সচিবদের কাজে সন্তুষ্ট নয় সরকার by শরীফুল ইসলাম

শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অবহেলাসহ নানা কারণে জনপ্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না। মন্ত্রণালয়ের অনিষ্পন্ন কাজ মাসের পর মাস ফেলে রাখা হচ্ছে। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নেও দেখা গেছে ধীরগতি। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কোনো কোনো কর্মকর্তা সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেলেও তারা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে সাফল্য দেখাতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ফাইলের অধিকাংশেই নানা ত্রুটি ধরা পড়ছে।


সম্প্রতি সচিবদের দক্ষতা ও উপস্থাপিত সারসংক্ষেপ দেখে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন আর প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের কথা জানিয়ে সচিবদের সতর্ক করে কয়েক দফা চিঠি দেন মুখ্য সচিব শেখ ওয়াহিদ উজ্জামান; কিন্তু তারপরও সচিবদের কাজের চেহারা পাল্টায়নি। এ অবস্থায় সচিবদের দক্ষতা মূল্যায়নের কাজ শুরু করা হচ্ছে। দক্ষতা অনুযায়ী তাদের দফতর পুনর্বণ্টনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সরকারি একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গত সোমবার যোগাযোগ খাতের সচিবদের ডেকে পাঠিয়ে তিনি এ খাতের
সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। পাশাপাশি কাজে আরও আন্তরিক হতে তাদের নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ ওয়াহিদ উজ্জামান সমকালকে বলেন, সচিবদের কাজের গতি আরও বাড়াতে বিভিন্ন সময় নির্দেশনামূলক চিঠি দেওয়া হচ্ছে। সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করা হচ্ছে। তাদের নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে কেউ অদক্ষতার পরিচয় দিলে সরকার তা নজরে আনবে। এটিই স্বাভাবিক।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সচিবদের তিন বছরের আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে। এতে যাদের অদক্ষতার পরিচয় মিলবে, তাদের ডাম্পিং পোস্টিং করা হবে। আর যারা যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন করে আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, সচিবদের অধিকাংশই দাফতরিক কাজের চেয়ে নিজের পদ-পদবি ঠিক রাখার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তোষামোদিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। 'রুলস অব বিজনেস' যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠানোর নিয়মকানুন সম্পর্কে কোনো কোনো সচিবের ধারণা খুবই কম। অনেক সচিব তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো সারসংক্ষেপগুলোয় নানা ত্রুটি ধরা পড়ছে। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সচিবদের দক্ষতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এমন ১৬ সচিবের কর্মদক্ষতা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। অথচ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে এসব কর্মকর্তাকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হলেও কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারছেন না তারা। এক বছরের বেশি সময় সচিবের দায়িত্বে থাকলেও অধীন কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারছেন না তারা। এ কারণে সরকারি কাজে গতি আসছে না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে দায়িত্ব পালনে সচেতনতা ও মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি আনতে সতর্ক করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, সচিবরা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করতে পারছেন না। সরকারের কাজে প্রত্যাশিত গতি যেভাবে আসা প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় এসব প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজগুলো সম্পন্নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে 'রুলস অব বিজনেস' যথাযথভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাও কাজে আসেনি।
সচিবদের কাজকর্ম আগের মতোই রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্পের এক ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের চিত্রও সন্তোষজনক নয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারও বেশিরভাগ সচিবের দফতর পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য আগে তাদের দক্ষতার মূল্যায়ন করা হবে। সচিবদের পারফরম্যান্স রিপোর্ট চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টও এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে। এগুলো পাওয়ার পর সহসাই সচিবদের দফতরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হবে বলে জানা গেছে।
যে কারণে সমস্যা : বিগত তিন বছরে মেধা ও যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অনেককে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাদের দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত সচিবের দু'বছরের অভিজ্ঞতা না থাকলেও অনেকে সচিব হয়েছেন। ফলে অভিজ্ঞতার অভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠেছে। অথচ মেধাক্রমে প্রথম স্থান পাওয়া কর্মকর্তারা পদে পদে বঞ্চিত। দলনিরপেক্ষ অনেক কর্মকর্তাকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। যারা সচিব হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের লেখা নোটের ওপর ভিত্তি করেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে ফাইল। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে এলে তার দায় চাপানো হচ্ছে অধীন কর্মকর্তাদের ওপর।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, মেধাশূন্য প্রশাসন সরকারের জন্য সুখকর নয়। মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।

No comments

Powered by Blogger.