মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ ঠিকানা by মো. ফয়জুর রহমান

আমি ঢাকায় বাস করি। অবসরপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার। জন্মস্থান : গ্রাম-আষ্টসাঙ্গন, বিয়ানীবাজার, সিলেট। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি থেকে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীন ধলা ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্রে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি।


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের খাওয়া, দিনে ভবঘুরেদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্রে তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা এবং রাতে পাকিস্তানিদের ওপর হামলার ব্যবস্থা করে দিতাম। সরকারি গেজেটেড অফিসার থাকায় দিনে পাকিস্তানি মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ নানা অফিসারের সঙ্গে থেকে তাদের এবং সাধারণ সৈন্যদের অবস্থান দেখে মুক্তিবাহিনীকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা ছিল আমার কাজ। আমার দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শ অনুযায়ী রাতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালাত। এতে পাকিস্তানি সৈন্য ও মালামালের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের কুনজরে পড়ি। তারা আমাকে সরাসরি কিছু না বলে ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বে থাকা রাজাকার কমান্ডার ও ময়মনসিংহ জামে মসজিদের পেশ ইমামের ছেলেকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। পরে রাজাকার কমান্ডার আমার দুই চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে হত্যার উদ্দেশ্যে সুতিয়া নদীর তীরে নিয়ে যায়। কমান্ডারের বাবা ময়মনসিংহ জামে মসজিদের ইমাম ওই সময় হিন্দুদের মুসলমান করার জন্য নৌকাযোগে ঘটনাস্থলে আসেন। নদীর ঘাটে চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে দেখে তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, 'ম্যানেজার সাহেবকে চোখ বাঁধা অবস্থায় এখানে এনেছ কেন?' কমান্ডার উত্তর দিল, 'ম্যানেজার সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেন্দ্রে লুকিয়ে রাখেন এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ সরবরাহ করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলার ব্যবস্থা করেন।'
এটি শুনে ইমাম সাহেব কৌশলে বললেন, 'তোর বেতন ৯০ টাকা আর ম্যানেজার সাহেবের বেতন ৯৫০ টাকা, এখন তুই বল পাকিস্তানের জন্য তোর দরদ বেশি, না তার দরদ বেশি?' বলেই তিনি ছেলেকে আদেশ দেন, 'ওনাকে ছেড়ে দে।' ইমাম সাহেব ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চিনতেন। 'ভিক্ষা করা ইসলামে নিষেধ'_ কোরআন ও হাদিসের আলোকে তার কাছ থেকে নেওয়া এ ধরনের কিছু ফতোয়া প্রচারের জন্য আমি আগে থেকেই সমাজসেবা অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতাম।
যদি ইমাম সাহেব ওই সময় ঘটনাস্থলে না পেঁৗছাতেন তাহলে কমান্ডার গুলি করে আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিত। এতে আমার সলিল সমাধি হতো, কবরের প্রয়োজন হতো না। চোখের বাঁধন খোলার পর ওই রাতেই ত্রিপুরা চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই।
আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমিসহ ঢাকায় স্থায়ীভাবে যেসব মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করছি তাদের কবরের জন্য জমি বরাদ্দে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি। যদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৃথক কবরস্থান করা হয় তাহলে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো এটিও গুরুত্ব পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবারও আবেদন জানাচ্ছি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি পৃথক কবরস্থানের নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করুন।

আলহাজ মো. ফয়জুর রহমান :মুক্তিযোদ্ধা ও
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
 

No comments

Powered by Blogger.