এম জে আকবর-ত্রিমাত্রিক সংকটে পাকিস্তান

পাকিস্তানের প্রথম অভ্যুত্থান হয়েছিল একজন বেসামরিক ব্যক্তির মাধ্যমে। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই চরিত্র খাজা নাজিমুদ্দিন এবং গোলাম মোহাম্মদ আলোচনায় এলেন ওই সময়। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্নেহধন্য। ওই সময় পাকিস্তানের পরিবর্তনে কিছুটা আতঙ্কও ছিল। কারণ ওই সময়ও পাকিস্তান ছিল ব্রিটিশ শাসনভুক্ত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল।


পাকিস্তান পুরোপুরি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে ২ মার্চ ১৯৫৬ সালে, যখন তারা নিজেদের সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি দেশটি। কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই জেনারেল আইয়ুব খান অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বসেন। আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ৫৬ বছর পরও পাকিস্তানকে বাইরের দিকে তাকাতে হয় তাদের এখানকার সংকট কাটাতে সাহায্য করার জন্য।
মাসকয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ দূত হিসেবে গিয়েছিলেন হোসাইন হাক্কানি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা। আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি যুক্তরাজ্যে টেলিফোন করেছিলেন। যদিও ওই টেলিফোনের বিষয়টি গিলানি এবং যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত অস্বীকার করেছেন। এ ধরনের কার্যক্রম কিন্তু নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছেই। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট যদি এ কাজগুলো করেই থাকেন তাহলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্ব কতটা আছে, তা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী যে ক্ষমতা তাঁদের দুজনকে প্রদান করেছে তাতে তাঁরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীপ্রধান আশফাক কায়ানিকে বরখাস্ত করতে পারেন, যেভাবে তাঁরা প্রতিরক্ষা সচিব নাইম লোধিকে ইতিপূর্বে বরখাস্ত করেছিলেন। তবে তাঁদের রাজনৈতিক বীক্ষণ বলে দেয় এ ধরনের কোনো নির্দেশ যদি তাঁরা প্রদান করেন তাহলে সেনাবাহিনী তাঁদের সোজা কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। তবে আমরা জানি না আসিফ আলি জারদারি তাঁদের আরেক মিত্র দেশ সৌদি আরবকে অনুরোধ করলে বিষয়টি কোনদিকে গিয়ে গড়াবে। সেটা কিছু ইতিবাচক ফলও বয়ে আনতে পারে, এটাও ঠিক। এটা ঠিক সেখানকার ক্ষমতালোভীদের অনেকেই আবার রিয়াদের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন।
এখন অবস্থাটা যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হয় পাকিস্তান বোধ হয় পারভেজ মোশাররফের আগমন প্রত্যাশা করছে। অথচ এই ব্যক্তিটি পাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়েছিলেন। যিনি পাকিস্তানে মুসলিম লীগ নামে একটি দলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীত পন্থী হিসেবে গণ্য হয়েছে। জারদারির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও আলোচিত। তিনি প্রত্যহ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই যুদ্ধ দিনের পর দিন চলছেই। গিলানি কোনো কোনো সময় জেনারেলদের প্রশংসা করে পরিস্থিতি নমনীয় করারও চেষ্টা করেন। মনে হতে পারে তিনি নিজের অবস্থান থেকে কিছুটা পেছনে ফিরে আসছেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারির ক্ষেত্রেও মনে হয় তিনিও যেন মাঝেমধ্যে পিছু হটছেন। এমনটা মনে হয় তাঁর দুবাই আর ইসলামাবাদ আসা-যাওয়া করার মধ্য দিয়ে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে তিনিই একমাত্র পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট, যাঁর জন্য ইসলামাবাদ এবং দুবাইয়ে অফিস করতে হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁকে অন্তরালে চলে যেতে হয়েছিল হৃদরোগের কারণে। তাঁর দুবাই আসা-যাওয়ার ব্যাপারটিও কিন্তু সহজ নয়। তিনি কি সেখানে প্রটোকল মেনে আসা-যাওয়া করেন? তাঁর আসা-যাওয়ার পথে নিরাপত্তার ব্যাপারটিই বা কিভাবে দেখা হয়। জারদারির দুর্নীতি অভিযোগের বিষয়টি আমলে নেওয়ার মতো। তাঁর বৈদেশিক ব্যাংক হিসাব নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তারও কিন্তু কোনো তদন্ত হয়নি।
জারদারি সরকারের জনপ্রিয়তার মাত্রা শূন্যের কোঠার দিকে ধাবিত হওয়ার পেছনে কারণ কী? আমাদের উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা হ্রাসের কোনো মাত্রা নিশ্চিত করা যায় না। একটা সময় আসে তখন সরকারের জনপ্রিয়তা যেন হ্রাস পেতেই হয়। নৈতিকতার বিষয়টি এখানে বিবেচ্য হয়ে থাকে। নৈতিক সমর্থন কিন্তু খুবই কমে গেছে। পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান রোধ করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোনো পদের কর্মকর্তাই চান না এমন প্রতিবন্ধকতা সেখানে আইনানুগভাবে তৈরি হোক। তবে সরকারের উচিত এ মুহূর্তে সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করা। মানুষ যা ভালো মনে করে তাই সিদ্ধান্ত নেবে। এতে করে যে বিষ ঢুকেছে তা নিরসন হতে পারত। এতে করে ওখানকার রীতিপ্রথায় যে নেতিবাচক একটা প্রভাব পড়েছে, তাও হয়তো পরিবর্তন হতো। সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করে তাদের দেশের সেনাবাহিনী একটি ইতিবাচক বাহিনীর সদস্য। এটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাই বোধ হয় নিয়ামক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রশ্ন হচ্ছে জারদারি-গিলানিরা কি জনমতের দিকে তাকাবেন?

লেখক : দিলি্ল থেকে প্রকাশিত সানডে গার্ডিয়ানের সম্পাদক এবং এডিটরিয়াল ডাইরেক্টর, ইন্ডিয়া টুডে এবং হেডলাইনস টুডে।
দ্য ডন থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.