সীমিত আয়ে যুদ্ধ করে বাঁচা by এম আবদুল হাফিজ
এই যুদ্ধ করে বাঁচার দলটিও সমাজের একটি ক্রমবিস্তৃত শ্রেণী, যার কলেবর শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তারাই তো সম্ভবত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। সর্বক্ষণ তাদের একটিই দুশ্চিন্তা : কোথায়, কখন, কোন চরায় ফেঁসে যায় তাদের জীবনতরী। যদিও অতি সন্তর্পণেই তাদের জীবনের পথচলা।
আয় ও ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গনে কোনোমতে টিকে থাকাই তাদের আরাধ্য। দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফলে শঙ্কিত এসব মানুষের জীবনে নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি আশা-আকাঙ্ক্ষা_ না আবাসনের, সাধ-আহ্লাদের, না কোনো বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় রংধনু দেখার। তারা সংকট থেকে সংকটে পাড়ি দেয় একটি লক্ষ্যই সামনে রেখে : টিকে থাকতে পারব তো?
সংবাদপত্রে আজকাল দ্রব্যমূল্য ও তার বিশ্লেষণই সেগুলোর প্রধান উপজীব্য। কিন্তু বিশ্লেষিত দ্রব্যের কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা নেই। দ্রব্যই কি জীবনের সবকিছু। কিছুই কি নেই তার বাইরে? অবশ্য একটি ভোগবাদী সমাজে দ্রব্য বা পণ্যের বাইরে কিছু থাকতে নেই। মানুষের চাহিদা সবটাই কি শুধু দ্রব্যকে ঘিরে আবর্তিত? তাহলে মানুষ যে তার সুকুমার বৃত্তিগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের আয়ের বেশ কিছুটা ব্যয় করে_ তাকে কী বলা যাবে?
যে কোনো কিছুরই অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি_ তা দ্রব্যের জন্যই হোক বা কোনো দরিদ্র আত্মীয়ের কষ্ট লাঘব করতেই হোক_ উভয়টাই আমাদের চাহিদা পূরণের প্রত্যাশায় ভূমিকা রাখে। তবে মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারটা, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক এবং তা একটি মানুষের আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাজার কোটি টাকার নব্য কোনো ধনিকের কাছে এসব নিয়ে হাহুতাশ একেবারে হাস্যকর। তাদের কাছে আদা-হলুদ-জিরা-ছোলার দাম কমবেশি হওয়ার বিষয়টাও অপ্রাসঙ্গিক।
একজন নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতাই যখন তার চাহিদা পূরণের বাহন, সমাজের অনেকের কাছেই সে বাহন আছে। প্রশ্ন হলো, কার বাহন কতটা মজবুত। যাদের কাছে সে বাহন নেই বা থাকলেও তা নড়বড়ে, সমস্যা তাদের। তাদেরই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় এবং সে জন্য তাদের একেক সময়ে একেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু তা যাতে পর্যবসিত হয় তার নাম সোজাসাপ্টা কথায় বঞ্চনা। সমাজের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমাজের তলানি। এদের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নিম্ন বা সীমাবদ্ধ আয়ের মানুষ, পেনশননির্ভর, কর্মক্ষমতাহীন বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ উপেক্ষিতা প্রবীণা। বাকিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই অথবা বিশ বছর আগে অবসর গ্রহণ করে তৎকালীন হারে প্রদত্ত অবসর ভাতার ওপর নির্ভরশীল এখনও, যখন দ্রব্যমূল্য সম্ভবত বিশগুণ বেড়েছে। তাদের বাঁচার বিড়ম্বনা মাঝে মধ্যে অনুভব করতে চেষ্টা করি। কেমন তাদের যুদ্ধ করে বাঁচার।
মানুষের জীবনের বিচিত্র চাহিদাও তো ব্যাপক। শুধু ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের সঙ্গেই তাকে সম্পর্কিত ভাবা যায় না। স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের রোগব্যাধি হয় ও তার চিকিৎসা করতে হয়। পোশাক-পরিচ্ছদ লাগে। উৎসবে-পার্বণে পছন্দের ভূষণ পরতে ইচ্ছা করে। দরিদ্র আত্মীয়ের প্রয়োজন মেটাতে হয় মানবিক দায়বদ্ধতায়।
এই বহুমুখী চাহিদা পূরণের সীমিত আয়ের মানুষদের শুধু নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়। কাটছাঁট করতে হয় অনেক সাধ-আহ্লাদের, যা অন্য কথায় আত্মবঞ্চনা। মহার্ঘতার সময়ে বা সমাজের প্রয়োজন মেটাবার গণিতটিও জটিল। বঞ্চিতরা অবচেতনেই সর্বক্ষণ স্রেফ টিকে থাকার অঙ্কটি কষে যাচ্ছে। বাজারে যেতে যেতেও মানুষটি কোনো কিছু কেনা বা না কেনার সিদ্ধান্তটি হাজারবার বদলিয়ে যাচ্ছে।
কথা তো ছিল রাষ্ট্রই একটি সুষম বাজার ব্যবস্থা এবং কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে তাদের বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি দেবে। অবশ্য ক্ষমতাসীনরা রোজার সমাগমে প্রথাগতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণ এসব প্রতিশ্রুতির সামান্যই বিশ্বাস করে। মাত্র ক'দিনের অপেক্ষা বাজারের দানবীয় রূপ প্রত্যক্ষ করার। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকবে মন্ত্রীদের বাকচাতুরতা।
মূল সমস্যা আয়ের উৎস না বাড়িয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে চিড়ে ভিজবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অথচ কর্তৃপক্ষ তাই করছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে, যারা চিরদিনের মতো বঞ্চনার শিকার হয়ে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকছে। মূল্যবৃদ্ধি কি শুধু দ্রব্যের? মূল্য বাড়ছে 'সেবা' খাতে বিদ্যুতের (এই সরকারের আমলেই নাকি পঞ্চমবারের মতো)। বাড়তে যাচ্ছে জ্বালানির মূল্য, যা সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আরও বেড়েছে পরিবহনের ভাড়া (অন্তত রেলের ভাড়া বৃদ্ধির কথা শুনেছি)।
সেবা খাতের মূল্য আদায়ের পদ্ধতিটাও কঠোর। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কোনদিক সামলাবে স্বল্প আয়ের মানুষ। সমস্যার ভিমরুল তাকে ছেঁকে থাকে। নির্দয় দংশনের মধ্যেই তাদের বেঁচে থাকা। রোজগারের কোনো বাড়তি উৎস নেই বাড়তি প্রয়োজন মেটাবার। তাই তাদের জীবনের সকল সুন্দর পরিকল্পনাই ভেস্তে যায় অকালে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
সংবাদপত্রে আজকাল দ্রব্যমূল্য ও তার বিশ্লেষণই সেগুলোর প্রধান উপজীব্য। কিন্তু বিশ্লেষিত দ্রব্যের কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা নেই। দ্রব্যই কি জীবনের সবকিছু। কিছুই কি নেই তার বাইরে? অবশ্য একটি ভোগবাদী সমাজে দ্রব্য বা পণ্যের বাইরে কিছু থাকতে নেই। মানুষের চাহিদা সবটাই কি শুধু দ্রব্যকে ঘিরে আবর্তিত? তাহলে মানুষ যে তার সুকুমার বৃত্তিগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের আয়ের বেশ কিছুটা ব্যয় করে_ তাকে কী বলা যাবে?
যে কোনো কিছুরই অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি_ তা দ্রব্যের জন্যই হোক বা কোনো দরিদ্র আত্মীয়ের কষ্ট লাঘব করতেই হোক_ উভয়টাই আমাদের চাহিদা পূরণের প্রত্যাশায় ভূমিকা রাখে। তবে মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারটা, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক এবং তা একটি মানুষের আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাজার কোটি টাকার নব্য কোনো ধনিকের কাছে এসব নিয়ে হাহুতাশ একেবারে হাস্যকর। তাদের কাছে আদা-হলুদ-জিরা-ছোলার দাম কমবেশি হওয়ার বিষয়টাও অপ্রাসঙ্গিক।
একজন নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতাই যখন তার চাহিদা পূরণের বাহন, সমাজের অনেকের কাছেই সে বাহন আছে। প্রশ্ন হলো, কার বাহন কতটা মজবুত। যাদের কাছে সে বাহন নেই বা থাকলেও তা নড়বড়ে, সমস্যা তাদের। তাদেরই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় এবং সে জন্য তাদের একেক সময়ে একেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু তা যাতে পর্যবসিত হয় তার নাম সোজাসাপ্টা কথায় বঞ্চনা। সমাজের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমাজের তলানি। এদের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নিম্ন বা সীমাবদ্ধ আয়ের মানুষ, পেনশননির্ভর, কর্মক্ষমতাহীন বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ উপেক্ষিতা প্রবীণা। বাকিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই অথবা বিশ বছর আগে অবসর গ্রহণ করে তৎকালীন হারে প্রদত্ত অবসর ভাতার ওপর নির্ভরশীল এখনও, যখন দ্রব্যমূল্য সম্ভবত বিশগুণ বেড়েছে। তাদের বাঁচার বিড়ম্বনা মাঝে মধ্যে অনুভব করতে চেষ্টা করি। কেমন তাদের যুদ্ধ করে বাঁচার।
মানুষের জীবনের বিচিত্র চাহিদাও তো ব্যাপক। শুধু ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের সঙ্গেই তাকে সম্পর্কিত ভাবা যায় না। স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের রোগব্যাধি হয় ও তার চিকিৎসা করতে হয়। পোশাক-পরিচ্ছদ লাগে। উৎসবে-পার্বণে পছন্দের ভূষণ পরতে ইচ্ছা করে। দরিদ্র আত্মীয়ের প্রয়োজন মেটাতে হয় মানবিক দায়বদ্ধতায়।
এই বহুমুখী চাহিদা পূরণের সীমিত আয়ের মানুষদের শুধু নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়। কাটছাঁট করতে হয় অনেক সাধ-আহ্লাদের, যা অন্য কথায় আত্মবঞ্চনা। মহার্ঘতার সময়ে বা সমাজের প্রয়োজন মেটাবার গণিতটিও জটিল। বঞ্চিতরা অবচেতনেই সর্বক্ষণ স্রেফ টিকে থাকার অঙ্কটি কষে যাচ্ছে। বাজারে যেতে যেতেও মানুষটি কোনো কিছু কেনা বা না কেনার সিদ্ধান্তটি হাজারবার বদলিয়ে যাচ্ছে।
কথা তো ছিল রাষ্ট্রই একটি সুষম বাজার ব্যবস্থা এবং কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে তাদের বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি দেবে। অবশ্য ক্ষমতাসীনরা রোজার সমাগমে প্রথাগতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণ এসব প্রতিশ্রুতির সামান্যই বিশ্বাস করে। মাত্র ক'দিনের অপেক্ষা বাজারের দানবীয় রূপ প্রত্যক্ষ করার। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকবে মন্ত্রীদের বাকচাতুরতা।
মূল সমস্যা আয়ের উৎস না বাড়িয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে চিড়ে ভিজবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অথচ কর্তৃপক্ষ তাই করছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে, যারা চিরদিনের মতো বঞ্চনার শিকার হয়ে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকছে। মূল্যবৃদ্ধি কি শুধু দ্রব্যের? মূল্য বাড়ছে 'সেবা' খাতে বিদ্যুতের (এই সরকারের আমলেই নাকি পঞ্চমবারের মতো)। বাড়তে যাচ্ছে জ্বালানির মূল্য, যা সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আরও বেড়েছে পরিবহনের ভাড়া (অন্তত রেলের ভাড়া বৃদ্ধির কথা শুনেছি)।
সেবা খাতের মূল্য আদায়ের পদ্ধতিটাও কঠোর। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কোনদিক সামলাবে স্বল্প আয়ের মানুষ। সমস্যার ভিমরুল তাকে ছেঁকে থাকে। নির্দয় দংশনের মধ্যেই তাদের বেঁচে থাকা। রোজগারের কোনো বাড়তি উৎস নেই বাড়তি প্রয়োজন মেটাবার। তাই তাদের জীবনের সকল সুন্দর পরিকল্পনাই ভেস্তে যায় অকালে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments