কল্পকথার গল্প-কিছুটা রিমেক, কিছুটা রিসাইকল by আলী হাবিব

জকের দিনে রিমেক কিংবা রিসাইকল বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। কম্পিউটারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা তো ডেঙ্টপে 'রিসাইকল বিন' দেখতেই পান। কম্পিউটারের যত অপ্রয়োজনীয় ফাইল বা ফোল্ডার মুছে ফেললে বা ডিলিট করলে এখানে এসে জমা হয়। কিছুদিন আগেও দেশের গানের বাজারে রিমিক্সের নামে রিমেক গানের রমরমা ছিল। ছয় কিংবা সাতের দশকের বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবির গান হরহামেশা রিমেক হচ্ছিল। রিমিঙ্ নামে চলছিল বাজারে।


তার আগে এই গানের জগতেই এসেছিল ঝংকার নামের রিমেক। যাঁরা সিমেনার পোকা, তাঁরা তো হরহামেশাই দেখতে পাচ্ছেন রিমেক ফিল্ম। ওড়িয়া বা মালয়ালাম ভাষায় নির্মিত ছবি রিমেক হচ্ছে হিন্দিতে। হিন্দি থেকে 'কাট অ্যান্ড পেস্ট' চলে আসছে বাংলায়। তবে রিমেক আর রিসাইকল এক নয়। দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে। রিমেক হচ্ছে অবিকল নকল। সিনেমা রিমেকের একেবারে তাজা একটি খবর বলা যাক। হলিউডি ছবি 'সাউন্ড অব মিউজিক' এবার রিমেক হচ্ছে অস্ট্রিয়ায়। এই প্রথম অস্ট্রিয়ায় ঢুকছে কোনো হলিউডি ছবি। ছবিটি নির্মিত হবে জার্মান ভাষায়। এক দেশ থেকে আরেক দেশে, সংগত কারণেই কিছু দৃশ্য পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু মূল গল্পটি অবিকৃত থাকছে।
এ তো গেল ছবি কিংবা গানের রিমেক। সিনেমা কি রিসাইক্ল হতে পারে? এই যে ছয়ের দশকের কিছু সুপারহিট হিন্দি ছবির রঙিন ভার্সন আজকাল বাজারে ছাড়া হচ্ছে, এগুলো কি রিসাইকলড? হতে পারে। কারণ রিসাইকল হচ্ছে পুরনো কিংবা ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে নতুন করে কোনো কিছু তৈরি করা। নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিকসামগ্রী, ধাতব দ্রব্য, কাচের জিনিসপত্র ইত্যাদি রিসাইকল হয়। পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে বিদেশে গড়ে উঠেছে রিসাইক্ল দ্রব্যের আলাদা শিল্প। আমাদের দেশে সেটাই ভাঙ্গারি ব্যবসা। এই ব্যবসার যে ধারণা, তার মূলেও কিন্তু এই রিসাইকল তত্ত্ব।
রাজনীতিতে কি রিমেক করা সম্ভব? রাজনীতির কি রিসাইকল হতে পারে? আজকাল রাজনীতি যখন একটি লাভজনক শিল্প, তখন এমন প্রশ্ন কেউ করে বসলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর উত্তরে এককথায় বলে দেওয়া যায়, হয়তো সম্ভব। আমাদের দেশের রাজনীতি থেকেই উদাহরণ টানার চেষ্টা করা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা করেছিলাম আমরা সবাই। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবস্থাটা দাঁড়াল কী? পাকিস্তানের ভূত নতুন করে আবার চেপে বসল আমাদের রাজনীতিতে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেমন এসেছিল সামরিক শাসন, এল আমাদের রাজনীতিতেও। এটা হচ্ছে পাকিস্তানি রাজনীতির রিমেক। কিন্তু রিসাইকল? সেটাও এল। আমাদের সামনে অনেক নমস্য ব্যক্তি ছিলেন। অনুসরণযোগ্য আদর্শ রাজনীতিও ছিল আমাদের সামনে। সেই নমস্য রাজনীতিকদের কেউ কেউ প্রয়াত হতেই দেখা গেল তাঁদের অনুসারী, আদর্শের নিশানবরদার অনেকেই সামরিক শাসকদের খেদমতে নিজেদের নিবেদন করতে একটুও কুণ্ঠিত নন। এমনকি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ চেপে বসা স্বৈরশাসকের ঝাড়ুদার হওয়ার খায়েশও ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। এই রিসাইকল রাজনীতিবিদদের নিয়ে রাজনৈতিক দলও রিমেক করা হয়েছে। এভাবে রাজনীতি থেকে শুরু করে গান, গান থেকে সিনেমা যদি রিমেক হতে পারে, কাচ-কাগজ-কাপড়-সিরামিক-ধাতব পদার্থ থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক পণ্য মায় রাজনীতি যদি রিসাইকল হতে পারে, তাহলে গল্প কেন রিসাইকল হবে না। গল্পেরও তো একটা রিমেক ভার্সন তৈরি করা যেতে পারে। নিপাতনে সিদ্ধ ব্যাপার আর কি! অতএব, অগ্রসর হওয়া যাক। রিসাইকল কিংবা রিমেক করার আগে জুতসই একটা গল্প বেছে নিতে হবে, যাতে সেটা 'খাপে-খাপ' মিলে যায়।
তো আসুন, বাণিজ্য নিয়ে কথা বলা যাক। কারণ 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'। কাজেই বাণিজ্য ছাড়া আমদের চলবে না। আমরা বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করে দেখতে পারি। বাঙালি নাকি বরাবরই বাণিজ্যবিমুখ! কে বলে? হালে তো দেখছি সব কিছুর নেপথ্যে বাণিজ্য। বাণিজ্য ছাড়া একেবারেই চলছে না। এমনকি যে ঋণ, তার পেছনেও কাজ করছে কিছু না কিছু বাণিজ্য। কাজেই বাণিজ্য নিয়েই কথা হোক। এমনই এক বাণিজ্যপ্রধান গল্পের শিরোনাম 'সায়েন্টিফিক বিজিনেস'। গল্পকার আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, অঙ্েিজন ও হাইড্রোজেন একসঙ্গে মেশালে যেমন পানি হয়, তেমনি দেশসেবা ও টাকা একত্রে মেশালেই নাকি চমৎকার মুনাফায় রূপান্তর হতে পারে। বাঙালি নাকি শুধু 'ব্যবসার জন্য ব্যবসা' করে না; বাঙালি করে 'সেবার জন্য ব্যবসা', 'দেশপ্রেমের জন্য ব্যবসা'। এতে নাকি ব্যবসা যেমন হয়, তেমনি দেশসেবার পরাকাষ্ঠাও দেখানো যায়।
আবুল মনসুর আহমদের 'সায়েন্টিফিক বিজিনেস' গল্পটির রিসাইকল কিংবা রিমেক করার চেষ্টা করা যাক। ওয়ানস আপন এ টাইম বাঙালিদের ব্যাপারে ঈশ্বরের মনে কিছুটা দয়ার উদ্রেক হলো। তিনি বাঙালিকে সুমতি দিলেন। বাঙালির মনে ব্যবসা করার স্পৃহা জাগ্রত হলো। বাঙালি ব্যবসা খুঁজতে শুরু করে দিল। কী ব্যবসা করা যায়? বাঙালির ভেতর একটা স্টেজে 'মেরে দেওয়া'র প্রবণতা আছে। অল্প সময়ে বেশি লাভ করতে চায় বাঙালি। একপর্যায়ে ব্যবসাসংক্রান্ত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বাঙালি। ব্যবসার কিছু মূলনীতি রচনা করা হলো। কী ছিল তাতে? সিদ্ধান্ত হলো, কেবল ব্যবসার জন্য ব্যবসা করা হবে না। জনসেবার নামে ব্যবসা চালানো হবে। ব্যবসার ভেতর দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, দেশপ্রেম কাকে বলে! আরো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, ব্যবসা হবে বিনা মূলধনে। নো রিস্ক! ব্যবসায় কোনো ঝুঁকি থাকবে না। কারা এই ব্যবসা করবেন? যাঁরা রাজনীতিতে শীর্ষে আছেন, তাঁরা। তাঁদের দ্বারাই মূলধন ছাড়া ঝুঁকিহীন ব্যবসা করা সম্ভব। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের জন্য রাজনীতির দরজা খুলে দেওয়া হলো। এককালের ব্যবসায়ী রাতারাতি রাজনীতিক হয়ে গেলেন। অনেক রাজনীতিক এই সুযোগে ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন। কারণ এতে লোকসানের ঝুঁকি একেবারেই থাকে না। ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতির এই যে মিশেল ঈশ্বর দিয়ে দিলেন, এর সুফল পেঁৗছে গেল বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে বহির্বিশ্বেও। সেখানেও বাঙালির এই ব্যবসায়িক বুদ্ধি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলো। যে বাঙালিকে কেউ কোনো দিন কেরানির বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেনি, সেই বাঙালি রাতারাতি ব্যবসায়ী হয়ে গেল। ব্যাপারটা অনেকের কাছেই অবাক হওয়ার মতো। বাঙালিদের অনেকেই একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে গেল। অনেকের ব্যাংক ব্যালান্স ফুলে ও ফেঁপে উঠতে লাগল। হাটে-মাঠে, রাস্তাঘাটে, বাড়িতে-বাজারে, ব্যবসার বিপুল বন্যা বয়ে গেল। ফলটা কী দাঁড়াল? আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, 'বিনা-লাভে কেউ কোনো কাজ করে না। টাকা ছাড়া কেউ কোনো কথা বলে না। উজির-নাজির, পাত্র-মিত্র কেউ বিনা-ভেটে মোলাকাত দেন না। বিনা-নজরে মেম্বররা ভোটারদের সঙ্গে দেখা করেন না। বিনা-দর্শনীতে হাসপাতালে ডাক্তার রোগী ভর্তি করেন না। বিনা-তদবিরে টিকিট পাওয়া যায় না।...বখশিশের দাবি অগ্রিম স্বীকার না করলে রিকশা বা ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায় না।'
গল্পের এই অংশটুকুর রিমেক বা রিসাইকল করলে কী দাঁড়ায়? দেখুন, আজকাল শিক্ষা থেকে শুরু করে সব কিছুই চলে গেছে ব্যবসার দখলে। টাকা মেটাতে না পেরে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হয়নি, এমন উদাহরণ তো হাতের কাছেই আছে। করিডরেই মৃত্যু হয়েছে রোগীর। আগে বিল মেটাতে হবে, তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আগেকার দিনে ডাক্তাররা রোগী দেখে ওষুধ দিতেন। তারপর ভিজিট নিতেন। এখন আগে ভিজিট দিতে হয়, তারপর রোগী দেখা। সময়ের কী বৈপ্লবিক পরিবর্তন! যাকগে, মূল গল্পে ফেরা যাক। ঈদের সময় সহজে কি মেলে দূরপাল্লার বাসের টিকিট? বাদ দিন আর সব। বাড়তি বখশিশ না দিলে আজকাল যে একটি সিএনজি থ্রি হুইলার কিংবা ট্যাঙ্ িক্যাব পাওয়া যায় না, এ অভিজ্ঞতা তো সবারই আছে।
কাজেই আবার আবুল মনসুর আহমদের গল্পে ফেরা যাক। তিনি লিখছেন, 'ব্যবসা করার ফলে বাঙালি জাতির অবস্থা ভয়ানক রকমের ভালো হয়ে গেল। তাতে দেশে খোরাক-পোশাকের দাম চড়ে গেল। সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ আইন করল। বাজার থেকে চাল-কাপড় পালিয়ে গেল। চুরি রুখতে পাহারাদার বসানো হলো। বেড়ায় ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলল।' যা হোক, আবুল মনসুর আহমদ লিখছেন, 'একদিন বাঙালি জাতি একেবারে নিকেশ হয়ে গেল।' তাঁর ভাষায়, 'বাঙালির মতো একটি ঐতিহাসিক জাত এইভাবে নিপাত হলো।' 'হারাধনের ছয় পুত্র মারা যাওয়ার পর সপ্তম পুত্র ভেউ-ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বনে গিয়েছিল। কিন্তু বাঙালির জাতির জন্য কাঁদার জন্য কেউ থাকল না'_লিখছেন তিনি। তো, এরপর কী হবে? এরপর বিচার। ঈশ্বর বিচারের জন্য ডেকেছেন সবাইকে। সবার হিসাব দেওয়া হয়েছে। চিত্রগুপ্তের খেরোখাতায় সব কিছুই টোকা আছে। কিছুই বাদ পড়েনি। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কেরানি। ঈশ্বরও যেন আগে থেকেই রায় লিখে রেখেছিলেন। তিনি এসে বলে দিলেন বাঙালিরা সব নরকে যাবে। ব্যবসা করে এরা পুরো জাতিটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। একেবারে মেরে ফেলেছে। এদের জন্য কোনো করুণা নয়। সবাইকে নরকে যেতে হবে। চারদিকে হায় হায় রব। উঠে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালিকে বিশ্বসভায় পরিচিত করেছিলেন তিনি। বোধ করি সেই অধিকারেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'প্রভু, আপনি একের দোষে তো দশজনকে সাজা দিতে পারেন না। ব্যবসা করেছিল কয়েকজন লোক। আপনি ওই পাপীদের শাস্তি দিন। কেন সবাইকে এই দোষে দুষ্ট ভাবছেন।' ঈশ্বর বললেন, 'আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। তুমিই আমাকে ভাবতে বাধ্য করছো। ওই যে অন্যায় করে অন্যায় সহে ওটা তো তুমিই লিখেছো।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসে পড়লেন। নিজের কবিতার অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে গেলেন। এরপর আরো অনেক যুক্তি-তক্কো হলো। শেষমেশ ঠিক হলো বাঙালিকে নরকেই পাঠানো হবে। কিন্তু হক সাহেব নামের এক উকিল উঠে দাঁড়িয়ে এবার ঈশ্বরকেই প্যাঁচে ফেলে দিলেন। তিনি যুক্তি দিলেন, যেহেতু ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া এই ব্রহ্মাণ্ডে কিছুই ঘটে না, কাজেই বাঙালিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। ঈশ্বর কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন, বাঙালিরা স্বর্গে কেরানিগিরি করবে। কিছুদিন পর সেখানেও নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে শুরু করল। ঈশ্বরের পক্ষ থেকে জুডিশিয়াল ইনকোয়ারির ব্যবস্থা করা হলো। দেখা গেল, স্বর্গের সব অপকর্মের সঙ্গে বাঙালিরা যুক্ত। সেখানে ঘুষ চালু হয়ে গেছে। দুর্নীতি হয় প্রকাশ্য দিবালোকে।
এই গল্পের রিমেক কিংবা রিসাইকল কী হবে? আমরা অনেকটা পথ পার তো হয়ে এলাম। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির কলঙ্ক গেল না আমাদের। কখনো ডেনমার্ক, কখনো বিশ্বব্যাংক। কখনো ফেরি, কখনো ব্রিজ। একেকবার একেকজন, একেকটি আলাদা মাধ্যম। তফাত এটুকুই। কিন্তু কলঙ্ক-তিলক আছেই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.