল শিল্প ও ব্যবসায় যেন ব্যাংক থেকে ঋণ যায়, সে রকম নির্দেশনাই দিতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ধ্রুপদি অর্থনীতির সূত্র মেনে মুদ্রানীতি পরিচালিত হয় প্রথমত মূল্যস্ফীতিকে নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে আটকে রাখার এবং দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিময়তায় সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। যেহেতু বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেলে তা মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলতে ভূমিকা রাখে, সেহেতু অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করাই মুদ্রানীতির মূল কাজ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চেষ্টাটিই করেছে। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিতে চাহিদাজনিত নিয়ামক সব সময় সমানভাবে সক্রিয় থাকে না। আর তাই মুদ্রানীতির প্রভাবও খুব সীমিত হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আর্থিক খাতের যে চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে এই খাতটিতে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে। ব্যাংকগুলোর আইনি সীমা ছাড়িয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, বাছবিচারহীনভাবে ঋণ প্রদান করে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ানো, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে অর্থায়ন এবং আমানত সংগ্রহে বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মতো ঘটনাগুলোই বুঝিয়ে দেয় যে এ খাতে শৃঙ্খলা কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকেই জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেই সম্পদ ও দায়ের মধ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। আর তাই কোনো কারণে যদি হঠাৎ নগদ অর্থের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয় এবং গ্রাহকেরা যদি টাকা তুলতে শুরু করেন, তাহলে অনেক ব্যাংকের পক্ষেই তা ঠিকমতো সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের ঝুঁকিময় পরিস্থিতি কোনোভাবেই আর্থিক খাতের স্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরে না। এ জন্য প্রধানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপ্রতুল নজরদারি ও অদক্ষতা দায়ী।
সুুতরাং, ব্যাংকগুলোকে নিয়মনীতির পথে চলতে বাধ্য করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ জন্য নিয়মবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হয়। ইতিমধ্যে এই নজরদারিতে ঘাটতির যথেষ্ট নজির মিলেছে। আশা করা যায়, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আরও সচেতন হবেন, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় অধিক মনোযোগ দেবেন।

No comments

Powered by Blogger.