স্মরণ-বাংলা সাহিত্যের রহস্যময় নক্ষত্র by দীপংকর চন্দ
২০০৮ সালের ২১ জুলাই লোকান্তরিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের রহস্যময় নক্ষত্র মাহমুদুল হক। তাঁর বহু বৈপরীত্যে পূর্ণ জীবনের কথা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা পথ অতিক্রম করলাম আমরা। মহাখালী, বনানী, খিলক্ষেত পেছনে ফেলে উপস্থিত হলাম উত্তরায়।
ঢাকা মহানগরের অভিজাত এই আবাসিক এলাকার একটি অংশে বাস করেন মাহমুদুল হকের সখা আহসানউল্লাহ খান। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জমে উঠল আড্ডা। প্রাণবন্ত সেই আড্ডার অনিবার্য প্রসঙ্গ হিসেবে অতি দ্রুতই উঠে এলেন মাহমুদুল হক।
মাহমুদুল হকের সঙ্গে আহসানউল্লাহ খানের পরিচয় ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুসলিম স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আহসানউল্লাহ খান তখন ভর্তি হয়েছেন জগন্নাথ কলেজে। কলেজজীবনের শুরুতেই মানিক নামের একজন সহপাঠীর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল তাঁর। মানিক ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের ছাত্র। ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে মানিকের সহপাঠী ছিলেন মাহমুদুল হক। মূলত মানিকের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরেই মাহমুদুল হকের সঙ্গে সৃষ্টি হলো আহসানউল্লাহ খানের বন্ধুত্বের বন্ধন।
মাহমুদুল হকের ঘরোয়া নাম বটু। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতে। তাঁর বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান তিনি।
মাহমুদুল হকের বাবা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বিভাগ-উত্তর বাংলায় আসেন পরিবার ছাড়াই। সৌভাগ্যক্রমে সরকারি চাকরিও পেয়ে যান তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকায় আসে সিরাজুল ইসলামের পরিবার। আজিমপুর সরকারি আবাসের ১৪/এফ নম্বর বাসায় বসবাস শুরু করেন তাঁরা। ১৯৫২ সালে লালবাগের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন বারাসাতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা মাহমুদুল হক।
স্কুলে শিক্ষারত অবস্থায়ই সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি হয় মাহমুদুল হকের। তাঁর শিক্ষক কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবেরের অনুপ্রেরণায় অগ্রগামী নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে সৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘দুর্ঘটনা’। মাহমুদুল হক যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের বাংলার শিক্ষক মোহাম্মদ সুলতানের সাহচর্য ও প্রেরণায় ছাত্র ইউনিয়নের স্কুল শাখা গঠন করেন তিনি।
‘১৯৫৫ কিংবা ১৯৫৬ সালে ইত্তেহাদ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় “উঁচুতলার সিঁড়ি” নামে একটি গল্প ছাপা হয় তাঁর। মাহমুদুল হকের অন্তরঙ্গ অভিমতে এটিই তাঁর লেখা প্রথম বড়দের গল্প’, বললেন মাহমুদুল হকের বহু স্মৃতির সাক্ষী আহসানউল্লাহ খান।
সাহিত্যে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও জীবনের সাময়িক সংযোগ স্থাপন করেন মাহমুদুল হক। ১৯৫৭-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তির পর সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে তাঁর, অল্প দিনের ব্যবধানে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও।
১৯৫৯ সালে সংবাদে চাকরি শুরু করেন মাহমুদুল হক। তিন মাস পর চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ব্যবসা করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গড়ে তোলেন সম্পর্ক। ১৯৬০ সালে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মনিহারি ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন পর মনিহারি ব্যবসা গুটিয়ে গড়ে তোলেন ‘তাসমেন জুয়েলার্স’ নামে অত্যন্ত সফল একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
১৯৬৭ সালে মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের পাঠানতোলার আহম্মদ আলী খান ও আজগরী বেগমের জ্যেষ্ঠ কন্যা হোসনে আরা কাজলের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন মাহমুদুল হক। ১৯৬৮ সালে তিনি রচনা করেন প্রথম উপন্যাস নিরাপদ তন্দ্রা।
১৯৬৯ সালে জন্ম নিল মাহমুদুল হকের পুত্র সিমুয়েল হক। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হলো অনুর পাঠশালা। ১৯৭১ সালে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রক্তক্ষরা এই সময় জন্ম নিল তাঁর কন্যা তাহমিনা মাহমুদ।
‘সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত মাহমুদুল হকের জীবন অতিবাহিত হলো স্বচ্ছন্দ গতিতে। ১৯৮১ সালে শেষ উপন্যাস পাতালপুরী লিখলেন তিনি’, স্মৃতিতাড়িত কণ্ঠ আহসানউল্লাহ খানের। তিনি আরও জানালেন, ‘১৯৮২ সালের পর তেমন কিছু লেখেননি মাহমুদুল হক। কেবল একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন ’৯৫-এর দিকে, কায়সুল হক সম্পাদিত শৈলীতে। গল্পের নাম ‘বনফুল’। এরপর সম্ভবত আর কিছু লেখেননি মাহমুদুল হক।’
কিন্তু কেন লেখেননি আর? যখন তাঁর কলমের নির্যাস আরও দূরপথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত, তখন কেন তিনি সরে এলেন সাহিত্যচর্চা থেকে? বহুজনের বহুল উচ্চারিত প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হয় পুনরায় আমাদের কণ্ঠে।
উত্তরে মাহমুদুল হকের আমৃত্যু সঙ্গী আহসানউল্লাহ খান ইঙ্গিত করেন নতুন এক যাত্রাপথের দিকে, ইঙ্গিত করেন নতুন এক অভিসারের দিকে। তিনি বলেন, ‘মানুষ যখন বড় কোনো সত্যের দেখা পায়, বড় কোনো উত্তরের কাছে পৌঁছায়, জীবনের অনেক প্রাত্যহিকতাই সম্ভবত নিষপ্রয়োজন হয়ে যায়।’
কথাগুলোর উৎস কি ব্যাখ্যাতীত অতীন্দ্রিয়বাদ? ধারণাতীত এমন কিছু যা সুস্পষ্ট নয়, স্বচ্ছ নয় বিষয়বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন মানুষের কাছে? বিষয়টি জটিল! নাকি সহজ! এতই সহজ, যার ব্যাখ্যা সহজে মেলে না!
দীপংকর চন্দ
মাহমুদুল হকের সঙ্গে আহসানউল্লাহ খানের পরিচয় ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুসলিম স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আহসানউল্লাহ খান তখন ভর্তি হয়েছেন জগন্নাথ কলেজে। কলেজজীবনের শুরুতেই মানিক নামের একজন সহপাঠীর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল তাঁর। মানিক ছিলেন ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের ছাত্র। ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে মানিকের সহপাঠী ছিলেন মাহমুদুল হক। মূলত মানিকের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরেই মাহমুদুল হকের সঙ্গে সৃষ্টি হলো আহসানউল্লাহ খানের বন্ধুত্বের বন্ধন।
মাহমুদুল হকের ঘরোয়া নাম বটু। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতে। তাঁর বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। মায়ের নাম মাহমুদা বেগম। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান তিনি।
মাহমুদুল হকের বাবা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বিভাগ-উত্তর বাংলায় আসেন পরিবার ছাড়াই। সৌভাগ্যক্রমে সরকারি চাকরিও পেয়ে যান তিনি। ১৯৫১ সালে ঢাকায় আসে সিরাজুল ইসলামের পরিবার। আজিমপুর সরকারি আবাসের ১৪/এফ নম্বর বাসায় বসবাস শুরু করেন তাঁরা। ১৯৫২ সালে লালবাগের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন বারাসাতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা মাহমুদুল হক।
স্কুলে শিক্ষারত অবস্থায়ই সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি হয় মাহমুদুল হকের। তাঁর শিক্ষক কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবেরের অনুপ্রেরণায় অগ্রগামী নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে সৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প ‘দুর্ঘটনা’। মাহমুদুল হক যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের বাংলার শিক্ষক মোহাম্মদ সুলতানের সাহচর্য ও প্রেরণায় ছাত্র ইউনিয়নের স্কুল শাখা গঠন করেন তিনি।
‘১৯৫৫ কিংবা ১৯৫৬ সালে ইত্তেহাদ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় “উঁচুতলার সিঁড়ি” নামে একটি গল্প ছাপা হয় তাঁর। মাহমুদুল হকের অন্তরঙ্গ অভিমতে এটিই তাঁর লেখা প্রথম বড়দের গল্প’, বললেন মাহমুদুল হকের বহু স্মৃতির সাক্ষী আহসানউল্লাহ খান।
সাহিত্যে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও জীবনের সাময়িক সংযোগ স্থাপন করেন মাহমুদুল হক। ১৯৫৭-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তির পর সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে তাঁর, অল্প দিনের ব্যবধানে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও।
১৯৫৯ সালে সংবাদে চাকরি শুরু করেন মাহমুদুল হক। তিন মাস পর চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ব্যবসা করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গড়ে তোলেন সম্পর্ক। ১৯৬০ সালে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে মনিহারি ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন পর মনিহারি ব্যবসা গুটিয়ে গড়ে তোলেন ‘তাসমেন জুয়েলার্স’ নামে অত্যন্ত সফল একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
১৯৬৭ সালে মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের পাঠানতোলার আহম্মদ আলী খান ও আজগরী বেগমের জ্যেষ্ঠ কন্যা হোসনে আরা কাজলের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেন মাহমুদুল হক। ১৯৬৮ সালে তিনি রচনা করেন প্রথম উপন্যাস নিরাপদ তন্দ্রা।
১৯৬৯ সালে জন্ম নিল মাহমুদুল হকের পুত্র সিমুয়েল হক। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হলো অনুর পাঠশালা। ১৯৭১ সালে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রক্তক্ষরা এই সময় জন্ম নিল তাঁর কন্যা তাহমিনা মাহমুদ।
‘সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত মাহমুদুল হকের জীবন অতিবাহিত হলো স্বচ্ছন্দ গতিতে। ১৯৮১ সালে শেষ উপন্যাস পাতালপুরী লিখলেন তিনি’, স্মৃতিতাড়িত কণ্ঠ আহসানউল্লাহ খানের। তিনি আরও জানালেন, ‘১৯৮২ সালের পর তেমন কিছু লেখেননি মাহমুদুল হক। কেবল একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন ’৯৫-এর দিকে, কায়সুল হক সম্পাদিত শৈলীতে। গল্পের নাম ‘বনফুল’। এরপর সম্ভবত আর কিছু লেখেননি মাহমুদুল হক।’
কিন্তু কেন লেখেননি আর? যখন তাঁর কলমের নির্যাস আরও দূরপথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত, তখন কেন তিনি সরে এলেন সাহিত্যচর্চা থেকে? বহুজনের বহুল উচ্চারিত প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হয় পুনরায় আমাদের কণ্ঠে।
উত্তরে মাহমুদুল হকের আমৃত্যু সঙ্গী আহসানউল্লাহ খান ইঙ্গিত করেন নতুন এক যাত্রাপথের দিকে, ইঙ্গিত করেন নতুন এক অভিসারের দিকে। তিনি বলেন, ‘মানুষ যখন বড় কোনো সত্যের দেখা পায়, বড় কোনো উত্তরের কাছে পৌঁছায়, জীবনের অনেক প্রাত্যহিকতাই সম্ভবত নিষপ্রয়োজন হয়ে যায়।’
কথাগুলোর উৎস কি ব্যাখ্যাতীত অতীন্দ্রিয়বাদ? ধারণাতীত এমন কিছু যা সুস্পষ্ট নয়, স্বচ্ছ নয় বিষয়বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন মানুষের কাছে? বিষয়টি জটিল! নাকি সহজ! এতই সহজ, যার ব্যাখ্যা সহজে মেলে না!
দীপংকর চন্দ
No comments