চরাচর-কারওয়ান বাজারের শ্রমজীবী মানুষেরা by ফাহমিদা আক্তার রিম্পি
'দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলো নীচে ফেলে।' নাহ, কাজী নজরুল ইসলামের দেখা সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা আমরা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছি। এখন কুলিদের আলাদা কোনো রেলের বগি, আলাদা কোনো ক্যান্টিন নেই। একই গাড়িতে আমরা সবাই চড়ি, একই ক্যান্টিনে বসে সবাই চা খাই।
আশার কথা হচ্ছে, কুলিদের আজকাল অনেকেই কুলি বলে ডাকে না, কুলি বলে মনে করে না। বরং তাদের শ্রমজীবী মানুষ বলে সম্মান করি আমরা। ওইসব লোক শ্রমের বিনিময়ে কিছু পয়সা পায়, আর তা দিয়েই চলে তাদের জীবন। তাই তাদের বলি 'শ্রমজীবী'। আজ বলব কারওয়ান বাজারের শ্রমজীবী মানুষদের কথা। তাদের শ্রমে শুধু তাদের জীবনই চলে তা নয়, বরং তাদের শ্রমে আমাদের জীবন টিকে আছে। ঢাকা শহরের কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় কারওয়ান বাজারের শ্রমজীবী মানুষেরা। রাত করে কারওয়ান বাজার হয়ে যাঁরা ফেরেন, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ফুটপাতে প্রচুর লোক শুয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে, যারা গুটিসুটি মেরে বেতের টুকরিতে শুয়ে থাকে। টুকরির ভেতরে শুয়ে থাকার মর্তবা হলো, তস্করের প্রাদুর্ভাব। রাত ১০টার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঁচা সবজির ট্রাক ভিড় জমায় কারওয়ান বাজারে। আর টুকরির ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে উঠে লেগে পড়ে ট্রাক আনলোডের কাজে। গভীর রাতের দিকে আসে মাছের ট্রাক। তাই একটু বেশিই হয়তো সময় পায় মাছের ট্রাক আনলোডাররা। প্রতিরাতে গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে রোজগার হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। রোজগার যা হয়, তা দিয়ে সংসার টেনেটুনে চলে যায়। আর বিনোদন বলতে ট্রাক আনলোড করার ফাঁকে ফাঁকে একটু আড্ডা, একটু খাওয়া-দাওয়া। মজার কথা হচ্ছে, মায়ের মমতা নিয়ে কিছু কিছু মহিলা ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ হোটেল দিয়ে বসেন কারওয়ান বাজারে। হোটেলের সম্বল বলতে দুই-তিনটা হাঁড়ি ও কয়েকটি প্লেট। হয়তো প্লেটে তুলে দিলেন ভাত আর একটু মুড়িঘণ্ট। ক্ষুধার্ত পেটে নিমেষেই শেষ হয়ে গেল প্লেট। খাওয়ার পর হয়তো হিসাব হবে কত হলো বিল। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পর্বটা যখন চলতে থাকে, তার মধ্যে মিশে থাকে অনন্ত মায়া। শরৎচন্দ্র প্রায়ই বলতেন- এই বাংলায় এত মা-বোনের স্নেহ, সাধ্য কার তা পাশ কাটায়ে কেউ যায়। কারওয়ান বাজারের ভ্রাম্যমাণ এই হোটেলের খালা যখন পাতে ভাত বেড়ে দেন, তা শুধু ওই শরৎচন্দ্রের ভাষায়ই ব্যক্ত করা যায়। বাজারে পাবলিক টয়লেটের খুব অভাব। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণশৌচাগার করে দিলে অনেক উপকার হয়। মানুষগুলো টুকরিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়, তারাই তো আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। তাদের কেন এত অবহেলা করব? আমরা কি পারি না ওই শ্রমজীবী ভাইদের জন্য গণশয়নকক্ষ করে দিতে? পুরো কারওয়ান বাজারটিকেই কিন্তু আমরা পারি একটা আধুনিক আনলোড সিস্টেমে নিয়ে আসতে। অন্তত খাবার যেখানে ভায়া হয়ে আসে, সেখানটা যেন অনেক সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়।
ফাহমিদা আক্তার রিম্পি
ফাহমিদা আক্তার রিম্পি
No comments