বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল by ড.মাহবুব উল্লাহ্
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর দলটির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। কাউন্সিল অনুষ্ঠানটি সফল ও সার্থক হয়েছে বলে বিএনপির সমর্থক শুভানুধ্যায়ী থেকে এ দলের যারা বিরোধী তথা সব মহল একবাক্যে স্বীকার করেছে।
বিএনপির নেতারা এর আগে বলেছিলেন, তারা শুধু আইন রক্ষার জন্য যেনতেন কাউন্সিল অনুষ্ঠানটি করতে চাচ্ছেন না। তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করে দলকে পুনর্গঠিত ও সুসংগঠিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন তারা। সেই অঙ্গীকার রক্ষায় ১০০ ভাগ সফল না হলেও বাংলাদেশের বৃহত্ দলগুলোর রাজনৈতিক কালচারের পরিপ্রেক্ষিতে সাফল্যের পাল্লাটাই যে ভারী, এ কথা মেনে নিতে হবে। জানা গেছে, সারাদেশে ৪০ হাজার ৪৮২টি ওয়ার্ড, ৪ হাজার ৪৫৮টি ইউনিয়ন, ৩০৯টি পৌরসভা, ৪৮১টি উপজেলা এবং ৭৫টি সাংগঠনিক জেলায় ব্যাপক সাংগঠনিক তত্পরতার মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ ইউনিটে সম্মেলন ও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। সেখানে কেন্দ্র থেকে গঠিত আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা কাউন্সিলর হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তারপরও ২ হাজার ৫১২ জন কাউন্সিলর, প্রতি নির্বাচনী আসনে ৪০ জন করে সারাদেশের ১২ হাজার ডেলিগেট, সমমনা পেশাজীবী ও আমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে ২০ হাজার লোকের সঙ্গে আরও প্রায় ৩০ হাজার উত্সুক নেতাকর্মী মিলে অর্ধলক্ষাধিক লোকের বিশাল সমাবেশে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিয়েছেন। কাউন্সিলের পরিবেশ ছিল উত্সবমুখর। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর স্বপ্ন দেখার আনন্দে উদ্বেল। বাংলাদেশের ৩৮ বছরের ইতিহাসে আর কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই এমন উত্সবমুখর কাউন্সিল অধিবেশন করা সম্ভব হয়নি। এদিক থেকে বিচার করলে বিএনপির এই কাউন্সিলটি ছিল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় এক নব অধ্যায়ের সূচনা। সেনাসমর্থিত সরকারের দেয়া সব অপবাদ ঘুচিয়ে দিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রমাণ করলন, নিযুত মানুষের হৃদয়ের রানী হিসেবে তার আসন এখন পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। বাংলাদেশকে যারা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তা হিসেবে দেখতে চান তাদের কাছে এখনও বেগম খালেদা জিয়া আশা-ভরসার উত্স। তার কোনো বিকল্প এখনও সৃষ্টি হয়নি। এদেশের কোটি কোটি আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনগণ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে একথাই বিশ্বাস করতে চায়—বেগম খালেদা জিয়া যে কোনো মূল্যে দেশের সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষায় আমৃত্যু অকুতোভয় নির্ভীক ও অনড় থাকবেন। তার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘজীবনই সবার কাম্য।
৮ ডিসেম্বর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে জল্পনা-কল্পনার কমতি ছিল না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে কোথাও কোথাও পরিস্থিতি যেভাবে কলহ-কোন্দল, সংঘাত ও দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠেছিল, তাতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যারা অকল্যাণ কামনা করে তারা পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছিল। অন্যদিকে মিডিয়াতেও বিএনপির ভাবমূর্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিল, বিএনপির পক্ষে একটি সফল নির্ঝঞ্ঝাট জাতীয় কাউন্সিল উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না। নৈরাশ্যবাদীদের মুখে ছাই দিয়ে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্রমাণ করলেন তাদের মধ্যকার যে শক্তি তাদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে প্রবৃত্ত করেছিল সেই একই শক্তি আরও বহুগুণ সৃজনশীল সুন্দর কিছু উপহার দিতে সক্ষম। মানুষ ফেরেশতাও নয়, আবার ইবলিশের সন্তানও নয়। কবি যেমনি বলেছিলেন—মানুষেই বিরাজ করে সুরাসুর। এই দলের শতসহস্র কর্মী ও নেতা প্রমাণ করেছেন তারা মানুষ এবং তাদের মধ্যে অসুরের চাইতে দেবতার গুণই অধিক। তারা যদি ভবিষ্যতে তাদের মধ্যকার দেবসূচক গুণাবলীকে উত্তরোত্তর প্রস্ফুটিত করতে পারে, সৃজনশীল ক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগ করতে পারে, স্বদেশভাবনাকে সফল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে, ত্যাগের স্পৃহায় ভোগের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারে, নীতিনিষ্ঠতার দ্বারা সুবিধাবাদকে পরাস্ত করতে পারে, অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়, বিশৃঙ্খল ও উদ্ধত আচরণের পরিবর্তে সুশৃঙ্খল ও বিনয়াবনত হয়; অসততার পথ পরিত্যাগ করে সততা ও সচ্চরিত্রের গুণাবলীতে সুসজ্জিত হয়, তাহলে তারা শুধু নিজেদেরই মঙ্গল করবে না, কোটি কোটি দেশবাসীরও মঙ্গল বয়ে আনতে সক্ষম হবে। তাদের চরিত্রের এসব সত্ গুণাবলী তাদের নেতৃত্বকেও সদাসর্বদা স্খলনের পথে বিচ্যুত না হতে সচেতন ও সাবধান রাখবে। চীনা লেখক লুসুন নেপোলিয়ন সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছিলেন। নেপোলিয়ন ছিলেন ফ্রান্সের একজন দিগ্বিজয়ী বীর। একদা নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতের একটি চূড়া অতিক্রম করছিলেন। সেই সময় নেপোলিয়ন দম্ভভরে উচ্চারণ করেছিলেন—খড়ড়শ, ও ধস যরমযবত্ ঃযধহ ঃযব অষঢ়ং. দেখ আমি আল্পস পর্বতের চাইতেও উচ্চতর। একজন সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নেপোলিয়ন সেদিন যে আত্মপ্রত্যয়ী উচ্চারণ করেছিলেন সেই উচ্চারণ কখনোই সম্ভব হতো না যদি তার পেছনে একটি সাহসী এবং সুশৃঙ্খল সেনাদল না থাকত। ঠিক তেমনি দেশনেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়; যতক্ষণ পর্যন্ত তার অনুসারী বিশাল কর্মীবাহিনীর মধ্যে সাহস, বিনয়, শৃঙ্খলা ও জ্ঞানের সমাবেশ পরিপূর্ণভাবে না ঘটে। সফল কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিএনপিতে শৃঙ্খলার কালচার গড়ে ওঠার সুবাতাস বইতে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখলাম। এখন এই কালচারকে নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলেই দলের মতো দল হবে বিএনপি। বিএনপি সম্পর্কে সমালোচকদের কথা হলো—এটি একটি পাঁচমিশালী দল। এই সমালোচনায় সত্যতা নেই বলা যাবে না। কিন্তু দ্বান্দ্বিকভাবেই বিপরীত শক্তির একত্রে অবস্থান সম্ভব। ৩০ বছরের পুরনো এই দলের জন্মলগ্ন সময়কার বিচিত্র শক্তির সমাবেশ একদেহে লীন হওয়ার সময় এসে গেছে। সময় এসেছে একদেহ একপ্রাণ হয়ে কাজ করার। কিন্তু এর জন্য চাই আদর্শিক ঐক্য। আদর্শিক ঐক্য ছাড়া শুধু নেতৃত্বের আসনটি পাওয়ার জন্য ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সাময়িক সুবিধাবাদী ঐক্য কোনো কাজে আসবে না। না বিপদের সময়ে, না সম্পদের সময়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনাকে মার্কিনিরা ৯/১১-এর ঘটনা বলে চিহ্নিত করে। মার্কিনি রীতিতে মাসের সংখ্যাটি আগে ও দিনের সংখ্যাটি পরে বলা হয়। এদেশেও যারা ১১ জানুয়ারি ২০০৭ জবরদখল করে ক্ষমতার মসনদে বসেছিল তারাও মার্কিনিদের অনুকরণে তাদের ক্ষমতা দখলের দিনটিকে ১/১১ বলে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছিল। তাদের এই প্রয়াস নিছক কুম্ভিলকবৃত্তি বা নকলবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বিভীষিকার দিনটিকে মার্কিনি কায়দায় চিহ্নিত করাকে প্রত্যাখ্যান করে তার স্বাদেশিকতাকেই প্রতিষ্ঠিত করলেন। যে ছোঁয়াচে রোগ বুদ্ধিবৃত্তির ফেরিওয়ালাদের পেয়ে বসেছিল বেগম জিয়ার এই প্রত্যাখ্যান তাদের জন্য একটি দারুণ চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়।
অনেকেই বলেছেন, সফল কাউন্সিল অধিবেশন করে বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দলটিকে পছন্দ করেন তারা এই উক্তিতে সুখী হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে দেখি। ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ তখনই আসে, যখন পশ্চাত্পসরণের ঘটনা ঘটে। বিএনপির ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটেনি। অত্যাচার-নির্যাতনে বিএনপির রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু বিএনপি পশ্চাত্পসরণ করেনি। তাদের কেউ বলেনি সেনা সরকারের সব কাজকে বৈধতা দেয়া হবে। তারা লগি-বৈঠার তাণ্ডব ঘটিয়ে সেনা সরকারের আগমনকে পথ করে দেয়নি। তারা আপসের চোরাবালিতেও নিমজ্জিত হয়নি। তারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচল ছিল। তারা প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ করেছে। কারণ তারা জানত অন্ধকারের অমানিশা একদিন কেটে যাবেই যাবে। ৮ ডিসেম্বর সফল কাউন্সিল করে বিএনপি নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে টিকে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব উপস্থিতি ও পরিচয় হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশে প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছে মাত্র। ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মুসলিম লীগ এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু বিএনপি তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক আদর্শ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের ৩৮ বছর পরও বাংলাদেশ তার স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে বাংলাদেশী জাতির আত্মরক্ষার একমাত্র বর্ম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ আদর্শকে বিএনপি যতদিন প্রাণপণে ধারণ করবে, ততদিন এই দলটির অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মতাদর্শিক প্রশ্নে আপস ও ছাড় দেয়ার পিচ্ছিল পথে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে দলটির আবেদন ফুরিয়ে যাবে। তাই প্রতি দণ্ডে, প্রতি পলে স্মরণ রাখতে হবে, সেরকম কোনো বিচ্যুতি যেন মুহূর্তের জন্যও দলটিকে আচ্ছন্ন করতে না পারে। আদর্শগত বিচ্যুতি হবে আত্মহত্যার শামিল। আজ বিএনপির সফল কাউন্সিল দেখে এবং এর কর্মীদের প্রাণবন্যা লক্ষ্য করে প্রতিবেশী দেশ থেকে কিংবা অন্য কোনো পরাশক্তির তরফ থেকে ছেলে ভুলানো ছড়াগান শোনানো হতে পারে। কিন্তু এই ছেলে ভুলানো ছড়ায় ক্ষণকালের জন্যও আকৃষ্ট কিংবা বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। কারণ, শত্রুদের মিষ্টি কথা শ্রুতিমধুর হলেও শেষ বিচারে বিষময় ফল বয়ে নিয়ে আসে। কাজেই যে দেশপ্রেমিকতা বিএনপিকে বারবার জনগণের আস্থার চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই দেশপ্রেমিকতা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হওয়া চলবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু বিচ্যুতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন সর্বাত্মক সফলরূপে তখনই লোকদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হবে যখন মানুষ দেখবে বিএনপি তার নির্ধারিত রাজনৈতিক ও আদর্শিক কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে দৃঢ়চিত্ত। কাউন্সিল অনুষ্ঠান, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ও বন্ধুর পথে যাত্রার সূচনা মাত্র। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দলটিকে মনে রাখতে হবে দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুশিয়ার। বেগম খালেদা জিয়া কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সংগ্রাম আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, জাতিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র বিনাশী অপশক্তির বিরুদ্ধে। বড় কঠিন এই সংগ্রাম। আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ এখানে নেই। দেশকে ভালোবাসলে সব ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলেছেন, এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে তারা একটি নতুন বিএনপি চেয়েছিলেন। তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি বলে তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কি পুরনো হয়ে গেছে, যে তাকে নতুন কিছু হতে হবে? আসলে নতুন কিছু হতে গেলে বিএনপি আর বিএনপি থাকবে না। বিএনপি সেভাবেই থাকুক, যা নতুনত্ব অর্জনের নামে পথবিচ্যুত হয় না, আবার পুরনো হয়ে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে না। চির নতুনের মতো বিএনপি স্বদেশের জন্য কাজ করে যাবে এটাই সময়ের প্রত্যাশা। বয়স বাড়লেও বিএনপি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয় না, এটাই হোক সবার কামনা।
সংবাদপত্রের পাতায় এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তো বিএনপির নেতৃত্বের যেসব পদ এ মুহূর্ত পর্যন্ত পূরণ করা হয়নি সেই পদগুলো পূরণ হয়ে যেতে পারে। তবুও আশা করব সাহসী, সত্, ত্যাগী, বিনয়ী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরাই এসব পদ পূরণ করবেন।
লেখক : অধ্যাপক, ডেপেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৮ ডিসেম্বর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে জল্পনা-কল্পনার কমতি ছিল না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে কোথাও কোথাও পরিস্থিতি যেভাবে কলহ-কোন্দল, সংঘাত ও দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠেছিল, তাতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যারা অকল্যাণ কামনা করে তারা পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছিল। অন্যদিকে মিডিয়াতেও বিএনপির ভাবমূর্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিল, বিএনপির পক্ষে একটি সফল নির্ঝঞ্ঝাট জাতীয় কাউন্সিল উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না। নৈরাশ্যবাদীদের মুখে ছাই দিয়ে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্রমাণ করলেন তাদের মধ্যকার যে শক্তি তাদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে প্রবৃত্ত করেছিল সেই একই শক্তি আরও বহুগুণ সৃজনশীল সুন্দর কিছু উপহার দিতে সক্ষম। মানুষ ফেরেশতাও নয়, আবার ইবলিশের সন্তানও নয়। কবি যেমনি বলেছিলেন—মানুষেই বিরাজ করে সুরাসুর। এই দলের শতসহস্র কর্মী ও নেতা প্রমাণ করেছেন তারা মানুষ এবং তাদের মধ্যে অসুরের চাইতে দেবতার গুণই অধিক। তারা যদি ভবিষ্যতে তাদের মধ্যকার দেবসূচক গুণাবলীকে উত্তরোত্তর প্রস্ফুটিত করতে পারে, সৃজনশীল ক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগ করতে পারে, স্বদেশভাবনাকে সফল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে, ত্যাগের স্পৃহায় ভোগের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারে, নীতিনিষ্ঠতার দ্বারা সুবিধাবাদকে পরাস্ত করতে পারে, অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়, বিশৃঙ্খল ও উদ্ধত আচরণের পরিবর্তে সুশৃঙ্খল ও বিনয়াবনত হয়; অসততার পথ পরিত্যাগ করে সততা ও সচ্চরিত্রের গুণাবলীতে সুসজ্জিত হয়, তাহলে তারা শুধু নিজেদেরই মঙ্গল করবে না, কোটি কোটি দেশবাসীরও মঙ্গল বয়ে আনতে সক্ষম হবে। তাদের চরিত্রের এসব সত্ গুণাবলী তাদের নেতৃত্বকেও সদাসর্বদা স্খলনের পথে বিচ্যুত না হতে সচেতন ও সাবধান রাখবে। চীনা লেখক লুসুন নেপোলিয়ন সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছিলেন। নেপোলিয়ন ছিলেন ফ্রান্সের একজন দিগ্বিজয়ী বীর। একদা নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বতের একটি চূড়া অতিক্রম করছিলেন। সেই সময় নেপোলিয়ন দম্ভভরে উচ্চারণ করেছিলেন—খড়ড়শ, ও ধস যরমযবত্ ঃযধহ ঃযব অষঢ়ং. দেখ আমি আল্পস পর্বতের চাইতেও উচ্চতর। একজন সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নেপোলিয়ন সেদিন যে আত্মপ্রত্যয়ী উচ্চারণ করেছিলেন সেই উচ্চারণ কখনোই সম্ভব হতো না যদি তার পেছনে একটি সাহসী এবং সুশৃঙ্খল সেনাদল না থাকত। ঠিক তেমনি দেশনেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়; যতক্ষণ পর্যন্ত তার অনুসারী বিশাল কর্মীবাহিনীর মধ্যে সাহস, বিনয়, শৃঙ্খলা ও জ্ঞানের সমাবেশ পরিপূর্ণভাবে না ঘটে। সফল কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিএনপিতে শৃঙ্খলার কালচার গড়ে ওঠার সুবাতাস বইতে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখলাম। এখন এই কালচারকে নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলেই দলের মতো দল হবে বিএনপি। বিএনপি সম্পর্কে সমালোচকদের কথা হলো—এটি একটি পাঁচমিশালী দল। এই সমালোচনায় সত্যতা নেই বলা যাবে না। কিন্তু দ্বান্দ্বিকভাবেই বিপরীত শক্তির একত্রে অবস্থান সম্ভব। ৩০ বছরের পুরনো এই দলের জন্মলগ্ন সময়কার বিচিত্র শক্তির সমাবেশ একদেহে লীন হওয়ার সময় এসে গেছে। সময় এসেছে একদেহ একপ্রাণ হয়ে কাজ করার। কিন্তু এর জন্য চাই আদর্শিক ঐক্য। আদর্শিক ঐক্য ছাড়া শুধু নেতৃত্বের আসনটি পাওয়ার জন্য ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সাময়িক সুবিধাবাদী ঐক্য কোনো কাজে আসবে না। না বিপদের সময়ে, না সম্পদের সময়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনাকে মার্কিনিরা ৯/১১-এর ঘটনা বলে চিহ্নিত করে। মার্কিনি রীতিতে মাসের সংখ্যাটি আগে ও দিনের সংখ্যাটি পরে বলা হয়। এদেশেও যারা ১১ জানুয়ারি ২০০৭ জবরদখল করে ক্ষমতার মসনদে বসেছিল তারাও মার্কিনিদের অনুকরণে তাদের ক্ষমতা দখলের দিনটিকে ১/১১ বলে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছিল। তাদের এই প্রয়াস নিছক কুম্ভিলকবৃত্তি বা নকলবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বিভীষিকার দিনটিকে মার্কিনি কায়দায় চিহ্নিত করাকে প্রত্যাখ্যান করে তার স্বাদেশিকতাকেই প্রতিষ্ঠিত করলেন। যে ছোঁয়াচে রোগ বুদ্ধিবৃত্তির ফেরিওয়ালাদের পেয়ে বসেছিল বেগম জিয়ার এই প্রত্যাখ্যান তাদের জন্য একটি দারুণ চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছু নয়।
অনেকেই বলেছেন, সফল কাউন্সিল অধিবেশন করে বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দলটিকে পছন্দ করেন তারা এই উক্তিতে সুখী হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে দেখি। ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ তখনই আসে, যখন পশ্চাত্পসরণের ঘটনা ঘটে। বিএনপির ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটেনি। অত্যাচার-নির্যাতনে বিএনপির রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু বিএনপি পশ্চাত্পসরণ করেনি। তাদের কেউ বলেনি সেনা সরকারের সব কাজকে বৈধতা দেয়া হবে। তারা লগি-বৈঠার তাণ্ডব ঘটিয়ে সেনা সরকারের আগমনকে পথ করে দেয়নি। তারা আপসের চোরাবালিতেও নিমজ্জিত হয়নি। তারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচল ছিল। তারা প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ করেছে। কারণ তারা জানত অন্ধকারের অমানিশা একদিন কেটে যাবেই যাবে। ৮ ডিসেম্বর সফল কাউন্সিল করে বিএনপি নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে টিকে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব উপস্থিতি ও পরিচয় হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশে প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছে মাত্র। ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মুসলিম লীগ এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু বিএনপি তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক আদর্শ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের ৩৮ বছর পরও বাংলাদেশ তার স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে বাংলাদেশী জাতির আত্মরক্ষার একমাত্র বর্ম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ আদর্শকে বিএনপি যতদিন প্রাণপণে ধারণ করবে, ততদিন এই দলটির অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মতাদর্শিক প্রশ্নে আপস ও ছাড় দেয়ার পিচ্ছিল পথে অগ্রসর হলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে দলটির আবেদন ফুরিয়ে যাবে। তাই প্রতি দণ্ডে, প্রতি পলে স্মরণ রাখতে হবে, সেরকম কোনো বিচ্যুতি যেন মুহূর্তের জন্যও দলটিকে আচ্ছন্ন করতে না পারে। আদর্শগত বিচ্যুতি হবে আত্মহত্যার শামিল। আজ বিএনপির সফল কাউন্সিল দেখে এবং এর কর্মীদের প্রাণবন্যা লক্ষ্য করে প্রতিবেশী দেশ থেকে কিংবা অন্য কোনো পরাশক্তির তরফ থেকে ছেলে ভুলানো ছড়াগান শোনানো হতে পারে। কিন্তু এই ছেলে ভুলানো ছড়ায় ক্ষণকালের জন্যও আকৃষ্ট কিংবা বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। কারণ, শত্রুদের মিষ্টি কথা শ্রুতিমধুর হলেও শেষ বিচারে বিষময় ফল বয়ে নিয়ে আসে। কাজেই যে দেশপ্রেমিকতা বিএনপিকে বারবার জনগণের আস্থার চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই দেশপ্রেমিকতা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হওয়া চলবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু বিচ্যুতি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন সর্বাত্মক সফলরূপে তখনই লোকদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হবে যখন মানুষ দেখবে বিএনপি তার নির্ধারিত রাজনৈতিক ও আদর্শিক কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে দৃঢ়চিত্ত। কাউন্সিল অনুষ্ঠান, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ও বন্ধুর পথে যাত্রার সূচনা মাত্র। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দলটিকে মনে রাখতে হবে দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুশিয়ার। বেগম খালেদা জিয়া কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সংগ্রাম আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, জাতিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র বিনাশী অপশক্তির বিরুদ্ধে। বড় কঠিন এই সংগ্রাম। আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ এখানে নেই। দেশকে ভালোবাসলে সব ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলেছেন, এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে তারা একটি নতুন বিএনপি চেয়েছিলেন। তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি বলে তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। প্রশ্ন হলো বিএনপি কি পুরনো হয়ে গেছে, যে তাকে নতুন কিছু হতে হবে? আসলে নতুন কিছু হতে গেলে বিএনপি আর বিএনপি থাকবে না। বিএনপি সেভাবেই থাকুক, যা নতুনত্ব অর্জনের নামে পথবিচ্যুত হয় না, আবার পুরনো হয়ে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে না। চির নতুনের মতো বিএনপি স্বদেশের জন্য কাজ করে যাবে এটাই সময়ের প্রত্যাশা। বয়স বাড়লেও বিএনপি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয় না, এটাই হোক সবার কামনা।
সংবাদপত্রের পাতায় এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তো বিএনপির নেতৃত্বের যেসব পদ এ মুহূর্ত পর্যন্ত পূরণ করা হয়নি সেই পদগুলো পূরণ হয়ে যেতে পারে। তবুও আশা করব সাহসী, সত্, ত্যাগী, বিনয়ী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরাই এসব পদ পূরণ করবেন।
লেখক : অধ্যাপক, ডেপেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments