সময়ের প্রতিধ্বনি-ট্রানজিট নিয়ে এত লুকোচুরি কেন? by মোস্তফা কামাল

ট্রানজিট ইস্যু নিয়ে পর্যালোচনার শুরুতে এ-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির (কোর কমিটি) সদস্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, নৌ-প্রটোকল সংশোধনের সময় মাসুল আরোপ না করা সরকারের একটি বড় ভুল। ফলে এখন বিনা পয়সায় ভারত ট্রানজিট নিচ্ছে। এতে আমাদের খারাপ লাগছে। তিনি বলেন, বিনা মাসুলে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আটকানো যেত। সরকার বলতে পারত, এখনো পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই।


তাই এ মুহূর্তে ট্রানজিট পণ্য আনা-নেওয়া সম্ভব নয়। সরকার গঠিত ট্রানজিট-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির সুপারিশেও বলা হয়েছিল, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় আগামী তিন বছর সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া ঠিক হবে না। অবশ্য অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দুই বছর আগে সহজ শর্তে যে ঋণ ভারতের দেওয়ার কথা ছিল, তা এখনো পায়নি বাংলাদেশ। ভারতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। তার পরও সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছে। তাও আবার বিনা মাসুলে! এটা জনগণের সঙ্গে এক ধরনের ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৯ অক্টোরব (২০১১) আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট শুরু হয়েছে। নৌ-ট্রানজিটের সুবিধা নিয়ে নিয়মিত ট্রানজিটের প্রথম চালান ১৬০ টন লোহাজাতীয় পণ্য আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আগরতলায় গেছে। এসব পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার ইস্পাত কম্পানির। প্রতিবেদনে বলা হয়, আশুগঞ্জ নৌবন্দর পর্যন্ত নৌপথে এবং আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো মাসুল আরোপ করতে পারেনি শুল্ক বিভাগ।
অথচ গত বছরের ২ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে সভাপতি করে বিশেষ কমিটি (কোর কমিটি) গঠন করে। কমিটিতে আরো আছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ এবং এনবিআরের সদস্য শাহ আলম খান। কমিটি দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। এ জন্য কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময় অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া হলে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন কার্গো বহন করা সম্ভব হবে। তবে কমিটি আপাতত ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করে। ট্রান্সশিপমেন্ট দিলে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ লাখ টন কার্গো বহন করা যাবে। কমিটি ট্রানজিটের জন্য সড়ক ও রেলপথের জন্য সাতটি করে ১৪টি এবং নৌপথের জন্য তিনটি_মোট ১৭টি রুট চিহ্নিত করে। একই সঙ্গে বর্তমান রুটের পরিস্থিতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের জোর সুপারিশ করে। প্রস্তাবিত রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিড়ি-থেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর, বেতুলি-পুরাতন রাঘনাবাজার, চাতলাপুর-মানু, তামাবিল-ডাউকি, হালুয়াঘাট-ঘাসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-শীলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহানপুর-সিংহাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল।
মাসুল আদায়ের ব্যাপারে কোর কমিটির সুপারিশে বলা হয়, সড়ক, রেল ও নৌপথে নিম্নোক্ত হারে ফি আদায় করা যেতে পারে। সড়কপথে প্রতি কিলোমিটারে টনপ্রতি ৫.২৫ টাকা, রেলপথে ২.২৫ টাকা এবং নৌপথে ১.৮৮ টাকা। সুপারিশে এও বলা হয়, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, অবকাঠামো, কাস্টম, বন্দর ব্যবস্থাপনা, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খরচ বিবেচনা করেই ট্রানজিটের মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে কম হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
কোর কমিটির এই সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হলেও তা আমলেই নেওয়া হয়নি। কমিটির সঙ্গে সরকার থেকে কোনো বৈঠকও করেনি। তাহলে কেন এই লোক-দেখানো কমিটি গঠন? কমিটি এত দিন ধরে মেধা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রতিবেদন তৈরি করেই বা কী লাভ হলো?
ট্রানজিটের জন্য আলাদা চুক্তি সইয়ের কথা বারবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও রহস্যজনক কারণে আলাদা কোনো চুক্তি করা হয়নি। ভারত বলেছে, ১৯৭২ ও ১৯৮০ সালের নৌ-ট্রানজিট চুক্তির আলোকে দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চালু হয়েছে। এই ইস্যুতে ভারতের সূক্ষ্ম কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময় ১৯৮০ সালের নৌ-ট্রানজিট প্রটোকল নবায়ন করা হয়। তখন ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ট্রানজিটের জন্য পোর্ট অব কল হিসেবে আশুগঞ্জকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেই সুযোগটিই নিয়েছে ভারত। এ সময় যদি বাংলাদেশ ট্রানজিটের মাসুল আরোপের বিষয়টি উল্লেখ করতে পারত, তাহলেও এখন অন্তত বিনা মাসুলে ট্রানজিট দিতে হতো না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় আমি দিলি্লতে তাঁর সফর কাভার করতে গিয়েছিলাম। দিলি্লতে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পারলাম, আশুগঞ্জকে পোর্ট অব কল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করায় ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া হয়ে গেছে। কারণ নৌপথে ভারতীয় পণ্য নিশ্চয়ই আখাউড়ায় এনে ফেলে রাখবে না। সেগুলো কোনো না কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। আগরতলায় নিতে হলে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই নিতে হবে। কাজেই আমরা ঢাকায় সে অনুযায়ী প্রতিবেদনও পাঠালাম।
পরে সরকার হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বড় ভুল তারা করে ফেলেছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ডেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হলো এভাবে, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছেন, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট দিতে আপত্তি নেই। সে ক্ষেত্রে ট্রানজিট ইসু্যুতে ভারতের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।' রাতে শেষমুহূর্তে ঢাকাকে জানালাম, প্রথমবার পাঠানো প্রতিবেদনের সংশোধনী আছে। ট্রানজিট শুধু ভারতকে নয়, এর সঙ্গে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সংবাদ সম্মেলন করে আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট দেওয়ার কথা বললেন। সরকারের তরফ থেকেও বলা হলো, ট্রানজিট দেওয়ার আগে ভারতের সঙ্গে ঝুলে থাকা অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করতে হবে। সেগুলোর জন্য ট্রানজিটকে 'ট্রাম্পকার্ড' হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর, তিস্তাসহ ৫৩টি আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা ইত্যাদি।
এর মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণ সমস্যার সমাধানে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে ঢাকায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়। এ ছাড়া ভারত বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও দুই বছর আগে বাংলাদেশকে ভারতের ঋণ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই ইস্যুগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া আত্মঘাতী বলে মনে করি। কারণ এখন আর বাংলাদেশের হাতে দরকষাকষির জন্য কিছুই রইল না।
অবশ্য এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দেশের সড়ক অবকাঠামো, অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করেই ট্রানজিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরাও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জেনেছিলাম, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই না হওয়ায় শেখ হাসিনা বেঁকে বসেছিলেন। তিনি তখন অত্যন্ত বীরোচিত ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নাকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিয়েছিলেন, তিস্তা চুক্তি সই না হলে কোনো চুক্তিই সই হবে না।
আমরা তখন এক ধরনের স্বস্তি পেয়েছিলাম এই বলে যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার আপত্তি করে তাহলে ভালোই করলেন! তিস্তাকে সামনে রেখে আমরা ট্রানজিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অবস্থান নিতে পারলাম! অন্যদিক দিয়ে মমতা তাহলে আমাদের উপকারই করলেন! এখন দেখছি, সবই লুকোচুরি খেলা! বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়েই যাচ্ছে! কার নির্দেশে চুক্তির আগেই ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া হলো? এ বিষয়ে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। সরকারের উচিত, অবিলম্বে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া এবং সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা।
সরকারের পক্ষ থেকে তো এটাও বলা হয়েছিল, নৌ-ট্রানজিট চুক্তিতে যা-ই থাকুক না কেন, সড়ক ট্রানজিটের জন্য আলাদা চুক্তি করতে হবে এবং সেটাই সংগত। কারণ এর সঙ্গে শুধু ট্রানজিট মাসুলই নয়, শুল্ক আদায় এবং যানবাহন চলাচলসংক্রান্ত চুক্তি সইয়ের বিষয়টিও জড়িত। একটি দেশের ওপর দিয়ে আরেকটি দেশের পণ্য চলাচল করবে, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা হলে কী হবে? দীর্ঘ সড়কপথে নিরাপত্তাবিধান কিভাবে হবে? অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহন করা যাবে কি না, সীমান্তে মালামাল চেকিংয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকবে কি না_এসব বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
আমরা জানি, ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর করতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাতায়াত সুবিধা চেয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকেই। তা ছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারেরও সুবিধা চায় তারা। বাংলাদেশও ভারতের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বাড়ানো। ট্রানজিট সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব হলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই।
আমরা মনে করি, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট বিনিময় অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। বিশ্বের সব অঞ্চলেই পরস্পরের স্বার্থে এক দেশ আরেক দেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে। এক ভিসায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ ভ্রমণ করা যায়। সেখানে সীমান্ত উন্মুক্ত, অভিন্ন বাজার ও মুদ্রাব্যবস্থা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। ভিসাব্যবস্থা সহজতর করার পরিবর্তে আরো কড়াকড়ি করা হচ্ছে। সীমান্তজুড়ে নির্মিত হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। আস্থাহীনতার কারণেই ট্রানজিট আমাদের কাছে স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে উঠেছে। দেশের স্বার্থেই সরকারের উচিত জনগণকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানানো। তা না হলে বিষয়টি সরকারকে যেমন ভোগাবে, তেমনি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব বুধবার : 'দুই উপদেষ্টার জয়, বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিপর্যয়'

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.