বিশেষ সাক্ষাৎকার : রাশেদ খান মেনন-গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি জাতীয় স্বার্থবিরোধী-সমকালীন রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন by মোস্তফা হোসেইন

কালের কণ্ঠ : সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। আগের মতোই বিরোধী দল সংসদের বাইরে। কিভাবে দেখছেন বিষয়টিকে? রাশেদ খান মেনন : বিএনপি কোন কারণে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছে না, তারাই জানে। কোনো যুক্তি নেই সংসদে যোগ না দেওয়ার। তারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন তৈরি করতে চাইছে। এটা করার অধিকার তাদের আছে। অনুমান করছি, তাদের সেই চেষ্টার একটি অংশ হিসেবেই আসলে তারা সংসদে যোগ দিচ্ছে না।


সেদিক বিবেচনা করলে বলতে হবে, আসলে তারা আন্দোলনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা কিন্তু নিচ্ছেন। শুধু সংসদের মূল অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না। এতে করে সংসদীয় কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : মহাজোট সরকারের মেয়াদের অর্ধেকেরও বেশি সময় চলে গেছে। এই সময়ে সরকারের ব্যর্থতা এবং সাফল্য সম্পর্কে বলবেন কি?
রাশেদ খান মেনন : সাফল্য আছে উল্লেখ করার মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা খুবই জরুরি ছিল। মহাজোটের দলগুলোর দাবি ছিল এটি। দেশে যেভাবে জঙ্গিবাদের শক্তিশালী আস্তানা তৈরি হয়েছিল, সেই আস্তানাগুলো কিন্তু নেই। অনেকটা কোণঠাসা হয়ে গেছে ওরা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে বাংলাদেশে। আবার দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। সেই মামলার বিষয় প্রক্রিয়াও তো শুরু হয়েছে। আমাদের দেশকে একসময় আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের মদদদানকারী বলে জানত। এখন কি সে পরিস্থিতি আছে বাংলাদেশে? আবার আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক সাফল্যকেও মূল্যায়ন করতে পারেন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, এখন তা আগের চেয়ে আরো গভীর হয়েছে। দেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি ভালো। অর্থনীতিতে সাফল্য এসেছে এটা স্বীকার করতে হবে। রপ্তানি বেড়েছে বাংলাদেশের। কৃষিতে সাফল্য দেখার মতো। উৎপাদন বেড়েছে অনেক। তবে একসময় সারের দাম অনেক কমানো হলেও পরে আবার সারের দাম কিছু বেড়েছে। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই সরকার একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি উপহার দিতে পেরেছে। এখন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পেঁৗছে যায়। বছরের শুরুতে আগের মতো বইয়ের অভাবে ক্লাস বন্ধ থাকে না। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে। সেটা আর্থিক সংকট। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ কমেছে। টাইম স্কেল কমেছে, এমপিওভুক্তি কমেছে।
কালের কণ্ঠ : দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে কী বলবেন? নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব হয়েছে?
রাশেদ খান মেনন : আন্তর্জাতিক প্রভাবের বাইরে আমাদের বাজার নয়। আন্তর্জাতিক প্রভাবে এখানেও দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। সরকার দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে টিসিবিকে কার্যকর করতে পারলে সুবিধা হতো। সেটাও সম্ভব হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড?
রাশেদ খান মেনন : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সরকারের বিশাল সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজার নিয়ে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে_এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
রাশেদ খান মেনন : শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা ও পরিবেশ অনুকূলে রাখা খুবই প্রয়োজন। এটা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জও বটে। অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে পুঁজিবাজারে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এটাকে সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা বলতে দ্বিধা নেই।
কালের কণ্ঠ : ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক দল একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রাশেদ খান মেনন : বিনিয়োগকারীদের পাশে যেকোনো রাজনৈতিক দল যেতেই পারে। সেখানে কমবেশি কোটি মানুষ জড়িত। সংগত কারণেই কোটি লোককে নিজের করে পেতে চাইতে পারে যেকোনো রাজনৈতিক দল। কোটি ভোটারকে পক্ষে আনার চেষ্টা করে থাকলে এটা দোষের কি হতে পারে!
কালের কণ্ঠ : অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের সমস্যা সমাধানের পথ জানা নেই বলে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খান মেনন : শেয়ারবাজারের সমস্যা সমাধানের পথ জানা নেই বলে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, এটা ঠিক হয়নি। সরকার পথ না পেলে তাকে পথ বের করতে হবে। কারণ তিনি অর্থমন্ত্রী।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
রাশেদ খান মেনন : এটা বৃহৎ প্রকল্প। শুরু থেকেই সজাগ থাকা প্রয়োজন ছিল। সেখানে দুর্নীতির যে অভিযোগ এসেছে, প্রথম থেকেই তাতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। আরেকটা কথা, বিশ্বব্যাংক যাতে এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করে সে জন্য লবিং করা হয়েছে_এমন কথাও শোনা যায়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্যদিকে আমাদের নিজেদের টাকায়ও এই প্রকল্প সম্পন্ন করা যায়। বিশ্বব্যাংক যদি টাকা না-ও দেয়, তাহলেও এটা বন্ধ হওয়া উচিত নয়। আমি তো মনে করি, জনগণের কাছে আহ্বান জানালে জনগণ এগিয়ে আসবে। আমাদের সামনে এমন প্রমাণ রয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সেতু করার সময় সারচার্জ ধার্য করা হয়েছিল। মানুষ এগিয়ে এসেছিল। সাধারণ মানুষ কয়েক হাজার কোটি টাকা জোগান দিয়েছিল তখন। জনগণ এগিয়ে আসবে এ ক্ষেত্রেও।
কালের কণ্ঠ : সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি।
রাশেদ খান মেনন : এ ধরনের কথা বলার প্রয়োজন নেই। বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে ইভিএম চালু করতে চায়। আপনি কী মনে করেন?
রাশেদ খান মেনন : আমি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তবে এর জন্য জনমত তৈরির প্রয়োজন আছে। এটা প্রচলিত প্রথার বাইরে। মানুষ অভ্যস্ত নয়। তাদের জানাতে হবে বিষয়টার উপকারিতা সম্পর্কে। অন্যদিকে পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের সুযোগও তো রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এর ব্যবহার শুরু হতে পারে। মানুষ যখন এর ব্যবহার দেখবে, নিজেরা ব্যবহার করবে, তখন আস্তে আস্তে এর ওপর আস্থা আসবে। সে সময় ব্যবহার করতে আর অসুবিধা হবে না।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু বিএনপি তো ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে...
রাশেদ খান মেনন : বিএনপি যেভাবে বলছে, তা ঠিক নয়। ভারতেই নির্বাচন হয় ইভিএম ব্যবহার করে। কে বলে আশপাশে নেই। তবে কিছু সমস্যাও আছে। দুটো পদ্ধতিই চালু থাকুক না। এঙ্পেরিমেন্টাল হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?
রাশেদ খান মেনন : আমি এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছি। জাতীয় সংসদেও আমার বক্তব্যে তা আমি তুলে ধরেছি। যে চুক্তি হয়েছে এটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে। মালিকানাই তুলে দেওয়া হয়েছে বিদেশিদের হাতে। এটা ঠিক হয়নি।
কালের কণ্ঠ : সরকার তো এই অভিযোগ অস্বীকার করছে। গ্যাস রপ্তানি করার হিসাবকেও সঠিক নয় বলা হচ্ছে; এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?
রাশেদ খান মেনন : মডেল পিএসসির কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে, তাহলেই বোঝা যাবে কতটা ক্ষতি আমাদের হয়েছে। আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৫.৬ দেখুন; সেখানে বলা আছে 'পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা করতে পারবে, সে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে। তবে এটা কোনোমতেই মোট মার্কেটেবল গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি হবে না।' এখানে বলে নেওয়া ভালো, পেট্রোবাংলা ১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত নিকট সমুদ্রে অবস্থিত কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে উৎপাদনে এনে সেই গ্যাস দেশে ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রে অবস্থিত দূরবর্তী প্লট থেকে স্থলভাগে গ্যাস পরিবহনের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা পেট্রোবাংলার পক্ষে অসম্ভব হবে বলেই প্রতীয়মান হয়। এই অজুহাতে পেট্রোবাংলা তখন শতভাগ বাজারজাতযোগ্য গ্যাস রপ্তানির অনুমতি দিতে বাধ্য হবে।
কালের কণ্ঠ : সরকার গ্যাস রপ্তানি বিষয়ে একসময় শক্ত অবস্থানে ছিল; কিন্তু এখন যেন বদলে গেছে অনেক কিছু। আপনার মন্তব্য কী?
রাশেদ খান মেনন : হ্যাঁ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিল ক্লিনটনের মুখের ওপর ৫০ বছরের গ্যাস রিজার্ভ না রেখে গ্যাস রপ্তানি করা যাবে না বলে যে সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন, তার বিপরীতে আমরা দেখেছি সম্প্রতি কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনে যে পিএসসি সম্পাদিত হয়েছে তাতে ৮০ ভাগ গ্যাস রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধার বিষয়ে, বিশেষ করে আশুগঞ্জ নৌবন্দর যেভাবে তারা ব্যবহার করছে এবং তার বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু পাচ্ছে না বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
রাশেদ খান মেনন : সরকারের উচিত বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য মানুষকে জানানো। আমাদের আর্থিক সুবিধা কী হবে, তা তলিয়ে দেখতে হবে। আর এই সুবিধা তো চলতেই থাকবে।
কালের কণ্ঠ : জোর দাবি উঠেছে কোচিং ব্যবসা বন্ধ করার ব্যাপারে। আপনার ভাবনা কী?
রাশেদ খান মেনন : কোচিং ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আইন হওয়া উচিত। তবে আইন করে কোচিং বন্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দিকেও নজর দিতে হবে। যে পদ্ধতিতে এখন শিক্ষাদান করা হয় সেটিকেও সঠিক বলা যায় না। সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। কিন্ডারগার্টেনগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আলোচনা চলছে। এটা হয়েছে আসলে ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাইভেটাইজেশনের ফলে।
কালের কণ্ঠ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যমুখী হয়ে পড়েছে। লেখাপড়ার মান এবং পরিবেশ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
রাশেদ খান মেনন : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ আর থাকবে বলে মনে হয় না। পাঁচ বছরের মধ্যে নিজস্ব জায়গায় যেতে হবে। না করলে বন্ধ হয়ে যাবে। ৪০-৪৫টা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গা নেই। হয় তারা নিজস্ব ক্যাম্পাসের ব্যবস্থা করবে নতুবা বন্ধ হয়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের এখানে বিদেশি ইউনিভার্সিটির শাখা খোলা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
রাশেদ খান মেনন : বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া যায় না। তবে কোর্স এঙ্চেঞ্জ হতে পারে। শাখা নয় কোনোভাবেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খান মেনন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.