ক্রিকেট কূটনীতি-খেলার সূত্রে বন্ধুুত্বের বার্তা
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দশম আসরের ভারত ও পাকিস্তানের সেমিফাইনালটি 'মাদার অব অল ব্যাটেলস' অভিধায় ভূষিত হয়েছিল। জেন্টলম্যান'স গেম হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাওয়া ক্রিকেট নিয়ে মহারণ হতে পারে কি-না, কিংবা এ ধরনের বিশেষণ ব্যবহার কতটা সঠিক তা নিয়ে যুক্তিতর্ক চলতে পারে।
তবে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষা কিংবা খেলাধুলা যে কোনো প্রসঙ্গ এলেই 'চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যে দুটি দেশকে, সেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল নিয়ে আগ্রহ-উত্তেজনা তুঙ্গে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতের কোনো সেমিফাইনালই বুধবার হয়ে যাওয়া মোহালি ম্যাচের মতো গুরুত্ব পায়নি। নক-আউটের এ খেলায় জয়-পরাজয় নিষ্পত্তি হয়েছে ভারতের পক্ষে। তবে পাকিস্তানের যে দলটিকে ক্যারিশমাটিক খেলোয়াড় শহিদ আফ্রিদি নেতৃত্ব দিয়ে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, তাদের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা না করে পারা যায় না। ম্যাচ ফিক্সিং এবং শ্রীলংকার খেলোয়াড়দের ওপর সন্ত্রাসী অপশক্তির হামলার কারণে পাকিস্তানের ক্রিকেটের ভিত অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। কার্যত কোনো দেশই পাকিস্তানে খেলতে রাজি ছিল না। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের জাতীয় দল বিশ্বকাপকে বেছে নিয়েছিল ক্রিকেটের প্রতি তাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা প্রকাশের মঞ্চ হিসেবে এবং বলা যায় এতে তারা বহুলাংশে সফলও হয়েছে। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট তিক্ত। এরপরও পাকিস্তানের দলটিকে ভারতে যেভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে তাতে রণহুঙ্কার নয়, বরং পরিপূর্ণভাবেই ছিল উষ্ণ আতিথেয়তার ছোঁয়া। বৈরিতা নয়, বরং শান্তির পথে চলতেই দুটি দেশের জনগণ যে বেশি উৎসাহী এরও প্রতিফলন মেলে এতে। পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার ক্রীড়ানুরাগী এসেছে মোহালিতে খেলা দেখতে এবং সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া কিংবা উদ্যত সঙ্গিন তাদের মনের বিচ্ছিন্নতা ঘটাতে পারেনি, এমন ধারণাই তারা পেয়ে গেছে খেলার মাঠে এবং বাইরে। মাঠে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে খেলা উপভোগ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা জিলানি। দু'দেশের খেলোয়াড়রা যখন শ্রেষ্ঠত্বের আসন ছিনিয়ে নিতে প্রাণপণ লড়ছিলেন, তখন তাদের রাজনৈতিক নেতারা তা উপভোগের পাশাপাশি ফাঁকে ফাঁকে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য একযোগে কাজ করার উপায় অনুসন্ধানে সচেষ্ট ছিলেন। এই ক্রীড়া-কূটনীতি সফল হবে কি-না, সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে খেলাধুুলা যে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে তা তো নজিরবিহীন নয়। ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং তার ছেলে রাহুল গান্ধীসহ দুই দেশের অনেক ভিভিআইপি ও নানা অঙ্গনের তারকারা খেলা উপভোগ করেছেন, সেটাও তো সবার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার জন্যই। এটা কারও কারও কাছে গ্যালারি শো মনে হতে পারে। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মোহালিতে মনমোহন সিংয়ের অতিথি হওয়াকেও আখ্যায়িত করা চলে নিছক কূটনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতির পথে চলার সংকল্প ব্যক্ত হয় এবং এ বার্তাটি অবশ্যই ইতিবাচক। শুধু দুই দেশের সমর্থক ও ক্রীড়ানুরাগীদের মধ্যে নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টিকারী খেলাটিকে নির্বিঘ্নে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারাও কিন্তু যথেষ্ট কৃতিত্বের এবং এর সঙ্গে যুক্তরা অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন।
No comments