পরিবহন সম+আচার (সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন)

যোগাযোগমন্ত্রীর রদবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চলাচলের রাস্তার কোনো রদবদল হয়নি। যাত্রীর গতিপথ এবং পথরেখাও। রাস্তা আগেরগুলোই, গাড়িও তাই_ লক্কড়ঝক্কড়! বিভিন্ন রকম পরিবহনের 'সেবা'য় প্রতিনিয়ত মানুষ অপঘাতে মৃত্যুবরণ করে। কোনো কোনো সাংবাদিকদের কল্যাণে তা সংবাদপত্রে স্থান পায়।


কিন্তু এখন গঙ্গা উল্টো বইছে, সাংবাদিকরাও সড়কপথে মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। পরিবহন ব্যবস্থা তাই নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এই 'মচ্ছব' থেকে প্যাঁচআলই বা বাদ যাবে কেন!
হ শফিক হাসান

পাবলিক পরিবহনের বৈশিষ্ট্য
যেহেতু সব মানুষ গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখে না_ প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে পাবলিক পরিবহনের ওপরই ভরসা করতে হয়। পাবলিক পরিবহনের 'সেবা' গ্রহণ করতে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করে যাত্রী। কী সেগুলো, দেখা যাক_
ষ গাড়ি কিছু দূর অগ্রসর হয়েই অঘোষিতভাবে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!
ষ অবধারিতভাবে যাত্রাপথে তেল বা গ্যাসের জন্য ফিলিং স্টেশনে গাড়ি থামবেই থামবে!
ষ কন্ডাক্টর/সুপারভাইজারের সঙ্গে একাধিক যাত্রীর কথা কাটাকাটি হবে!
ষ গাড়ি জ্যামে আটকা পড়লে চালককে কন্ডাক্টর এবং আনাড়ি ড্রাইভার হিসেবে খেতাব পেতে হবে যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে!
ষ গাড়ির গায়ে যদি 'বিরতিহীন' শব্দটা লেখা থাকে, তাহলে সেই লেখাকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রতি মিনিটেই গাড়ি বিরতি দেবে!
ষ ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীগামী দূরপাল্লার বাসগুলো অবশ্যই কুমিল্লা থামবে, খাবার বিরতিতে। কিন্তু বাসের ড্রাইভার-সুপারভাইজারকে হোটেলের বিল দিতে দেখা যাবে না!
ষ টিকিটে, কাউন্টারে এবং গাড়িতে যাত্রীসেবার চমৎকার সব বাণী উৎকীর্ণ থাকলেও সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ দেখা আশ্চর্য ঘটনা!

প্রাইভেট কার বৃদ্ধির কারণ
বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশ বলে অনেকেই। কিন্তু এই বলাটা মোটেই ঠিক নয়, এটা অবজ্ঞার শামিল। কারণ প্রতিদিনই এ দেশে প্রাইভেট কারের সংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধির হারই প্রমাণ করে বাংলাদেশ মোটেই দরিদ্র নয়। আরও কিছু কারণও রয়েছে_
ষ ঠাঁটবাট দেখানোর জন্য নিজের গাড়ির বিকল্প নেই! 'এই ড্রাইভার, গাড়ি বের করো' বলতে পারার মজাই আলাদা!
ষ আমার ড্রাইভারটা ছুটিতে গেছে_ 'সুধীসমাজে' এ ধরনের কথার জোগান দিতে! এতে আত্মপ্রসাদ লাভের পাশাপাশি সামাজিক স্ট্যাটাসও বজায় থাকে!
ষ যানজট সৃষ্টিতে নিজের ভূমিকাকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে! ভালো কিছু করতে না পারি, কিছু একটা তো ঠিকই করছি!
ষ কারও কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। কলাগাছ থেকে যাতে তালগাছে রূপান্তরিত হতে না পারে তার আগেই...!
ষ বাসাবাড়িতে গ্যারেজ আছে, আর গ্যারেজে গাড়ি না থাকা বেমানান; তাই...!
ষ 'স্বাধীনচেতা' মানুষের জন্য নিজের গাড়ি খুবই জরুরি! কারণ নিজের গাড়িতে যা ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা করা যায়!
ষ গাড়ি-বাড়ি-নারী না থাকলে নাকি যথার্থ পুরুষ হয় না! মওকা বুঝে এই কথার বাস্তব রূপ না দিয়ে কি পারা যায়!

পরিবহনের বাণীর শিক্ষা কিংবা অশিক্ষা
অলিখিত একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রতিটি গাড়িতে কোনো না কোনো বাণী লেখা থাকবেই। সেই বাণীটি হতে পারে বইয়ের কিংবা কর্তৃপক্ষ রচিত! গাড়ির গায়ে শোভা পায় হরেক রকম 'দেয়াল লিখন'। এক নজরে সেগুলো দেখা যাক, সেই সঙ্গে মন্তব্য মন্তাজ_
ষ জনাব কিছু ফেলে গেলেন কী? (মন্তব্য : কিছু ফেলে গেলে যে এরা খুঁজে বের করে দেবে সে আশা দুরাশা!)
ষ ব্যবহারে বংশের পরিচয়! (মন্তব্য : এই ফর্মুলায় প্রতি মিনিটেই এরা নিজেদের বংশ পরিচয় নিশ্চিত করে!)
ষ আগে নামতে দিন। (মন্তব্য : যাত্রী নামতে বা উঠতে দেওয়ার কে?)
ষ ১০০, ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোটের ভাঙতি নাই। (মন্তব্য : ভাঙতি করতে কি কেউ মানা করেছে?)
ষ গাড়ি চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলবেন না। (মন্তব্য : তাহলে যে আরেক দিকে লেখা রয়েছে, আপনার অভিযোগ চালককে জানান!)
ষ যাত্রাপথে অপরিচিত লোকের দেওয়া কোনো খাবার খাবেন না। (মন্তব্য : পরিচিত লোকরা কি তাহলে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করবে!)
ষ আপনার যাত্রা শুভ হোক। (মন্তব্য : এমন জঘন্য সার্ভিস দেওয়ার পরও যাত্রা শুভ হবে!)
ষ সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। (মন্তব্য : তাই বলে ২ ঘণ্টার পথ ৬ ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হবে!)
ষ আবার হবে দেখা। (মন্তব্য : আবার! কেন, একবার 'সেবা' দিয়ে মন ভরেনি!)

নতুন নামে ডাকো
দায়িত্বশীল একজন 'সরকারি মানুষের' আব্দার, খুনি ড্রাইভারদের ঘাতক বলা যাবে না! অর্থাৎ অদক্ষ, লাইসেন্সবিহীন চালকরা একের পর এক মানুষ মেরে যাবে, কিন্তু তাদের ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। তাহলে কী নামে ডাকলে তাদের প্রতি 'সুবিচার' করা হবে?
ষ শান্তিদাতা। পৃথিবী চরম অশান্তির একটা জায়গা। এই অশান্তি থেকে যিনি চিরতরে মুক্তি দেবেন তাকে অবশ্যই শান্তিদাতা নামে ডাকা যায়!
ষ রাস্তার রাজা। রাজা-বাদশাহর যুগ এখন না থাকলেও রাজাদের যে অনেক ক্ষমতা, তা কারও অবিদিত নয়। রাজারা চাইলেই পলকে যে কারও গর্দান নিতে পারতেন। সে হিসেবে ড্রাইভারদের রাস্তার রাজা নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তারাও তো খেয়াল খুশিমতো যে কোনো সময় যে কাউকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!
ষ খেয়ালি। খেয়ালি মানুষরা যখন যা করতে মন চায় তাই করে। খেয়াল খুশির বশবর্তী হয়ে তারা বিচার-বিবেচনার তোয়াক্কা করে না! বেপরোয়া ড্রাইভাররাও এক অর্থে খেয়ালি। তারা দেখতে চায়, একজন মানুষ মারলে কী হয়, কোনো গাড়িকে জোরসে ঠেলা মারলে তার অবস্থাই বা কী দাঁড়ায়!
ষ খুঁটির জোরে বলীয়ান। কোনো কোনো প্রাণী নাচে নাকি খুঁটির বলে! অর্থাৎ কারও খুঁটির জোর বেশি থাকলেই সে যেমন খুশি নাচতে পারে। তেমনি চালকরাও খুঁটির জোরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মারণযজ্ঞে। কারণ তারা জানে, যত যা কিছুই করুক না কেন, তাদের রক্ষা করতে অন্তত একজন ক্ষমতাবান মানুষ থাকবেনই থাকবেন!

পরিবহন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
সিটিং সার্ভিস মানেই যে সিট ছাড়া যাত্রী উঠবে না_ মোটেও তা নয়! সিটের মানুষ সিটেই থাকবে, অন্যরা দাঁড়িয়ে যাবে!
ষ জ্যাম খাওয়ার জিনিস হলেও ট্রাফিক জ্যাম দেখার এবং উপভোগের (!) জিনিস!
ষ 'গেট লক' লেখা সব গাড়ির গেটই থাকে না! থাকলেও তা ভাঙাচোরা, মাথা গলিয়ে সহজেই যে কেউ প্রবেশ করতে পারে!
ষ যে ধরনের গান শুনতে আপনি পছন্দ করেন, সে গান কখনোই কোনো পরিবহনে বাজবে না! বাজবে পিত্তি জ্বালানো গান!
ষ ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের কোনো কোনো কথায় কানে আঙুল চাপা দেওয়া লাগবেই! (সঙ্গে তুলা থাকলে বাঁচোয়া)!
ষ দূর কিংবা কাছের যে কোনো যাত্রাকে পরিবহন কর্তৃপক্ষ 'ভ্রমণ' হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে!
ষ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দণ্ডায়মান থাকে। তারা আইন মানা ড্রাইভার যতটা পছন্দ করে তার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করে আইন না মানা ড্রাইভারকে। কারণ এদের কাছ থেকে কিছু খসানো যায় সহজেই!
ষ পরিবহন কোনো অবস্থাতেই পরি+বহন নয়! অর্থাৎ পরিদের বহন করার জন্যই পরিবহন সৃষ্টি হয়নি!
ষ মোটরসাইকেলকে অনেকেই হোন্ডা নামে ডাকে। মোটরসাইকেল কোনো অবস্থাতেই হোন্ডা নয়। কারণ সব সাইকেলকে নিশ্চয়ই আমরা ফিনিক্স, হিরো বা অ্যাটলাস নামে ডাকি না!

যানজটের উপকারিতা
পরিবহনের অনিবার্য অনুষঙ্গ_ যানজট। কিন্তু যানজটকে অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। যানজট মোটেই নেচিবাচক তথা ক্ষতিকর কিছু নয়। এরও রয়েছে নানাবিধ উপকারী ক্ষমতা_
ষ যানজট মানুষকে ধৈর্যশীল হতে শেখায়। ১০ মিনিটের পথ যেতে ৩ ঘণ্টা লাগলেও যাত্রীরা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে জট ছাড়ার অপেক্ষায় থাকে!
ষ এটা অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মানুষ সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ জমায়। কখনও বা একজোট হয়ে ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। এতে মানুষের সাংগঠনিক দক্ষতাও বাড়ে!
ষ জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যানজটের ভালোই সম্পর্ক আছে। গাড়িতে সময় কাটাতে অনেকেই সঙ্গে করে বই বা পত্রপত্রিকা নিয়ে ওঠেন। জ্যাম যত দীর্ঘায়িত হয়, মানুষের জ্ঞানও তত বাড়তে থাকে!
ষ রাজনীতি সচেতনতা তৈরিতে যানজটের বিকল্প নেই! অলস বসে থাকতে থাকতে মানুষের মনে ভাবোদয় হয়_ অমুক সরকারের আমলে এত বেশি যানজট ছিল না, তমুক সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী দক্ষ ছিল কিংবা তমুক সরকার সবচেয়ে বেশি তেল-গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে... এসব আলোচনা-সমালোচনার ভেতর দিয়েই মানুষের সমালোচক পরিচয়ের ভিত শক্ত হয়ে ওঠে!
ষ হাঁটতে উৎসাহী করতেও যানজটের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। জরুরি কাজে সময়মতো পেঁৗছাতে হবে। এদিকে যানজটে বসে থাকলে তো কাজ হবে না_ এই ভাবনা থেকেই অনেকে হেঁটে গন্তব্য পানে রওনা দেন। এতে মানুষের বিকল্প চিন্তার উন্মেষ ঘটার পাশাপাশি স্বাস্থ্য চর্চায়ও স্থাপিত হয় উদার দিগন্ত!

No comments

Powered by Blogger.