একই বৃত্তে বন্দি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম by জাফর আহমদ

ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুণগত পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিলেও বর্তমান সরকার তা বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। পুরনো চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন। গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি উন্নয়ন কাজে।


গত তিন অর্থবছরের তুলনামূলক বিশ্লেষণে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত আশানুরূপ অর্থ ব্যয় করতে পারে না। শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে ব্যয়ের হিড়িক পড়ে। এরপরও শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হয় না। বছর শেষে সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-এর ঘরে পেঁৗছে। সরকারি অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও প্রকল্পের গুণগতমান বজায় রাখার ওপর জোর দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত দুই অর্থবছরে ঘুরে-ফিরে শতকরা ৯০ ভাগের ঘরে ছিল এডিপি বাস্তবায়ন। শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।
২০০৯-১০ অর্থবছর ৮৮৬ প্রকল্পের বিপরীতে ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অর্থবছরের ছয় মাস পার হওয়ার পর শতভাগ ব্যয় সম্ভব হবে না জেনে অর্থ ফেরতের প্রস্তাব দেয় মন্ত্রণালয়গুলো। ফেব্রুয়ারিতে এডিপি সংশোধন করে ২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়। সংশোধিত এডিপির আকার কমে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু এডিপির আকার কমলেও ২১৪টি প্রকল্প বাড়ানো হয়। অর্থবছর শেষে আইএমইডি থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংশোধিত এডিপিতে যে অর্থ বরাদ্দ ছিল তাও খরচ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়গুলো। ওই অর্থবছর সংশোধিত এডিপির ৯১ শতাংশ বাস্তাবয়ন করা সম্ভব হয়েছিল। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ১৬ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা খরচ হলেও বৈদেশিক ঋণের অর্থ খরচ হয় মাত্র ৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অব্যয়িত অর্থ থেকে যায় ২ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরে এডিপি ৯১৬ প্রকল্পের বিপরীতে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। তা ২০০৯-১০ অর্থবছরের মূল এডিপির চেয়ে আট হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ২৩ হাজার ৫০০ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য বাবদ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থবছরের অর্ধেক সময় পার হওয়ার পর আবার পুরনো অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি_ অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব। সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ানো হলেও কমানো হয় অর্থের পরিমাণ। সংশোধিত এডিপিতে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা কমানো হয়। সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ২৩ হাজার ৯৫০ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য বাবদ ১১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আইএমইডি প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থবছর শেষে এডিপিতে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। তা সংশোধিত এডিপির ৯২ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য ৯ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে অব্যয়িত অর্থ থেকে যায় ৩ হাজার ৫০ কোটি টাকা। শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে আইএমইডি কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করে। এগুলো হচ্ছে প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলি, প্রকল্প প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত বিভিন্ন দফতরের পরিকল্পনা কাঠামোর অভাব ও দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা। এ ছাড়া রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ লোক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অভাব, লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত না করা, সময়মতো উন্নয়ন সহযোগীর অর্থ ছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব, প্রকল্প নির্বাচন ও প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রকল্প পরিচালক সম্পৃক্ত না থাকা।
প্রকল্পের বিলম্ব পরিহার করতে কয়েকটি সুপারিশ করেছে আইএমইডি। সুপারিশগুলো হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া, উপযুক্ত পিডি নির্বাচন ও নিয়োগ দেওয়া, প্রকল্প প্রণয়নের সময় থেকেই পরিচালককে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত রাখা, প্রকল্প সমাপ্তির আগ পর্যন্ত কোনো পিডিকে পরিবর্তন না করা, উপযুক্ত বা আগ্রহী নয় এমন কাউকে পিডি হিসেবে নির্বাচিত না করা, যথাসম্ভব পূর্ণকালীন দায়িত্বে পিডি নিয়োগ দেওয়া, গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার পর অন্য প্রকল্প গ্রহণ করা, প্রকল্প দলিল অনুযায়ী বছরভিত্তিক নির্দেশিত বরাদ্দ ছক অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেওয়া এবং বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও সংস্থা পর্যায়ের পরিকল্পনা উইংগুলোকে শক্তিশালী করা। গত দুই অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সরকারি অর্থ খরচ করতে সক্ষম হলেও বৈদেশিক ঋণের অর্থ আশানুরূপ খরচ করতে পারছে না। ফলে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ফেরত চলে যায়।
প্রতিশ্রুত বৈদেশিক অর্থ ছাড় না হওয়ার বিষয়ে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী পরস্পরকে দোষারোপ করছে। সরকার বলছে, উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্প অনুমোদন করতে বিলম্ব করে। দরপত্র অনুমোদনেও উন্নয়ন সহযোগীরা দেরি করে। এতে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব ক্ষমতা উন্নয়ন সহযোগীর সদর দফতরে কুক্ষিগত থাকে। এতে সংস্থাগুলোর স্থানীয় কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের প্রকল্প অনুমোদন এবং কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সদর দফতরে যেতে হয়। ফলে অনেক সময় অপচয় হয়। সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুত অর্থ আশানুরূপ ছাড় না হওয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও দাতাগোষ্ঠীর মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব অভিযোগ ওঠে আসে। পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় না করায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের স্থানীয় কার্যালয়ে ক্ষমতা কম থাকে। প্রকল্প ও দরপত্র অনুমোদন এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সংস্থাগুলোকে সদর দফতরে যেতে হয়। তিনি এ ছোটখাটো বিষয় স্থানীয় কার্যালয়েই সমাধান করতে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিনিধিদের পরামর্শ দেন।
এদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের সংস্থাগুলো কর্তৃক প্রণীত প্রকল্প তৈরিতে জটিলতা থাকে। ঘন ঘন পিডি বদলি, ভূমি অধিগ্রহণ ও জনবল নিয়োগে সমস্যা থাকে। কেনাকাটায় বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সঠিক নীতিমালা অনুসরণ করে না। এ ছাড়া বৈদেশিক অর্থ খরচে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত প্রকল্প পরিচালক পাওয়া যায় না। এসব কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করে না। ভূমি অধিগ্রহণ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পিডি নিয়োগ, জনবল নিয়োগ, পিপিআর নীতিমালা অনুযায়ী কেনাকাটা করতে উন্নয়ন সহযোগীর বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা সরকারকে পরামর্শ দেন। এসব বিষয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বাস্তবায়ন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এক হাজার ৩৯টি প্রকল্পের বিপরীতে ৪৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ২৭ হাজার ৩১৫ কোটি এবং প্রকল্প সাহায্য বাবদ ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ১০ নির্দেশনা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বছরের শুরুতেই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এসব নির্দেশনা দেন। এ সময় তিনি এডিপিতে বরাদ্দ করা অর্থ খরচের পাশাপাশি কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরের ৬ মাস পার হওয়ার পর ওই একই চিত্র। মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো খরচ না করার আশঙ্কায় অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো শুরু করেছে। কমিশন এবং ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এবারের সংশোধিত এডিপির আকার ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ এবারের এডিপিতে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমানো হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.