হুমায়ূন চলে গেলেন বারবার ফিরে আসার জন্য by আলী যাকের

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আমি হুমায়ূনের লেখা প্রথম পড়ি। প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' তখন বেরিয়েছে। পড়লাম 'শঙ্খনীল কারাগার'ও। বিস্মিত হয়ে যাই উপন্যাস দুটো পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে এত বড় মাপের লেখক আছেন! এই আবিষ্কারের মাধ্যমে আমার প্রত্যয় জন্মেছিল, স্বাধীনতার নির্যাস তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।


হুমায়ূনের আবির্ভাব দেখে মনে আসছিল স্বাধীনতা লাভের পরপর দেখা কিছু দৃশ্যের কথা। যুদ্ধশেষে যখন দেশে ফিরছিলাম, তখন দেখেছি গ্রামের গণমানুষ ভেঙে যাওয়া রাস্তা ও সেতু নিজ হাতে মেরামত করছে। সব মানুষের মধ্যে একটা দ্যোতি ছিল।
ঢাকায় এসে দেখলাম, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ। মানুষের মিছিল। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। মানুষের সামগ্রিক মুক্তির নিশানা যেন। নতুন কর্মকাণ্ড আর নতুনের যাত্রা চোখে পড়ল সবখানে। আমাদের নাটক অঙ্গনেও তার ছোঁয়া লেগেছে। বাংলাদেশের নাটক মঞ্চায়িত হতো মঞ্চে নতুন উদ্দীপনায়। মঞ্চের একজন মেঠোকর্মী হওয়ার কারণে লেখালেখিতে আমার প্রবেশ ঘটেনি। নাটকে ছিলাম, নাটকেই রয়ে গেলাম। এমন সময় 'নন্দিত নরকে' আর 'শঙ্খনীল কারাগার' পড়ে উদ্বেলিত হলাম। তারপর আশির দশকে ফোন পেলাম হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে। তিনি বললেন, একটা টিভি সিরিয়াল করবেন। নামও জানিয়ে দিলেন। 'বহুব্রীহি'। কথা বলার জন্যই গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ পড়ে শোনালেন।
তারপর আবার পাঠের আয়োজন করা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনে। প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পাঠ শোনার পর চমৎকৃত হলাম। এমন সাবলীল নাটক! ভাবলাম, নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে নাটকটি। পরিবার থেকে সমাজের বিভিন্ন চিত্র বেরিয়ে এসেছে এই নাটকে। সেই নাটকে একটি চরিত্র ছিল মামার। হুমায়ূন কী মনে করে তার জন্য আমাকেই নির্বাচন করলেন। পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই মামা চরিত্রটি সৃষ্টি কেন করলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রায় সব পরিবারেই এমন কোনো না কোনো চরিত্র থাকে, যে নাকি একটু বাতিকগ্রস্ত টাইপের হয়ে থাকে। কেউ তাকে মনে করতে পারে নিছক পাগল জাতীয় কিছু। একটি পরিবারকে তুলে আনতে হলে এমন চরিত্রের মানুষকে কি আমরা বাদ রাখতে পারি?
নাট্যকারকে শুটিং চলাকালে থাকতে দেখা যায় না সাধারণত। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে ছিল ভিন্নদৃশ্য। তিনি নাটকের প্রতিটি শুটিংয়ে থাকতেন। তাৎক্ষণিক কোনো সংলাপের পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন প্রয়োজন হলে তিনি করে দিতেন।
মামা চরিত্রটি ছিল কৌতুকপূর্ণ। তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে তৈরি করেছিলেন সেই চরিত্রটি। তাঁর তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল ভাঁড়ামি যেন নাটকের ইমেজ সংকট তৈরি করতে না পারে। চেহারায় পরিবর্তন না এনে মানুষকে হাসির উপাদান দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ সেই কঠিন কাজটি করেছিলেন নিপুণভাবে। প্রতিটি চরিত্র সৃষ্টির সময় হুমায়ূন ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। অত্যন্ত যত্নসহ তিনি সেগুলো তৈরি করেছেন। যেমন বাবার চরিত্রের কথা ধরা যাক। আসাদুজ্জামান নূরের চরিত্রের দিকে খেয়াল করুন। মা-হারা দুই সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি। কী অসাধারণ নৈপুণ্য সেখানেও দেখা যায়। তিনি মানুষের ভেতরটা দেখার ক্ষমতা রাখতেন। সংলাপগুলো এমনভাবে তৈরি হতো, যাতে সেই ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ পেত দর্শকও। তখন দেখা যায়, তিনি কত গভীরে যেতে পারছেন।
তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অন্য রকম। আমি কখনো সিগারেট খাই না। সুতরাং আমার হাতে সিগারেট আসার কোনো কথা নয়। তিনি করতেন কী, আমার হাতের দুই আঙুলের মাঝখানে একটি সিগারেট ধরিয়ে দিতেন। বেশ মজা পেতেন। হাসি না পেয়ে কি আর সম্ভব?
'বহুব্রীহি' নাটকের কথা। দুলাভাই বললেন, দেশে মাছের বড় অভাব। বেশ, সিদ্ধান্ত নিলাম আমি মাছের ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করব। নামও ঠিক করা হলো। 'হে মাছ'। আমার সার্বক্ষণিক সহযোগী হিসেবে দেখা যেত ভৃত্য দুজনকে। একজন ছিল আফজাল শরীফ, আরেকজন ছিল রহিমা বুয়া। কাজ করার আগে আমি তাদের কাছ থেকে পরামর্শ চাইতাম। তারাও মাথা ঝুলিয়ে আমার কাজের সমর্থন করত। অভাবনীয় সৃজনশক্তি ছিল তাঁর। তিনি পাঠককে হাসাতে সক্ষম হয়েছিলেন সমাজের পূর্ণ রূপ দেখানোর মাধ্যমে। শুটিংয়ের সময়ও অনেক মজা হতো। একবার শুটিং হবে ধলেশ্বরীতে। গেলাম সেখানে। নদীঘাটে ছোট একটি কোষা নৌকা বাঁধা। বললাম, এই নৌকা দিয়ে কাজ চলবে না। অবশ্যই ডুবে যাবে। হুমায়ূন বললেন- না, ডুববে না। উঠে দেখুন না। কিন্তু নৌকার ধারণক্ষমতা তো কম ছিল। ওটা ডুবে যায়। আর সেই চিত্রটি চারবার ধারণ করতে হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ূনের সে কী আনন্দ!
তারপর 'আজ রবিবার' নাটকে সাইকিয়াট্রিকের কাজ করি আমি। মৃত মানুষের চিন্তা-ভাবনা জানতে চাই। সেই চরিত্রের প্রয়োজনে আমাকে কফিনের ভেতর ঢুকতে হবে। কফিনের ভেতর ঢুকে আবার বেরও হলাম। হুমায়ূন দেখে খুব খুশি। আমি তাঁকে বললাম, কর্পূরের গন্ধ ভেসে এসেছিল নাকে। তিনিও দেরি না করে জবাব দিয়ে দিলেন- এই কফিনটাতে করে সকালেই একটা লাশ কবরস্থানে নেওয়া হয়েছিল। আবারও হাসি। খুব মজা করতে পারতেন তিনি।
সমাজজীবনের অনেক কঠিন কঠিন বিষয়কে তিনি এত সহজভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখতেন, যা সত্যিই অবাক করার মতো। এমন সুন্দর করে প্রকাশ করার মতো শক্তিমান আর কোনো লেখক আমাদের দেশে আছেন কি? লেখকদের কেউ কেউ আছেন, শব্দ নিয়ে কারুকাজে লিপ্ত থাকেন। কিন্তু ফ্রিল (FRILL) জিনিসটি তিনি জানতেন না। নিজে সহজভাবে চলতে পারতেন। বলতেনও সহজভাবে। একজন লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে এটি। আর হুমায়ূন আহমেদের সেই গুণটি ছিল অসাধারণ।
আমি নিশ্চিত, হুমায়ূনের মৃত্যুর পর আমাদের নতুন প্রজন্মের লেখকরা এগিয়ে আসবেন। তাঁরা সফলও হবেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে যাবেন কেউ কেউ। আর এমন হলেই হুমায়ূনের আত্মা শান্তি পাবে। (অনুলিখন)
লেখক : বিশিষ্ট নাট্যজন

No comments

Powered by Blogger.