কৃষি ও কৃষক-গ্রামবাংলা বদলে দেওয়া by আতিউর রহমান

এই যে কৃষকের হাতে আধুনিক উপকরণ দেওয়ার অঙ্গীকার, এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আকুতির পুরোপুরি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এতদিনে গ্রামবাংলা অনেকটাই বদলে গেছে। গ্রামে কলের লাঙল পেঁৗছে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ গ্রামে বিদ্যুৎও পেঁৗছেছে। কিন্তু আজও গ্রামবাংলায় দারিদ্র্য প্রকট।


বিশেষ করে আজও দুর্যোগে-দুঃসময়ে গ্রামের মানুষ খুবই অসহায়। তাদের বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার মতো নীতিনির্ধারণী উদ্যোগের বড়ই অভাব। সময়মতো বীজ, সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তারা পায় না বলেই তাদের কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। আর এর প্রভাব পড়ে খাদ্য উৎপাদনে। তা ছাড়া চরের কৃষক বরাবরই নদীভাঙনের শিকার



'আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে।' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'ভূমিলক্ষ্মী', রর, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ৩৬০)।
'আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে।' (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
শ্রাবণ মাস এলেই প্রকৃতির দু'চোখ বেয়ে ঝরে কান্না। ভেসে যায় গ্রামবাংলা। প্রায়ই ফসলি জমি পানির নিচে, ঘরে পানি, পেটে থাকে না ভাত। এসব কষ্টের নেই সীমা-পরিসীমা। তাদের দুঃখ-বঞ্চনার কথা নগরের ক্ষমতাকেন্দ্রে সাধারণত পেঁৗছায় না। এই সমাজে কৃষককুল পুরোপুরিই উপেক্ষিত। কিন্তু তাদের কথা ঠিকই মনে রেখেছিলেন দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর কৃষকপ্রীতির কথা আমরা আমাদের আলোচনায় সেভাবে আনি না। শ্রাবণেই এই দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছেড়ে গেছেন আমাদের। আজ তুলে ধরতে চাই এ দেশের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী কৃষকদের নিয়ে তাদের ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা।
পূর্ব বাংলার কৃষকদের দুঃখ দেখে রবীন্দ্রনাথ তাদের সমবায় গঠন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। নিজের ছেলেকে পর্যন্ত কৃষির উন্নয়নে কৃষিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। নোবেল পুরস্কারের টাকাটাও গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যয় করেছিলেন। শান্তিনিকেতনেও তিনি আশপাশের গ্রামের কৃষকদের নিয়ে নানা কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, 'অন্নের উৎপাদন হয় পল্লীতে, আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে।... গ্রামে অন্ন উৎপাদন করে বহু লোকে, শহরে অর্থ উৎপাদন ও ভোগ করে অল্পসংখ্যক মানুষ; অবস্থার এই কৃত্রিমতায় অন্ন এবং ধনের পথে মানুষের মধ্যে সকলের চেয়ে প্রকাণ্ড বিচ্ছেদ ঘটেছে। ওই বিচ্ছেদের মধ্যে যে সভ্যতা বাসা বাঁধে তার বাসা বেশিদিন টিকতেই পারে না।' (রবীন্দ্রনাথ, 'উপেক্ষিত পল্লী', রর, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ৩৭১)।
এ অবস্থার অবসানের জন্যই তিনি সারা পৃথিবীর আলো পল্লীতে ফেলতে বলেছেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরশ পল্লীবাসীরও পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে কারণে নগরবাসীরও রয়েছে দায়। দেশে জন্মালেই যে দেশ আপন হয় না সে কথা তিনি তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।
দেশকে এমন গভীরভাবে ভালোবাসার যে আহ্বান রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন তা মনে হয় বৃথা যায়নি। আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। ছিলেন তিনি গ্রামীণ সাধারণ পরিবারের সন্তান। কিন্তু সুযোগ পেয়েছিলেন উদার, অধিকারবঞ্চিত গ্রামীণ কৃষকের নিরন্তর খণ্ড খণ্ড স্পর্ধিত প্রতিরোধ অবলোকনের, অন্যদিকে তাকে ক্রমাগত প্রভাবান্বিত করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। তাই শহরের গণ্ডি থেকে টেনে তিনি তাদের (রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে) সমগ্রের প্রতিনিধি করলেন।
সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা-আন্দোলনকে পরিচালনা করেই তিনি তার দায়িত্ব শেষ করেননি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মূলত কৃষক-সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো যে বাংলাদেশ তার প্রাথমিক পরিচালনা-দায়িত্ব নিয়েও তিনি ভুলতে পারেননি কৃষকদের কথা। শোষণহীন সমাজ গঠনের তার যে অভিপ্রায় ছিল তা তিনি গোপন করেননি। আর সেই অভিপ্রায়ের জমিনের বড় অংশই জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক। অর্থনীতির আমূল সংস্কারবাদী বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি হাত দিয়েছিলেন, তাতেই রুষ্ট হয়েছিল নগরের সুবিধাভোগী স্বার্থান্বেষী মহল। তাই তাকে শেষ পর্যন্ত কৃষকদের কাছেই ফিরে যেতে হলো। তিনি তাদের সানি্নধ্যেই পরম শান্তিতে টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে রয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্যরা জনগণের সামনে শপথ গ্রহণ করেন। শপথবাক্য পাঠ করানোর নীতিনির্ধারণী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলায়ও এই একই ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। আইয়ুবি আমলে সরকারের খাসজমি বণ্টন করা হয়েছে ভুঁড়িওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে এদের কাছ থেকে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতেও সকল খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমি কৃষক এবং শ্রমিকদের কথা দিচ্ছি, আওয়ামী লীগ তাদের আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, কারণ আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।' (দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জানুয়ারি ১৯৭১)।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো_ ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, ১৯৭২ সালের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়, দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষক ভাইদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়; ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে নূ্যনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়, গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমূল্যের রেশন-সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয় এবং গরিব কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ওই সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৫ ভাগ। বিরাজমান খাসজমির সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসাবে ৩০ লাখ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।
১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। বিশ্ববাজারে রাসায়নিক সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির অভিশাপ থেকে বাংলার কৃষককে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তি, সেচব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাসজমি প্রাপ্তি এবং মূল্য সমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদি নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে। (দ্র. ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, 'ধন্য সেই পুরুষ', বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ : কৃষি ও কৃষকের দেশ, বেতার বাংলা সংকলন, জুন ২০০০)।
কৃষকদের সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল স্বচ্ছ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। স্বদেশের উন্নয়নে শিক্ষিত শ্রেণীর চেয়ে তাদের অবদান যে বেশি সে কথা বলতে তিনি মোটেও দ্বিধা করতেন না। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, 'করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।' (বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংসদ, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫)।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, কৃষকরা যদি সঠিকভাবে উৎপাদন করে তাহলে দেশের খাদ্য সমস্যা দ্রুত নিরসনসহ এটি জাতীয় আয়কে আরও প্রশস্ত করবে। তাই কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান এবং কৃষি উৎপাদনে উৎসাহদানের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ দেশে কৃষি গবেষণাধর্মী কাজ পরিচালনার জন্য তেমন কোনো সমন্বয়ধর্মী প্রতিষ্ঠান ছিল না । প্রবীণ কৃষিবিদ কাজী এম বদরুদ্দোজা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল গঠনে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি কৃষি-স্নাতকদেরও প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তায় উন্নীত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি বলেন, 'আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট-পরা কাপড়-পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই_ জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ্ হবে না।'
কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন, সেদিকে তার দৃষ্টি ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষি-উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদের তাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষকদের জন্য গভর্নরদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, 'ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের জন্য পাম্প পেলাম না, এটা পেলাম না_ এসব বলে বসে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। পাম্প যদি পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায় তবে স্বনির্ভর হোন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিল? দরকার হয় কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত, আট হাত কুয়া কাটলেই পানি ওঠে, সেখানে অসুবিধা কী আছে? আর এখন থেকে যেসব সার থানায় যাবে, তা যেন রেগুলারলি গরিব-দুঃখীরা পায়। ...আমি খবর পেলাম, ঠাকুরগাঁওয়ে একটা কোল্ডস্টোরেজ করা হয়েছে। এক বছর আগে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু পাওয়ার নাই। খবর নিয়ে জানলাম, পাওয়ার সেখানে যেতে এক বছর লাগবে। কারণ, খাম্বা নাই। খাম্বা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে। মিনিস্টার সাহেবকে বললাম, খাম্বা-টাম্বা আমি বুঝি না। বাঁশ তো আছে। দেড় মাস, দুই মাসের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এটা লাগাও। কী করে লাগবে, সেটা আমি বুঝিটুঝি না। দিল, লেগে গেল। কিন্তু আমার কাছে যদি না আসত, এক বছরের আগে খাম্বা পেত না। খাম্বা আসে কোত্থেকে? পাওয়ার গেল, আলু রাখল। আলু রাখার জায়গা নাই। এই মেন্টালিটি কেন হয়? খাম্বা বাংলাদেশের গাছে গাছে হয়। আমি বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় পাওয়ার দিতে চাই।'
এই যে কৃষকের হাতে আধুনিক উপকরণ দেওয়ার অঙ্গীকার, এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আকুতির পুরোপুরি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এতদিনে গ্রামবাংলা অনেকটাই বদলে গেছে। গ্রামে কলের লাঙল পেঁৗছে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ গ্রামে বিদ্যুৎও পেঁৗছেছে। কিন্তু আজও গ্রামবাংলায় দারিদ্র্য প্রকট। বিশেষ করে আজও দুর্যোগে-দুঃসময়ে গ্রামের মানুষ খুবই অসহায়। তাদের বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার মতো নীতিনির্ধারণী উদ্যোগের বড়ই অভাব। সময়মতো বীজ, সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তারা পায় না বলেই তাদের কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। আর তার প্রভাব পড়ে খাদ্য উৎপাদনে। তা ছাড়া চরের কৃষক বরাবরই নদীভাঙনের শিকার। কৃষকদের বাঁচানোর জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দরকার তা অস্থির এই সময়ে খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। দুই শ্রেষ্ঠ বাঙালির কৃষকপ্রীতির কথাগুলো স্মরণ করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি কৃষকদের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের জীবনচলাকে সুস্থিত করতে অনুপ্রাণিত হন তবেই মঙ্গল। মনে রাখা চাই, কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে।

ড. আতিউর রহমান : গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
 

No comments

Powered by Blogger.