শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে by আতাউস সামাদ
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে নিহত দেশের সব বুদ্ধিজীবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সব শহীদকে জানাই সালাম। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল নরপিশাচ পাকিস্তানি জেনারেলরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে।
তবে বাঙালি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়নি বা করুণা ভিক্ষা করেনি। নিরস্ত্র বাঙালিরা অল্প কয়েকদিনের ভেতর প্রথমে বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক ও পুলিশদের কাছ থেকে এবং পরে মিত্র শক্তি ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে সংগঠিত হয়ে বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানা আরম্ভ করে।
পাকিস্তানিরা তাদের প্রথম হামলার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, ছাত্র ও অন্য কর্মচারীদের হত্যা করে। ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হলও তাদের পৈশাচিক আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি। যুদ্ধের পরবর্তী ৯ মাসে তারা দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার ও প্রকৌশলীকে বেছে বেছে হত্যা করে। একই সঙ্গে তাদের হাতে হাটে-বাজারে, গ্রামগঞ্জে গণহত্যা হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গেলেই দেখতে পেত পথের পাশে লাশ, ধানক্ষেতে লাশ, নদী-খাল-বিলে লাশ। একাত্তরে গ্রাম পুড়তে ও নদী-নালায় লাশ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে একাধিকবার। আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে এক জার্মান কূটনীতিকের সঙ্গে, যিনি গল্পচ্ছলে জানিয়ে দিতেন পাকিস্তানিদের সমর প্রস্তুতির খবর, জানতে চাইতেন বাঙালিরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছেন। এ কূটনীতিক মোটরযোগে ঢাকা থেকে সোনারগাঁ যাওয়ার পথে এক মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। শুনেছি, এক বঙ্গভাষী পাকিস্তানি মন্ত্রীকে মারার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সেই মাইনটি পেতেছিলেন। আসলে যে কার মাইন ছিল সেটা তা পরে আর খোঁজ করতে পারিনি। তবে সে সময় ভেবেছিলাম যে, ওই পথে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানিরাই হয়তো সেটা বসিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বসলে ভাবছিলাম যে অবরুদ্ধ বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার হয়তো এবার কিছুটা কমবে, কারণ তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর লাগাতার হামলায় ঢাকায় পাকিস্তানি সরকার ও সৈন্যরা আপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওই সময়ই পাকিস্তানিরা তাদের ঘৃণিত কতিপয় বাঙালি দোসরকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাদের তালিকা অনুযায়ী বাঙালি সাংবাদিক, শিক্ষক, কবি-লেখক, চিকিত্সকদের ধরে নিয়ে শহরতলির বধ্যভূমিতে হত্যা করে। এই হতভাগাদের মধ্যে ছিলেন নারী সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। ঢাকায় এ ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড তারা শুরু করেছিল ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিবাগত রাত থেকে। সে রাতে আমার মা, স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে আমি অবস্থান করছিলাম পুরানা পল্টন লাইনে আমার ভগ্নিপতি জনাব এওএম শামসুদ্দোহার বাড়িতে। ওই রাতে পাশের এক বাড়ি থেকে বন্ধু সাংবাদিক নাজমুল হককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিদের সশস্ত্র বঙ্গভাষী সহযোগীরা। ১১ ডিসেম্বর ভোর হওয়ার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে জানতে পারি নয়াপল্টনে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে আমার খোঁজে ও আমার বন্ধু সাপ্তাহিক হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খানকে তার অফিসে ও বাসায় খুঁজছে পাকিস্তানি খুনিরা। আমরা আত্মগোপনে যাই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। তার দু’দিন পর মুন্সীগঞ্জের শেখর নগর গ্রামে আশ্রয়দাতা জনাব আজিজুল হকের মারফত জানতে পারি যে, ঢাকায় বহু সাংবাদিক অপহৃত ও নিখোঁজ হয়েছেন। সেদিনই আবার শুনি, ঢাকার শহরতলিতে তাদের গলিত লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সম্মানিত অন্য পেশাজীবীদের গুম ও হত্যা করার কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। আজকে চোখের সামনে ভেসে উঠছে শ্রদ্ধেয় শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ ও এসএ মান্নানের মুখ। এরা সবাই আমার অগ্রজতুল্য ও বিখ্যাত সাংবাদিক। মনে পড়ে বন্ধু নাজমুল হকের সরল হাসিমাখা চেহারা, আরও মনে পড়ে সদা হাস্যময় কবি-সাংবাদিক আনম গোলাম মোস্তফার কথা, আড্ডারত ড. ফজলে রাব্বি ও আবদুল আলিমের কথা। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সক ডা. মোর্তজার কথা। এদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। একাত্তরের মধ্য-ডিসেম্বরে এদের সবাইকে কারফিউ চলাকালে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও দোসররা। বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার সময় নাজমুলের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদের শব্দ আজ পর্যন্ত কান থেকে মুছে যায়নি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে শেষ দেখেছিলাম নভেম্বরে ধানমণ্ডি ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে। কিছুটা বিমর্ষ ছিলেন কি তিনি তখন? সিদ্দিক ভাইয়ের সেই ফার্মেসিতে আমার স্ত্রীর বড় ভাই ডা. আনোয়ারুল হক বসতেন। নভেম্বরে তাকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী—অপরাধ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপন তথ্য পাচার। তিনি ক্যান্টনমেন্টে আটক থাকার সময় সেখানে বিমান হামলা হলে তাদের কয়েকজনকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়ায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। তাকে আটক করার কয়েকদিন আগে রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে তার বন্ধু ডা. আজহারকে। এই শহীদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল কমলাপুর-মতিঝিল দিয়ে বয়ে চলত যে খাল তার একটা কালভার্টের নিচে। এরই মধ্যে খবর এল আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমিশনপ্রাপ্ত, লে. আশফাকুস সামাদ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়েছে জয়মনিরহাটে। এসব ঘটনা চলতে থাকার সময় একদিন শহীদুল্লাহ কায়সার ভাইকে দেখলাম তার ভোকসওয়াগন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন শাহবাগ দিয়ে। সেদিন খুবই অবাক হয়েছিলাম তাকে এভাবে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখে। ১৯৭০ সালে তিনি যখন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আমি তখন সাধারণ সম্পাদক। সে বছর জানুয়ারিতে তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সব সাংবাদিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করেছিল ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’ অবজ্ঞা করে। সে সময় শহীদুল্লাহ কায়সার ভাই আমাকে আত্মগোপন করার কিছু কৌশল বলে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিজে সেগুলো কাজে লাগাননি, কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি তার শেখানো বিদ্যা ব্যবহার করেছিলাম। নিজামুদ্দিন ভাই যুদ্ধের সময় এপ্রিলের পর থেকে বিবিসির জন্য খবর পাঠাতেন। তার আগে বিবিসি সংবাদদাতা ছিলেন শ্রদ্ধেয় এবিএম মূসা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য সম্পর্কে নিজাম ভাইয়ের পাঠানো একটি রিপোর্ট বিবিসি তার নামে প্রচার করেছিল। এরপর পাকিস্তানিদের দখলকৃত এলাকায় প্রকাশ্যে অবস্থান করা তার জন্য ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবু তিনি কেন যে থেকে গেলেন অন্তত আমি আজও জানতে পারিনি। একটু আগে যে ধানমন্ডি ফার্মেসির কথা লিখেছি সেখানে প্রায়ই আসতেন মেজর (অব.) আমিন। তার এক সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল, সে আজও ফিরে আসেনি। সেই নিখোঁজ ছেলেটির এক বোন আজকের খ্যাতনামা শিল্পী সারা যাকের। কীভাবে কোথা থেকে সে নিখোঁজ হলো তার নিশ্চিত তথ্য আজও জানা যায়নি। একইভাবে নিখোঁজ হয় আমাদের এক আত্মীয় সরকারি কর্মকর্তা জনাব কেএম রহমানের ছেলে খোকন। সে ছিল স্কুলছাত্র। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। নিখোঁজদের মধ্যে প্রবীণরাও আছেন। যেমন—বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বাম রাজনীতিক জনাব সাইদুল হাসান ও আইন প্রতিষ্ঠান অরডিংহ্যামের পরিচালক আহাদ সাহেবকে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়ে তাদের আর ফিরিয়ে দেয়নি।
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা প্রধানত যাদের স্মরণ করি তারা ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মধ্যে নিহত হন। আজ এদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মনে পড়ছে আমার শিক্ষক অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান এবং আমাদের ভালোবাসার মানুষ মধু দা’র কথা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এদের হত্যা করেছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১ দিবাগত রাতে তারা যে হামলা শুরু করে তখনই। আর তারপর তো তারা থামেনি। দেশজুড়ে ৯ মাস ধরেই তারা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করেছে। আরও অনেক বিশিষ্টজনকেও খুন করেছে তারা, যেমন সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র, দানবীর আরপি সাহা ও কিংবদন্তিতে পরিণত সুরকার আলতাফ মাহমুদকে। নৃশংস দখলদার বাহিনী ওই ৯ মাসে কাউকে মেরেছে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে, কাউকে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য, কাউকে তাদের প্রেরণাদানকারী হিসেবে আর কাউকে নিছক বিদ্বেষবশত। আবার উন্মত্ত প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন কেউ, যেমন বিশিষ্ট সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব। তাদের মনে হয়েছে এদের খুন করতে হবে। আর তারা পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত তাই করেছে। এসবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। জঘন্য আরও একটি কাজ করেছে তারা। কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার পর তারা নিহতের পরিবারবর্গের কাছে না দিয়েছে লাশ ফেরত, না জানিয়েছে তাদের করুণ পরিণতির কথা। আমাদের স্নেহাস্পদ মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবুল বাশার চৌধুরী এমন একজন। এও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের সময় এভাবে সারাদেশে নিহত বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের নাম ও তাদের হত্যার কাহিনী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। দেশের সব গণকবর চিহ্নিত করে সেখানকার হত্যাকাণ্ডগুলোর কাহিনী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করাও আমাদের কর্তব্য। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করেছে। যথাযথভাবে চিহ্নিত ও তাদের অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি হোক যুদ্ধাপরাধীদের। আশা করি, এসব মামলায় জড়িত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নাম, ভূমিকা, অপরাধ বর্ণনা এবং রেকর্ড করা হবে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত পাকিস্তানি সৈনিকদের ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার উপমহাদেশে শান্তির লক্ষ্যে ক্ষমা করে দিয়েছিল, এই অজুহাতে যেন একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানিদের অপরাধের কথা এবার এড়িয়ে যাওয়া না হয়। প্রস্তাবিত বিচারে কী হবে তা অদূর ভবিষ্যতে সবাই দেখবেন, কিন্তু সম্ভবত তাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা যে জেনোসাইড করেছে তার ব্যাপকতা ও নৃশংসতার চিত্রটি পুরোপুরি ফুটে উঠবে না। তাই সেই কাজটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে কেউ চিন্তাভাবনা করলে কৃতজ্ঞ থাকব। আজ আমরা প্রায়ই কাউকে না কাউকে বলতে শুনি যে, দেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। কত বড় ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে তা যখন খানিকটা বিস্তারিতভাবে জানতে পারবে বর্তমানের নতুন প্রজন্ম ও আগামীর প্রজন্মরা তখন তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করবে কী অমূল্য এই স্বাধীনতা। তখন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার প্রতি হুমকি প্রতিহত করবে। আপাতত, আমার আবেদন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারাদেশের নিহত সব বুদ্ধিজীবীর কথা যেন আমরা মনে করি। আর সব সময়ই সব শহীদের কথা অন্তরে রাখি।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
পাকিস্তানিরা তাদের প্রথম হামলার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, ছাত্র ও অন্য কর্মচারীদের হত্যা করে। ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হলও তাদের পৈশাচিক আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি। যুদ্ধের পরবর্তী ৯ মাসে তারা দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার ও প্রকৌশলীকে বেছে বেছে হত্যা করে। একই সঙ্গে তাদের হাতে হাটে-বাজারে, গ্রামগঞ্জে গণহত্যা হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গেলেই দেখতে পেত পথের পাশে লাশ, ধানক্ষেতে লাশ, নদী-খাল-বিলে লাশ। একাত্তরে গ্রাম পুড়তে ও নদী-নালায় লাশ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে একাধিকবার। আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে এক জার্মান কূটনীতিকের সঙ্গে, যিনি গল্পচ্ছলে জানিয়ে দিতেন পাকিস্তানিদের সমর প্রস্তুতির খবর, জানতে চাইতেন বাঙালিরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছেন। এ কূটনীতিক মোটরযোগে ঢাকা থেকে সোনারগাঁ যাওয়ার পথে এক মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। শুনেছি, এক বঙ্গভাষী পাকিস্তানি মন্ত্রীকে মারার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সেই মাইনটি পেতেছিলেন। আসলে যে কার মাইন ছিল সেটা তা পরে আর খোঁজ করতে পারিনি। তবে সে সময় ভেবেছিলাম যে, ওই পথে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানিরাই হয়তো সেটা বসিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বসলে ভাবছিলাম যে অবরুদ্ধ বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার হয়তো এবার কিছুটা কমবে, কারণ তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর লাগাতার হামলায় ঢাকায় পাকিস্তানি সরকার ও সৈন্যরা আপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওই সময়ই পাকিস্তানিরা তাদের ঘৃণিত কতিপয় বাঙালি দোসরকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাদের তালিকা অনুযায়ী বাঙালি সাংবাদিক, শিক্ষক, কবি-লেখক, চিকিত্সকদের ধরে নিয়ে শহরতলির বধ্যভূমিতে হত্যা করে। এই হতভাগাদের মধ্যে ছিলেন নারী সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। ঢাকায় এ ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড তারা শুরু করেছিল ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিবাগত রাত থেকে। সে রাতে আমার মা, স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে আমি অবস্থান করছিলাম পুরানা পল্টন লাইনে আমার ভগ্নিপতি জনাব এওএম শামসুদ্দোহার বাড়িতে। ওই রাতে পাশের এক বাড়ি থেকে বন্ধু সাংবাদিক নাজমুল হককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিদের সশস্ত্র বঙ্গভাষী সহযোগীরা। ১১ ডিসেম্বর ভোর হওয়ার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে জানতে পারি নয়াপল্টনে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে আমার খোঁজে ও আমার বন্ধু সাপ্তাহিক হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খানকে তার অফিসে ও বাসায় খুঁজছে পাকিস্তানি খুনিরা। আমরা আত্মগোপনে যাই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। তার দু’দিন পর মুন্সীগঞ্জের শেখর নগর গ্রামে আশ্রয়দাতা জনাব আজিজুল হকের মারফত জানতে পারি যে, ঢাকায় বহু সাংবাদিক অপহৃত ও নিখোঁজ হয়েছেন। সেদিনই আবার শুনি, ঢাকার শহরতলিতে তাদের গলিত লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সম্মানিত অন্য পেশাজীবীদের গুম ও হত্যা করার কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। আজকে চোখের সামনে ভেসে উঠছে শ্রদ্ধেয় শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ ও এসএ মান্নানের মুখ। এরা সবাই আমার অগ্রজতুল্য ও বিখ্যাত সাংবাদিক। মনে পড়ে বন্ধু নাজমুল হকের সরল হাসিমাখা চেহারা, আরও মনে পড়ে সদা হাস্যময় কবি-সাংবাদিক আনম গোলাম মোস্তফার কথা, আড্ডারত ড. ফজলে রাব্বি ও আবদুল আলিমের কথা। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সক ডা. মোর্তজার কথা। এদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। একাত্তরের মধ্য-ডিসেম্বরে এদের সবাইকে কারফিউ চলাকালে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও দোসররা। বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার সময় নাজমুলের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদের শব্দ আজ পর্যন্ত কান থেকে মুছে যায়নি। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে শেষ দেখেছিলাম নভেম্বরে ধানমণ্ডি ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে। কিছুটা বিমর্ষ ছিলেন কি তিনি তখন? সিদ্দিক ভাইয়ের সেই ফার্মেসিতে আমার স্ত্রীর বড় ভাই ডা. আনোয়ারুল হক বসতেন। নভেম্বরে তাকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী—অপরাধ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপন তথ্য পাচার। তিনি ক্যান্টনমেন্টে আটক থাকার সময় সেখানে বিমান হামলা হলে তাদের কয়েকজনকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়ায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। তাকে আটক করার কয়েকদিন আগে রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে তার বন্ধু ডা. আজহারকে। এই শহীদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল কমলাপুর-মতিঝিল দিয়ে বয়ে চলত যে খাল তার একটা কালভার্টের নিচে। এরই মধ্যে খবর এল আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমিশনপ্রাপ্ত, লে. আশফাকুস সামাদ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়েছে জয়মনিরহাটে। এসব ঘটনা চলতে থাকার সময় একদিন শহীদুল্লাহ কায়সার ভাইকে দেখলাম তার ভোকসওয়াগন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন শাহবাগ দিয়ে। সেদিন খুবই অবাক হয়েছিলাম তাকে এভাবে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখে। ১৯৭০ সালে তিনি যখন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আমি তখন সাধারণ সম্পাদক। সে বছর জানুয়ারিতে তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সব সাংবাদিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করেছিল ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’ অবজ্ঞা করে। সে সময় শহীদুল্লাহ কায়সার ভাই আমাকে আত্মগোপন করার কিছু কৌশল বলে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিজে সেগুলো কাজে লাগাননি, কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমি তার শেখানো বিদ্যা ব্যবহার করেছিলাম। নিজামুদ্দিন ভাই যুদ্ধের সময় এপ্রিলের পর থেকে বিবিসির জন্য খবর পাঠাতেন। তার আগে বিবিসি সংবাদদাতা ছিলেন শ্রদ্ধেয় এবিএম মূসা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য সম্পর্কে নিজাম ভাইয়ের পাঠানো একটি রিপোর্ট বিবিসি তার নামে প্রচার করেছিল। এরপর পাকিস্তানিদের দখলকৃত এলাকায় প্রকাশ্যে অবস্থান করা তার জন্য ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবু তিনি কেন যে থেকে গেলেন অন্তত আমি আজও জানতে পারিনি। একটু আগে যে ধানমন্ডি ফার্মেসির কথা লিখেছি সেখানে প্রায়ই আসতেন মেজর (অব.) আমিন। তার এক সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল, সে আজও ফিরে আসেনি। সেই নিখোঁজ ছেলেটির এক বোন আজকের খ্যাতনামা শিল্পী সারা যাকের। কীভাবে কোথা থেকে সে নিখোঁজ হলো তার নিশ্চিত তথ্য আজও জানা যায়নি। একইভাবে নিখোঁজ হয় আমাদের এক আত্মীয় সরকারি কর্মকর্তা জনাব কেএম রহমানের ছেলে খোকন। সে ছিল স্কুলছাত্র। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। নিখোঁজদের মধ্যে প্রবীণরাও আছেন। যেমন—বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বাম রাজনীতিক জনাব সাইদুল হাসান ও আইন প্রতিষ্ঠান অরডিংহ্যামের পরিচালক আহাদ সাহেবকে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়ে তাদের আর ফিরিয়ে দেয়নি।
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা প্রধানত যাদের স্মরণ করি তারা ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের মধ্যে নিহত হন। আজ এদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মনে পড়ছে আমার শিক্ষক অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান এবং আমাদের ভালোবাসার মানুষ মধু দা’র কথা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এদের হত্যা করেছিল ২৫ মার্চ, ১৯৭১ দিবাগত রাতে তারা যে হামলা শুরু করে তখনই। আর তারপর তো তারা থামেনি। দেশজুড়ে ৯ মাস ধরেই তারা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করেছে। আরও অনেক বিশিষ্টজনকেও খুন করেছে তারা, যেমন সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র, দানবীর আরপি সাহা ও কিংবদন্তিতে পরিণত সুরকার আলতাফ মাহমুদকে। নৃশংস দখলদার বাহিনী ওই ৯ মাসে কাউকে মেরেছে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে, কাউকে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য, কাউকে তাদের প্রেরণাদানকারী হিসেবে আর কাউকে নিছক বিদ্বেষবশত। আবার উন্মত্ত প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন কেউ, যেমন বিশিষ্ট সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব। তাদের মনে হয়েছে এদের খুন করতে হবে। আর তারা পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত তাই করেছে। এসবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। জঘন্য আরও একটি কাজ করেছে তারা। কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার পর তারা নিহতের পরিবারবর্গের কাছে না দিয়েছে লাশ ফেরত, না জানিয়েছে তাদের করুণ পরিণতির কথা। আমাদের স্নেহাস্পদ মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবুল বাশার চৌধুরী এমন একজন। এও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের সময় এভাবে সারাদেশে নিহত বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের নাম ও তাদের হত্যার কাহিনী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। দেশের সব গণকবর চিহ্নিত করে সেখানকার হত্যাকাণ্ডগুলোর কাহিনী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করাও আমাদের কর্তব্য। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করেছে। যথাযথভাবে চিহ্নিত ও তাদের অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি হোক যুদ্ধাপরাধীদের। আশা করি, এসব মামলায় জড়িত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নাম, ভূমিকা, অপরাধ বর্ণনা এবং রেকর্ড করা হবে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত পাকিস্তানি সৈনিকদের ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার উপমহাদেশে শান্তির লক্ষ্যে ক্ষমা করে দিয়েছিল, এই অজুহাতে যেন একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানিদের অপরাধের কথা এবার এড়িয়ে যাওয়া না হয়। প্রস্তাবিত বিচারে কী হবে তা অদূর ভবিষ্যতে সবাই দেখবেন, কিন্তু সম্ভবত তাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা যে জেনোসাইড করেছে তার ব্যাপকতা ও নৃশংসতার চিত্রটি পুরোপুরি ফুটে উঠবে না। তাই সেই কাজটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে কেউ চিন্তাভাবনা করলে কৃতজ্ঞ থাকব। আজ আমরা প্রায়ই কাউকে না কাউকে বলতে শুনি যে, দেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। কত বড় ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে তা যখন খানিকটা বিস্তারিতভাবে জানতে পারবে বর্তমানের নতুন প্রজন্ম ও আগামীর প্রজন্মরা তখন তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করবে কী অমূল্য এই স্বাধীনতা। তখন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার প্রতি হুমকি প্রতিহত করবে। আপাতত, আমার আবেদন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারাদেশের নিহত সব বুদ্ধিজীবীর কথা যেন আমরা মনে করি। আর সব সময়ই সব শহীদের কথা অন্তরে রাখি।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments