প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরঃ জনগণকে জানিয়েই চুক্তি করা উচিত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিসেম্বরে নির্ধারিত দিল্লি সফর ভারতের অনুরোধে আপাতত স্থগিত হলেও আগামী বছর জানুয়ারির প্রথমার্ধে এ সফর হতে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে শনিবার রাজধানীতে দি সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস আয়োজিত ‘প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর : প্রত্যাশা ও উদ্বেগ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা প্রায় অভিন্ন সুরে যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তাতে গরিষ্ঠসংখ্যক দেশবাসীর মনের কথার প্রতিফলন ঘটেছে।
তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভারতের সঙ্গে যেসব বিষয়ে চুক্তি হবে, তা দেশের জনগণকে জানাতে হবে। চুক্তির আগে বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত। সংসদে আলোচনা না করে এবং জনগণকে অন্ধকারে রেখে ভারতের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি করা সঙ্গত হবে না। বক্তারা এ কথাও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা আত্মঘাতী হবে। ওই গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অভিন্ন মতের অনুসারী অথবা একই পথের পথিক নন। তারপরও যে তারা একসঙ্গে বসেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য ব্যক্ত করেছেন—এটা আমাদের সবার জন্য আশার কথা। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ বলেছেন, ভারতের মনে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ, ১৯৭১, ১৯৭৫ ছাড়া আর কিছু নেই। এই যাদের মাইন্ডসেট, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া কঠিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কোথায় যাচ্ছে, তা কেউ বলতে পারে না। হঠাত্ কোনো কিছু করে ফেলা ঠিক নয়। জনবিভক্তি আনা উচিত নয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে আমরা বিদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তির বিষয় সম্পূর্ণরূপে নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত করে ফেলেছি। সংসদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আত্মসমালোচনার সুর ছিল আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কণ্ঠেও। তথাকথিত আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পর্কে আলোকপাত করার পাশাপাশি তিনি বলেছেন, আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো অভ্যন্তরীণ অনৈক্য। বৈদেশিক বিষয়ে আমাদের বড় দলগুলো এক ভাষায় কথা বলে না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে এ সরকার অথচ জনগণকে কিছুই জানানো হচ্ছে না। ভারতের সঙ্গে কী কী বিষয়ে চুক্তি হচ্ছে, সে ব্যাপারে দেশের জনগণ অন্ধকারে। অন্যান্য প্রাজ্ঞ অংশগ্রহণকারীর বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে গভীর উদ্বেগ।
গোলটেবিল আলোচনায় বিভিন্ন মত ও পথের সব অংশগ্রহণকারী যেভাবে যুক্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তাতে এই আলোচনাকে ‘ভারতবিরোধী রেটোরিক’ বলে ফুত্কারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। ভারত আমাদের বৃহত্ প্রতিবেশী। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সাহায্য করেছিল। কিন্তু নানান কারণে দু’দেশের সম্পর্ক যে এখন বেশ জটিল এবং কারণগুলো যে দিল্লির নীতিনির্ধারকরা সৃষ্টি করেছেন—একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ হবে। এ ব্যাপারে ভারতীয় মিডিয়ার অবদানও কম নয়। যেমন ভারত সম্প্রতি একতরফাভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর স্থগিত করে দেয়ায় ভারতীয় মিডিয়া যেন বেশ মজা পেয়ে গেছে। সেখানকার মিডিয়া প্রায় সমস্বরে ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন সফর এবং চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার ঘোষণায় দিল্লি নাকি বেজায় চটেছে। তাই স্থগিত করে দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনার দিল্লি সফর। ভারতীয় মিডিয়ার ভাবখানা এমন, যেন দিল্লি ঢাকাকে উপযুক্ত কূটনৈতিক সংকেত দিল। বাংলাদেশ সরকারকে এভাবে বিব্রত করা ঠিক হয়নি—এমন কথা ভারতের কোনো পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে স্থান পায়নি। এর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দিল্লি ঢাকার কাছ থেকে কীরকম স্থূল আনুগত্য চায়। একপক্ষের এহেন মানসিকতার কাছে অন্যপক্ষ যদি আত্মসমর্পণ করে, তবে সেক্ষেত্রে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। তার পরিবর্তে বন্ধুত্ব আশা করা দূরাশা। আমরা ভারতের সঙ্গে সমতাভিত্তিক সুস্থ বন্ধুত্ব চাই বলেই দিল্লির নীতিনির্ধারকদের সামন্তবাদী মনোভাবের গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করি। সে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলি।
No comments