বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৬১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।সাইদুল আলম, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সাহসী যোদ্ধা প্রায় দেড় মাস ধরে ব্যাপক যুদ্ধ-উন্মাদনার মধ্যে আছেন সাইদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা। তখন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়।
অক্টোবর মাসের শেষ দিক থেকে বৃহত্তর সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে একের পর এক যুদ্ধ করেছেন তাঁরা। ২৮ অক্টোবর ধলই বিওপিতে; এরপর পাত্রখোলা, চারগ্রাম ও গৌরীপুরে। এর মধ্যে ধলই বিওপি ও গৌরীপুরের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ।
মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল (এক ব্যাটালিয়ন শক্তি) গৌরীপুরে পৌঁছানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পূর্ণ শক্তিতে অগ্রসর হয়ে তাঁদের আক্রমণ করে। সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ বেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়।
এ সময় লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (বীর প্রতীক, পরে মেজর) নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গ্রুপ ও এলএমজি গ্রুপের ফায়ারিং সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সুকৌশলে অগ্রসর হয়ে শত্রু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নাকের ডগার মধ্যে পৌঁছে যায়।
সাইদুল আলম ছিলেন মেশিনগান গ্রুপে। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন। এরপর দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সাইদুল আলমদের মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় এবং জীবিতরা সিলেটে পালিয়ে যায়।
গৌরীপুর যুদ্ধের পর সাইদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) নেতৃত্বে রওনা হন সিলেট শহর অভিমুখে। শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে সেখানে তাঁরা পৌঁছালেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি সেনাদের। তারা ঘোরাঘুরি করছে।
একের পর এক যুদ্ধে সাইদুল আলমরা কিছুটা পরিশ্রান্ত। এ ছাড়া প্রচণ্ড শীত। তাঁদের শীতবস্ত্রও মোটেই নেই। প্রায় তিন দিন তাঁরা প্রায় অনাহারে। কিন্তু তাঁদের যুদ্ধ করার আগ্রহে কোনোভাবে ভাটা পড়ল না, বরং মনোবল আরও বেড়ে গেল। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
শত্রুর নাকের ডগায় ৫০০ গজ দূরে টিলার ওপর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সাইদুল আলমরা পজিশন নিতে থাকলেন। তখনই হঠাৎ শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। তাঁদের দলের কাছে তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা আছে মাত্র ১৪টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই গোলা শেষ হয়ে গেল। সাইদুল এতে বিচলিত হলেন না। মেশিনগান দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন। মেশিনগান গ্রুপের নিপুণ গুলিবর্ষণে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। শেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
সাইদুল আলম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট তাঁদের আক্রমণ করে। তখন তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত সিলেট এমসি কলেজের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য সাইদুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৭।
সাইদুল আলম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার চরকরমজী গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার সাভারের ডেন্ডাবরের কাঁঠালবাগানে। বাবার নাম ইসরাইল বিশ্বাস, মা লালবানু বিবি। স্ত্রী সেলিনা আলম। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: সাইদুল আলম বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল (এক ব্যাটালিয়ন শক্তি) গৌরীপুরে পৌঁছানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পূর্ণ শক্তিতে অগ্রসর হয়ে তাঁদের আক্রমণ করে। সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ বেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়।
এ সময় লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (বীর প্রতীক, পরে মেজর) নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গ্রুপ ও এলএমজি গ্রুপের ফায়ারিং সাপোর্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সুকৌশলে অগ্রসর হয়ে শত্রু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নাকের ডগার মধ্যে পৌঁছে যায়।
সাইদুল আলম ছিলেন মেশিনগান গ্রুপে। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন। এরপর দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সাইদুল আলমদের মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় এবং জীবিতরা সিলেটে পালিয়ে যায়।
গৌরীপুর যুদ্ধের পর সাইদুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) নেতৃত্বে রওনা হন সিলেট শহর অভিমুখে। শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে সেখানে তাঁরা পৌঁছালেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানি সেনাদের। তারা ঘোরাঘুরি করছে।
একের পর এক যুদ্ধে সাইদুল আলমরা কিছুটা পরিশ্রান্ত। এ ছাড়া প্রচণ্ড শীত। তাঁদের শীতবস্ত্রও মোটেই নেই। প্রায় তিন দিন তাঁরা প্রায় অনাহারে। কিন্তু তাঁদের যুদ্ধ করার আগ্রহে কোনোভাবে ভাটা পড়ল না, বরং মনোবল আরও বেড়ে গেল। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
শত্রুর নাকের ডগায় ৫০০ গজ দূরে টিলার ওপর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সাইদুল আলমরা পজিশন নিতে থাকলেন। তখনই হঠাৎ শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। তাঁদের দলের কাছে তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা আছে মাত্র ১৪টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই গোলা শেষ হয়ে গেল। সাইদুল এতে বিচলিত হলেন না। মেশিনগান দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন। মেশিনগান গ্রুপের নিপুণ গুলিবর্ষণে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। শেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
সাইদুল আলম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট তাঁদের আক্রমণ করে। তখন তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত সিলেট এমসি কলেজের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য সাইদুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৭।
সাইদুল আলম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে নায়েক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার চরকরমজী গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার সাভারের ডেন্ডাবরের কাঁঠালবাগানে। বাবার নাম ইসরাইল বিশ্বাস, মা লালবানু বিবি। স্ত্রী সেলিনা আলম। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: সাইদুল আলম বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments