তাহরির থেকে জুকোটি পার্ক-প্রতিবাদের বিশ্বায়ন by সুভাষ সাহা

রাজনৈতিক সমালোচনা ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও 'ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন' ইতিমধ্যে এক মাস অতিক্রম করেছে। এখন এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে ইউরোপ এমনকি এশিয়ায়ও বিস্তার লাভ করছে। আন্দোলনকারীদের নেতা নেই, সংগঠন নেই, করপোরেট লোভের বিরুদ্ধে শানিত স্লোগান ছাড়া সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা নিদেনপক্ষে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার দাবিও নেই।


তাই প্রথম দিকে মার্কিন প্রশাসন বা ইউরোপীয় দেশগুলোর কর্তাব্যক্তিরা এ নিয়ে তেমন গা করেননি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর যখন 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' ব্যানার নিয়ে এর সনি্নহিত জুকোটি পার্কে স্লিপিং ব্যাগ আর তাঁবু নিয়ে স্বল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণী বসে পড়েছিলেন, তখন কেউ কেউ এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন। এর কিছুদিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর্থিক সংকটজাত হতাশা থেকে এই প্রতিবাদ উদ্ভূত বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এখন আন্দোলন ছড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখে ওবামাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়কদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। নেতৃত্ব ছাড়া, সংগঠন ছাড়া জনতার আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে কী করে তা তাদের বোধেরও অতীত ছিল।
মানুষের মনে এত ক্ষোভ জমা হলো কী করে আর ক্ষোভ যদি থেকেই থাকে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ভোটের মাধ্যমে গণেশ উল্টে দিলেই হলো। কিন্তু তারা সে পথে না গিয়ে রাস্তার আন্দোলনকেই সার করল কেন? আন্দোলনকারী জনতার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া এবং তাদের ক্রোধ দেখে মনে হয় পশ্চিমা দুনিয়া, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বিদ্যমান দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় মোটেই সন্তুষ্ট নয়। সরকার পাল্টালে তাদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে উন্নতি হবে বা সম্পদ বৈষম্যের অবসান ঘটবে তারা তা মনে করেন না। মানুষ মনে করে থাকতে পারে যে, রিপাবলিকান হোক আর ডেমোক্র্যাট হোক, তারা সবাই করপোরেট হাউসগুলোর ক্রীড়নকবিশেষ। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও করপোরেট হাউসগুলোরই স্বার্থানুকূল। বিচার ব্যবস্থার প্রতিও মানুষের ভরসা কমে গিয়ে থাকবে। করপোরেট হাউসগুলোর অর্থ, বিচার ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে_ এই ধারণা যদি মার্কিন নাগরিকরা বিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যাবে কি? নির্বাচনে আর্থিক দান গ্রহণে বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে বিচার বিভাগ মূলত মার্কিন রাজনীতিকে পুরোপুরি কলুষিত করার ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করেছে। সুতরাং লিবারেল অর্থনীতির সংকট প্রকটভাবে লিবারেল রাজনীতি অর্থাৎ বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন সে সাক্ষ্যই দেয়।
আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্য, 'দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে যাবতীয় সম্পদ। করপোরেটরা দেশটাকে লুটে খাচ্ছে।' অর্থাৎ করপোরেট সীমাহীন লোভ ও বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের যত ক্ষোভ আর ক্ষোভ বাড়বেই না কেন? অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সংশোধন করার যে সুযোগ সৃষ্টি করেছিল ওবামা প্রশাসন লক্ষণীয় কিছুই করেনি। গত জুলাই মাসে ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, ১৯৮৩ সাল থেকে দেশে অর্জিত সম্পদের অধিকাংশই গেছে ৫ শতাংশের পকেটে। এই একই সময়ে নিম্নস্তর থেকে মধ্যস্তর পর্যন্ত দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে। চোখ কপালে তোলার মতো আর একটি সংবাদ দিয়েছে 'ফরবিস'। তারা এ বছরের জুলাইয়ে ঘোষণা করেছে, ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকট শুরুর আগ থেকে এখন ধনীরা আরও বেশি ধনী হয়েছে। এসব তথ্য দেশের বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনকারীদের চোখ খুলে দিয়ে থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র যতই তার বর্ণবৈষম্যমূলক সমাজের কদর্য চিত্রটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, এবারের সংকটে তা বেআব্রু হয়ে পড়েছে। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধকির জন্য ঘরবাড়ি খুইয়েছেন যারা তাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো মানুষের হারটা ৭০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অনেক বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনোরা তাদের ঘর খুইয়েছেন। তদুপরি ২০০৯ সালের সেন্সাস রিপোর্টেও দেখা গেছে, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনোদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গদের সম্পদ ২০ গুণ বেশি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডাররা বিশেষত রাজনীতিবিদরা এই সম্পদ বৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যজাত আর্থিক প্রবঞ্চনার বিহিত করার চেষ্টাই করেননি। 'ওয়ালস্ট্রিট অকুপাই মুভমেন্ট' তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলোর বিরুদ্ধেই।
সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীরা অবশ্য এটা পুঁজিবাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সংকট বলে গোটা ব্যবস্থাটাই অসার প্রতিপন্ন করতে চাইবেন। তবে এটাও ঠিক, মার্কিন লিবারেল পুঁজিবাদ ধনশালীদের আরও ধনশালী হওয়ার পথ করে দিয়েছে। লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে চলার পথে বাধাগুলোকে একে একে উপড়ে ফেলেছে। এক ধরনের উলঙ্গ শোষণের ব্যবস্থা কায়েম করে এই মুক্তবাজার অর্থনীতি। তার ফলে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদবৈষম্য সীমা ছাড়িয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের নানা ধরনের অভিজ্ঞতাও জড়ো হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার আন্দোলনকারীরা এই দুরবস্থার জন্য ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানোকেও কিয়দংশে দায়ী করছে। এই যুদ্ধের ব্যয় মেটানোর জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ তো মার্কিন নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সালব্ধ। আর এই ট্যাক্সটাও বেশি পরিমাণে চাপানো হয় নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তদের ওপর। বড় লোকেরা তো এখনও বুশের করে যাওয়া ট্যাক্স হলিডের ছাতার তলে বেশ আরামেই আছেন। অথচ আমাদের মতো গরিব দেশেও করপোরেট ট্যাক্সের হার বেশি। এভাবেই গত তিন যুগে অর্থাৎ রিগ্যানোমিক্সের সময় থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শ্রেণীবৈষম্য লাগামছাড়াভাবে বেড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি তাকে মদদ জুগিয়েছে। এ কারণেই বিদ্যমান রাজনীতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিরাট একটি অংশের আস্থাহীনতা প্রকট। উন্নত দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়ক ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর উচিত নয় কি এই সংকট থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার।
লিবারেল পুঁজিবাদকেও এবার পরীক্ষা দিতে হবে। এই পুঁজিবাদ সামাজিক অগ্রগতি ঘটায় বলে এর আবশ্যকতার যে তত্ত্ব এ যাবৎকাল দিয়ে আসা হচ্ছিল, তা বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্জিত হচ্ছে কি-না, নাকি সামাজিক অসাম্যকে মাত্রাছাড়া করে তা বিরাট সামাজিক আলোড়নের জন্ম দেয় এবং নিজের সংশোধনকে অনিবার্য করে তোলে তা দেখার বিষয়।
তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের সময় ওই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কি-না সে ব্যাপারে প্রশ্ন রেখেছিলাম। সে সময় অনেকের কাছে মনে হয়েছে, তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন যেহেতু গণতান্ত্রিক নূ্যনতম অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত, তাই এ আন্দোলন উন্নত দুনিয়ার আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে পারবে কীভাবে? আসলে টুইটার, ফেসবুক তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার এবং সারাবিশ্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি একজন সাধারণ মানুষের করায়ত্ত হওয়ার ফলে তাহরির স্কয়ারে আন্দোলকারীদের টুইটার ও ফেসবুকের মাধ্যমে অসংগঠিত অবস্থা থেকে সংগঠিত আন্দোলনের জন্ম দেওয়া অভিজ্ঞতা আধুনিক বিশ্বের মানুষও গ্রহণ করেছে। সে সময় তাহরির স্কয়ার আন্দোলনকারী তরুণ শক্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ওবামা মার্কিন তরুণ শক্তিকেও নতুন প্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তখন কি তিনি জানতেন, তার দেশের যুবশক্তি তাহরির স্কয়ারের উন্মাদনা নিয়ে তার দেশের করপোরেট লালসার বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়াবে এবং জনতার সম্মিলিত জোয়ার সৃষ্টি করবে!
ওয়ালস্ট্রিট যেহেতু মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র, তাই প্রতীকী অর্থে এই ওয়ালস্ট্রিট অকুপাই বা দখল করার আন্দোলন। তবে আন্দোলন সর্বাংশেই জনতার। এর বিশেষ কোনো নেতৃত্ব নেই। অনেকে এই আন্দোলনকে উদ্দেশ্যহীন বলছেন। আসলে কি তাই? উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে আর সেটি হলো, মার্কিন সমাজ যে বৈষম্যমূলক, মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে এই বৈষম্য লালন করে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে মানুষের বোধের মধ্যে নিয়ে আসা। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনকারীরা সফল বলতে হবে। এরপর কী হবে সম্ভবত আন্দোলনকারী বা প্রশাসন কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.