সহজ-সরল-মানুষ থেকে অ্যামিবা সবাই ভালো আছে তো? by কনকচাঁপা

মার বাড়ির সামনের বারান্দা, মানে আমার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে সামনের বাড়ির গাছগুলো চোখে পড়ে। আমার চোখ তো_কত জরুরি কিছু এ চোখ চেয়েও দেখে না; আবার এমন কিছু চোখে পড়ে, যা শুনে অন্যে হাসবে। যাক যা বলছিলাম, একদম সামনে যে গাছটা, সেটা যে কী গাছ বুঝলাম না। ভাবলাম কোনো কাঠগাছ। পরে দেখি আমের বোলের মতো গন্ধ ছড়িয়ে গাছটা ফুলবতী হয়ে উঠল।


সেখান থেকে যে ফল হলো, তা সম্ভবত আঁশফল। দেখা যাক কী দাঁড়ায় তার ফলাফল। ফল না দেখে পরিচয় বুঝতে পারছি না। ঘটনা সেটা নয়। ঘটনা হলো কাকের সংসার। যে কাককে আমি 'কাউয়া' বলে অবহেলা করি। অবহেলা করব না? না আছে রুচি, না আছে চরিত্র। একে তো চোর, তায় আবার নোংরা ঘাটে। কিন্তু এ বাসায় এসে তাদের সম্পর্কে ভুল ভাঙল। আসলে কাউকে না জেনেশুনে অবহেলা বা বাজে মন্তব্য কিছুই করতে হয় না। এটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, কাউয়ার ক্ষেত্রেও তেমন প্রযোজ্য। আমি ভাবতাম, ওরা অসম্ভব নোংরা। পরে দেখি, না, ওরা পানি পেলেই গোসল করে। রীতিমতো গা মেজেঘষে শাওয়ার নেয়। সাবানের কাজ কী দিয়ে সারে আল্লাহই জানেন। যাক, একদিন ওই সম্ভাব্য আঁশফলের গাছে তিনটা ডালের সংযোগস্থলে একটা কাক দেখি লোহালক্কড়, কাগজ, জুতার তলি, পলিথিন দিয়ে যাচ্ছেতাই বাসা বানাচ্ছে।
বাসাটা বানাতে চার-পাঁচ দিন সময় নিল। পলিথিন থেকে রাবার_কী নাই তাতে এবং তাতে আরো আছে অলিখিত আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কা। আমি তো আবার দূরে ভালো দেখি না, তাই ভিডিও ক্যামেরা জুম করে কাকের তামাশা দেখছি ক্রমানুসারে। কাজে যাওয়ার আগে দেখি, কাজ থেকে এসে দেখি_এমনই অবস্থা। একদিন দেখি ওই বাসায় দুটি কাকের আনাগোনা। এ যায় তো ও আসে। স্বামী-স্ত্রী। দুজন মিলে কাজ করছে_সো নাইস কাপল। একদিন দেখি তিনটি ডিম। তাজ্জব! কখন পাড়ল? আরে ওর কি লজ্জাশরম নেই? আমার সামনেই ডিম পাড়ে? তো, সখাসখী দুজন মিলেই তা দিচ্ছে।
অজানা ভয়ে রাগী রাগী চেহারা দুজনেরই। একজন সারা দিন তা দেয়। বাকিজন মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয়। টিফিন এনে দেয়। দেখিনি মনে হলো। এমন সময় আবহাওয়া খারাপ হলো_নিম্নচাপ। ভীষণ ঝড়বৃষ্টি। কাকটা সারা শরীর দিয়ে ডিম তিনটি আগলে রাখল। আমার খুব চিন্তা ও মন খারাপ, যদি ডিম না ফোটে? চোখ জলে ভিজে যেতে চায়! আবার ভাবি, কাকের ডিম না ফুটলে তোর কী? তোদের সম্প্রদায় যে কত ভ্রূণ মায়ের পেটেই হত্যা করিস, তা জানলে কাক সম্প্রদায় ঘৃণায় মারা যাবে। একদিন সকালে ভিডিও ক্যামেরার চোখে দেখি তিনটি বাচ্চা। বিশাল বিশাল মাথা। আজব লালচে। দেখলে মায়া হয় না মোটেও। আল্লাহই জানেন ওর মধ্যে কোনটা কোকিলের বাচ্চা!
অবশ্য ডিমগুলো একই রকম হালকা সবুজ ছিটওয়ালা ছিল। মা কাকটা কী যেন এনে খাওয়ায়। আমি এবার পুরো কাক জাতিকে চুরি করে খাওয়ার অপরাধ মাফ করে দিই। বরং আমারই লজ্জা লাগে সামনে একজন সদ্যঃপ্রসূতি ও তিনটি শিশুকে ডেকে এনে কিছু খাওয়ানোর অপারগতায়। যাক, এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই বসে থাকে না। কাক তো আর মানুষের বাসায় দাওয়াত খায় না! এটা আমাকে বুঝতে হবে। এই পৃথিবীতে ওদের খাওয়ার অভাব নেই। বিশাল এ পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা সবার জন্যই সব কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তার পরও অনেক কিছু পাওয়ার জন্য একমাত্র মানুষই অনেক কাড়াকাড়ি, মারামারি, খুনখারাবি করে। বাঘ-সিংহ কিন্তু ক্ষুধা না লাগলে শিকারের পেছনে দৌড়ায় না। একটা কুকুর বিড়ালের বাচ্চাকে যৌন হয়রানি করে না। তবু ওরা আমাদের কাছে জানোয়ার!
একদিন দেখি বাচ্চাসহ কাকটা যেন কোথায় চলে গেল। আশ্চর্য! আমাকে একটু বলেও গেল না? হা হা হা, যাক, উড়ে যাক। যেখানেই যাক ভালো থাক। ভালো থাক মানুষ থেকে অ্যামিবা, রাজা থেকে ফকির। কিন্তু আসলে সবাই ভালো আছে তো?
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.