কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-মত্তজনের স্বপ্নভাষণ by রণজিৎ বিশ্বাস

স্বপ্ন আপনার কেমন লাগে? : ভালো লাগে। স্বপ্ন আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়। মনে হয়, যে জীবনে স্বপ্ন নেই, সে জীবনে স্রোত নেই। 'যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে'। ভয়ে ভয়ে উদ্ধার করলাম, ছুট বা বিচ্যুতির অপরাধ ক্ষমা করবেন।


: আপনি নিজে স্বপ্ন দেখেন?
: দেখি মানে?! দেখতে দেখতেই তো বিরানব্বই ছাড়াচ্ছি! তবে, এই স্বপ্নদর্শন ও স্বপ্নবীক্ষণের বেলায় একটা জায়গায় এসে আমি বারবার ব্যর্থ হচ্ছি।
: জায়গাটি কী?
: স্বপ্নশিক্ষণ ও স্বপ্নপ্রশিক্ষণ।
: এঙ্প্লেইন করতে হবে।
: এঙ্প্লেইন করার তেমন কিছু নেই। স্বপ্ন সম্পর্কে শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান। ডাল-ভাত, বেগুন ভাজা, শাকচচ্চড়ি আর ফোলাফোলা কড়াকড়া ডিম্বামলিট (ডিম্ব+অমলিট)-সমৃদ্ধ রাজভোগের জন্য যে বাড়িতে শ্রম ঢালি, তা তো দিনে ঘণ্টা দশেক ঢালিই; তার বাইরেও আমি প্রায় প্রতিদিনই কিছু কাজ করি- শ্রমের আনন্দে, মনের আনন্দে ও অর্থের আনন্দে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের কাজ।
সেখানে যাদের আমি পাই, তাদের তো আমি বলিই; ঘরে এসে আমার পুত্রকে বলি, কন্যাকে বলি, তাদের মাথার 'পরে পক্ষপুট বিস্তারকারিণী ও তাদের ব্যাপারে যিনি পক্ষপাতপ্রদায়িনী- তাঁকে বলি ভয়ে ভয়ে কেঁপে কেঁপে। বলি তোমরা স্বপ্নবিশ্বাসী হয়ো, স্বপ্নবিলাসী নয়, বলি- তোমরা স্বপ্নপ্রিয় হও, স্বপ্ননির্ভর ও স্বপ্নজীবী নয়। বলি- স্বপ্নকে কখনো কখনো কর্তন করতে হয়, শোধন করতে হয়, বর্ধন-পরিবর্ধন যেমন করতে হয়, তেমন সঙ্কোচনও করতে হয়। 'স্বপ্নছাঁটন', 'স্বপ্নবাড়ন' ও 'স্বপ্নফোলন'-এর অর্থ বুঝতে হয় এবং বুঝে বুঝে এগোতে হয়।
: তিনটি শব্দের অর্থ বোঝা গেল না।
: বুঝেছি কোন তিনটি শব্দ। 'স্বপ্নছাঁটন' মানে স্বপ্নকে ছেঁটে দেওয়া, সাইজে আনা। 'স্বপ্নবাড়ন' মানে স্বপ্নকে বাড়ানো, বেসাইজ বানিয়ে ফেলা। আর 'স্বপ্নফোলন, মানে স্বপ্নকে ফুলিয়ে ফেলা, হাওয়া ভরা বেলুনের মতো।
: এসব কি প্রমিত বাংলা?!
: না। প্রমিত নয়। এগুলো অমিত বাংলার নতুন অংশ।
: ওরা বোঝে এসব কথা?!
বোঝাতে 'বহত দূর কি বাত'। এসব বোঝাকেও বোঝা মনে করে এবং বোঝার বোঝা কিছুতেই মাথায় নিতে চায় না। ভালোমতো শোনেই না ওরা! কখনো বলে- সময় নেই, কখনো বলে- আমাদের আরো প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কাজ আছে।
: সন্তানদের জননীও তাই বলেন?
: না। তিনি সে রকম মোটেই বলেন না। তিনি তাঁর ক্যাপাসিটি পর্যবেক্ষণক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী বলেন আরো আকর্ষণীয় কথা। শতগুণ আকর্ষণীয়।
: কী বলেন তিনি?
: তিনি বলেন, কোন মত্ত সারমেয় আমার কোমল পেশিতে দন্ত পশায়নি যে তোমার কথা আমাকে শুনতে হবে, তোমার শিক্ষা আমাকে নিতে হবে। তোমার কথা তুমি তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে বলো। তাতে তিন-চারটি সম্ভাবনা তৈরি হবে।
: তিন-চারটি সম্ভাবনা মানে?!
: তুমি কি আরো বেশি চাও নাকি?!
প্রথম সম্ভাবনা, যেহেতু বর্ষাকাল হলেও বাজারে পাওয়া যায়, প্রচুর পচা টমেটোর বর্ষণসোহাগ পেতে পার। দ্বিতীয় সম্ভাবনা, একই সোহাগ তুমি পেতে পার নষ্ট ডিম্বেরও। তৃতীয় সম্ভাবনা, পরিবার-পরিত্যক্ত অসহায় উন্মাদ বিবেচনায় কেউ কেউ তোমার অঙ্গবরাবর দু-চারটে খুচরো পয়সাও ছুড়ে দিতে পারে। চতুর্থ সম্ভাবনা ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ মানুষ তোমার বস্ত্রহরণকে উপযুক্ত করণীয় ভাবতে পারে। তেমন যদি হয়, বিবেচক জনগণকে আমি ও আমার ভাইয়েরা মিলে উদার সহযোগ ও মুক্ত সহায়তা দেব।
: আপনি তখন কী করেন?
: ঝিমধরা মাথা নিয়ে বসে থাকি। আর ভাবি, সংসার কেন এত সুন্দর! সংসার কেন এত চমৎকার ও মধুময়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.