ইতিহাসে আছেন তাঁরাও!
এরিক মুসাম্বানি, পলা বারিলা বোলোপাদের দেখলে আধুনিক অলিম্পিকের স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন নিশ্চিতভাবেই দারুণ খুশি হতেন। না, এমন কোনো অতিমানবীয় কীর্তি তাঁরা করে যাননি, অলিম্পিকের সর্বকালের সেরাদের কাতারের ধারেকাছেও আসে না তাঁদের নাম।
তবে দ্য কুবার্তিনের মস্তিষ্কপ্রসূত অলিম্পিকের আসল চেতনারই যথার্থ বার্তাবাহক তাঁরা। খেলাটায় অংশগ্রহণই আসল কথা, জয়-পরাজয় নয়।
কী করেছিলেন তাঁরা, যার জন্য দ্য কুবার্তিন তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করতে পারলে সম্মানিতই হতেন? উত্তরটা জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে ইকুয়েটোরিয়াল গিনির এরিক ‘দ্য এল’ মুসাম্বানি অংশ নিয়েছিলেন ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে। পদক জেতা দূরে থাক, বলার মতো কিছুই করতে পারেননি তিনি। উল্টো সাঁতার কাটতে নেমে প্রথমে জুগিয়েছিলেন হাসির খোরাক, খাবি খেতে খেতে কোনোমতে শেষ করেছিলেন। সেটাও আবার ১০০ মিটারে সবচেয়ে ধীরগতির রেকর্ড করে, সময় নিয়েছিলেন পাক্কা ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ড। যে টাইমিংটা ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ডের চেয়েও কম। মজার ব্যাপার হলো, অলিম্পিকে আসার আগে কখনো ৫০ মিটারের সুইমিং পুলই দেখেননি এই প্রতিযোগী, সাঁতার শিখেছিলেন অলিম্পিকে আসার কেবল আট মাস আগে! অদ্ভুতুড়ে সেই সাঁতারের পর তাই রাতারাতি বিখ্যাতই হয়ে যান মুসাম্বিনি। শেষ দিকে তো দর্শকের অফুরান হর্ষধ্বনি ও উৎসাহেই সাঁতার শেষ করতে পারেন। এই ঘটনার পর সেবার অলিম্পিকে রীতিমতো পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন এই সাঁতারু।
এই ইকুয়েটোরিয়াল গিনিরই আরেক সাঁতারু পলা বারিলা বোলোপা। মহিলাদের ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতার কাটতে নামার আগে জানতেন, এটুকু সাঁতরাতেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাঁকে। সেটা পুড়িয়েছিলেন, সময় নিয়েছিলেন ১.০৩.৯৭ মিনিট—এই ইভেন্টে যেটা সবচেয়ে ধীরগতির টাইমিং। তার পরও দর্শকেরা তাঁকে অভিবাদন জানাতে ভোলেনি, দুর্দান্ত স্পৃহার জন্য তো বটেই, অলিম্পিকের আসল চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্যও।
আরেকজন হার না মানা অ্যাথলেট ছিলেন আফগানিস্তানের আবদুল বাসের ওয়াসিকি। তাঁর ক্ষেত্রে ঘটনাটা অবশ্য এরিকদের মতো ছিল না। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে পুরুষদের ম্যারাথনটা শেষ করার মতো সামর্থ তাঁর ছিল। তবে দৌড়ের আগে ভাগ্য যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়েছিল। কে জানত, হঠাৎ করেই হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু হয়ে পড়বেন? এর পরও তিনি যেন ধনুর্ভঙ্গপণ করেছিলেন, যেভাবে হোক দৌড় শেষ করবেনই। ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা বোধহয় একেই বলে। ৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে যখন সবার শেষে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছলেন, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসিয়ালরা সবকিছু গোটানোর আয়োজন করছিলেন। হতে পারে ১১১ জন প্রতিযোগীর সর্বশেষজন তিনি, কিন্তু অলিম্পিকের সত্যিকার চেতনার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিনিধি সেবার তিনিই ছিলেন।
এমনিভাবে আরও অনেকেরই নাম করা যায়। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে হাইতির ওলেমুস দৌড় শেষ করেছিলেন সবার পরে, ১০ হাজার মিটার পার করতেই সময় নিয়েছিলেন ৪২ মিনিট ১১ সেকেন্ড! সিউল ১৯৮৮ অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সাকোন্নিনহোম সময় নিয়েছিলেন ১৫.১২ সেকেন্ড। আজকের যেকোনো হাইস্কুলের গড়পড়তা প্রতিযোগীও এর চেয়ে জোরে দৌড়াতে পারে। ২০০৪-এর এথেন্স অলিম্পিকের মহিলা ম্যারাথনে মঙ্গোলিয়ার ওতগোনবায়ার ছিলেন সবার শেষে, ২০০০ সিডনিতে ফিনিশ সাইক্লিস্ট কাসলিন ৫০০ মিটার টাইম ট্রায়ালে সময় নিয়েছিলেন প্রায় ৩৭.১৪৫ সেকেন্ড, আটলান্টা অলিম্পিকের রোয়িংয়ের একক স্কাল ইভেন্টটি আলজেরিয়ান মেয়ে হিরেচে যোজন যোজন ব্যবধানে সবার শেষে শেষ করেছিলেন ৯ মিনিট ২৮.৪১ সেকেন্ড সময়ে।
এঁদের কারোরই আন্তর্জাতিক মঞ্চে বড় কিছু করে দেখানোর সামর্থ্য ছিল না। দেশের হয়ে গলায় পদক ঝুলিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সৌভাগ্যও কারও হয়নি। কিন্তু একটা জায়গায় সবাই মিশে গিয়েছিলেন এক বিন্দুতে। হারার আগে এঁদের কেউই হারেননি, মাঝপথে হাল ছেড়ে দেননি। নিজেদের সীমিত সামর্থ্যকে পুঁজি করেই লড়াই করে গিয়েছেন। ল্যাটিন শব্দ ‘সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফরটিয়াস’কে বাংলা করলে অলিম্পিকের মূলমন্ত্র দাঁড়ায়, ‘দ্রুততর, উচ্চতর, আরো শক্তিধর’। এবার লন্ডন অলিম্পিকে শ্লথ, নিম্নতর ও দুর্বলতরদের জায়গা হবে না, এটি নিশ্চিত। তবে এঁদেরই কেউ কেউ আবার নায়কও হবেন এটাও ঠিক।
এএফপি অবলম্বনে
মোসতাকিম হোসেন
কী করেছিলেন তাঁরা, যার জন্য দ্য কুবার্তিন তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করতে পারলে সম্মানিতই হতেন? উত্তরটা জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে ইকুয়েটোরিয়াল গিনির এরিক ‘দ্য এল’ মুসাম্বানি অংশ নিয়েছিলেন ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে। পদক জেতা দূরে থাক, বলার মতো কিছুই করতে পারেননি তিনি। উল্টো সাঁতার কাটতে নেমে প্রথমে জুগিয়েছিলেন হাসির খোরাক, খাবি খেতে খেতে কোনোমতে শেষ করেছিলেন। সেটাও আবার ১০০ মিটারে সবচেয়ে ধীরগতির রেকর্ড করে, সময় নিয়েছিলেন পাক্কা ১ মিনিট ৫২ সেকেন্ড। যে টাইমিংটা ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ডের চেয়েও কম। মজার ব্যাপার হলো, অলিম্পিকে আসার আগে কখনো ৫০ মিটারের সুইমিং পুলই দেখেননি এই প্রতিযোগী, সাঁতার শিখেছিলেন অলিম্পিকে আসার কেবল আট মাস আগে! অদ্ভুতুড়ে সেই সাঁতারের পর তাই রাতারাতি বিখ্যাতই হয়ে যান মুসাম্বিনি। শেষ দিকে তো দর্শকের অফুরান হর্ষধ্বনি ও উৎসাহেই সাঁতার শেষ করতে পারেন। এই ঘটনার পর সেবার অলিম্পিকে রীতিমতো পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন এই সাঁতারু।
এই ইকুয়েটোরিয়াল গিনিরই আরেক সাঁতারু পলা বারিলা বোলোপা। মহিলাদের ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতার কাটতে নামার আগে জানতেন, এটুকু সাঁতরাতেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাঁকে। সেটা পুড়িয়েছিলেন, সময় নিয়েছিলেন ১.০৩.৯৭ মিনিট—এই ইভেন্টে যেটা সবচেয়ে ধীরগতির টাইমিং। তার পরও দর্শকেরা তাঁকে অভিবাদন জানাতে ভোলেনি, দুর্দান্ত স্পৃহার জন্য তো বটেই, অলিম্পিকের আসল চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্যও।
আরেকজন হার না মানা অ্যাথলেট ছিলেন আফগানিস্তানের আবদুল বাসের ওয়াসিকি। তাঁর ক্ষেত্রে ঘটনাটা অবশ্য এরিকদের মতো ছিল না। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে পুরুষদের ম্যারাথনটা শেষ করার মতো সামর্থ তাঁর ছিল। তবে দৌড়ের আগে ভাগ্য যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়েছিল। কে জানত, হঠাৎ করেই হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু হয়ে পড়বেন? এর পরও তিনি যেন ধনুর্ভঙ্গপণ করেছিলেন, যেভাবে হোক দৌড় শেষ করবেনই। ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা বোধহয় একেই বলে। ৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে যখন সবার শেষে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছলেন, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসিয়ালরা সবকিছু গোটানোর আয়োজন করছিলেন। হতে পারে ১১১ জন প্রতিযোগীর সর্বশেষজন তিনি, কিন্তু অলিম্পিকের সত্যিকার চেতনার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিনিধি সেবার তিনিই ছিলেন।
এমনিভাবে আরও অনেকেরই নাম করা যায়। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে হাইতির ওলেমুস দৌড় শেষ করেছিলেন সবার পরে, ১০ হাজার মিটার পার করতেই সময় নিয়েছিলেন ৪২ মিনিট ১১ সেকেন্ড! সিউল ১৯৮৮ অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সাকোন্নিনহোম সময় নিয়েছিলেন ১৫.১২ সেকেন্ড। আজকের যেকোনো হাইস্কুলের গড়পড়তা প্রতিযোগীও এর চেয়ে জোরে দৌড়াতে পারে। ২০০৪-এর এথেন্স অলিম্পিকের মহিলা ম্যারাথনে মঙ্গোলিয়ার ওতগোনবায়ার ছিলেন সবার শেষে, ২০০০ সিডনিতে ফিনিশ সাইক্লিস্ট কাসলিন ৫০০ মিটার টাইম ট্রায়ালে সময় নিয়েছিলেন প্রায় ৩৭.১৪৫ সেকেন্ড, আটলান্টা অলিম্পিকের রোয়িংয়ের একক স্কাল ইভেন্টটি আলজেরিয়ান মেয়ে হিরেচে যোজন যোজন ব্যবধানে সবার শেষে শেষ করেছিলেন ৯ মিনিট ২৮.৪১ সেকেন্ড সময়ে।
এঁদের কারোরই আন্তর্জাতিক মঞ্চে বড় কিছু করে দেখানোর সামর্থ্য ছিল না। দেশের হয়ে গলায় পদক ঝুলিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সৌভাগ্যও কারও হয়নি। কিন্তু একটা জায়গায় সবাই মিশে গিয়েছিলেন এক বিন্দুতে। হারার আগে এঁদের কেউই হারেননি, মাঝপথে হাল ছেড়ে দেননি। নিজেদের সীমিত সামর্থ্যকে পুঁজি করেই লড়াই করে গিয়েছেন। ল্যাটিন শব্দ ‘সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফরটিয়াস’কে বাংলা করলে অলিম্পিকের মূলমন্ত্র দাঁড়ায়, ‘দ্রুততর, উচ্চতর, আরো শক্তিধর’। এবার লন্ডন অলিম্পিকে শ্লথ, নিম্নতর ও দুর্বলতরদের জায়গা হবে না, এটি নিশ্চিত। তবে এঁদেরই কেউ কেউ আবার নায়কও হবেন এটাও ঠিক।
এএফপি অবলম্বনে
মোসতাকিম হোসেন
No comments