সত্যিই অভূতপূর্ব by হায়দার আকবর খান রনো
বাংলাদেশে মাঝে মধ্যেই এমন সব ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে সত্যিই অভিনবত্ব আছে। সব ঘটনা যে আনন্দের তা নয়, বরং এ ধরনের বেশির ভাগ ঘটনা দুঃসংবাদ ও উদ্বেগের বিষয় হিসেবেই উপস্থিত হয়। একদিকে ক্যু, রাজনৈতিক হত্যা এবং অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থান, পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস ক্যু, হত্যা, অভ্যুত্থান, এমনকি সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মতো ঘটনায় ভরপুর। বাংলাদেশ এমন দেশ যেখানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রয়েছে, যা আর কোনো দেশে নেই। সংসদ থেকে দলবদ্ধভাবে পদত্যাগের মতো ঘটনার দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও আছে কিনা জানি না। পুলিশ ও বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনা অবশ্য পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে ঘটেছে। হয়তো লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার কোনো দেশে এর উদাহরণ পাওয়া যাবে। তবে ১৯৯৬ সালে যে সচিব বিদ্রোহ ঘটেছিল, তার নজিরও আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা দু’দিনের জন্য স্ট্রাইক করেছিলেন। এমন ঘটনাও সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। অবশ্য ধর্মঘট বা স্ট্রাইক শব্দটি তারা উল্লেখ করেননি। কিন্তু প্রধান বিচারপতির অফিস কক্ষে কতিপয় আইনজীবী কর্তৃক তছনছ করার প্রতিবাদে বিচারকরা দু’দিন কোর্টে আসেননি। একে একটু ভিন্ন ভাষায় বলা যায় কর্মবিরতি। যাই হোক, এসব ঘটনা শুধু ব্যতিক্রমীই নয়, বিশ্ব ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। এমন-সব অভিনবত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশেই ঘটে।
উপরের বর্ণিত ঘটনাগুলো বড় রকমের রাজনৈতিক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। আমি এখন যে ঘটনাটি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চলেছি, তা তেমন বড় মাপের রাজনৈতিক ঘটনা নয়। কিন্তু ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব আছে। বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়ও বটে।
গত ৬ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় করে খবরটি ছাপা হয়েছে। সেদিনের সব কাগজ আমার দেখা হয়নি। অন্যান্য কাগজে খবরটি কীভাবে পরিবেশিত হয়েছে ঠিক জানা নেই। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ওই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘মত্স্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডিজির নালিশ।’ অবাক করে দেয়ার মতোই খবর। প্রথমে আমি ভালোভাবে বুঝতেই পারিনি, আসলে খবরটি কী। খবরটি আমাকে কয়েকবার পড়তে হয়েছে। প্রথমে ভেবেছি, আমার বোঝার ভুল হচ্ছে অথবা খবরের কাগজে ভুলক্রমে কিছু ছাপা হয়েছে নাকি। কারণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারই অধীন কোনো উচ্চপদস্থ অফিসারের সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ, এরকম ঘটনা এর আগে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এ ঘটনা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার আগে দুর্নীতি বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। দুর্নীতি আমাদের দেশে বহুল আলোচিত বিষয়। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লোকমুখে দুর্নীতির খবর প্রায় সব আমলেই শোনা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপারে কখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। সরকার বদল হলে আগের সরকারের মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলা হয়। এটাও আমরা গতানুগতিকভাবে দেখে আসছি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সকারের আমলে দেশের দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল, যে কারণে তারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, দীর্ঘ সময় জামিন পাননি এবং দু’জনই দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করেন। অবশ্য এ কথা এখন সবার জানা যে, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের আধা-সামারিক ‘অদ্ভুত ধরনের’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব মামলা করেছিল। বহুল আলোচিত মাইনাস টু থিওরি কার্যকরী করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সেই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বহু নেতার বিরুদ্ধেও অনেক দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির আগেই দুর্নীতির বিরাট বিরাট ফিরিস্তি মিডিয়াতে এসেছিল। বর্তমান সরকার নতুন করে তদন্ত করে দেখছে, এর মধ্যে কোনো কোনো মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কোনো কোনো মামলার আসলেই কিছু প্রাথমিক ভিত্তি আছে। এক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে তার সবক’টিই প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রেখে দেয়া হয়েছে। এখানেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
যাই হোক, বিগত সরকারগুলোর আমলে কর্তাব্যক্তিদের কেউ দুর্নীতি করেননি, এমন কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকারের অসত্ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার কারণে এখন যা দাঁড়াল, তা হলো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা সবাই পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে আসছেন।
যাই হোক, এবার আসা যাক মত্স্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে। এ অভিযোগ সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা আনেনি; এই অভিযোগ কোর্টেও ওঠেনি। তারই মন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তা বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম খান অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ বা নালিশ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে। এখানে বলা প্রয়োজন, এমন অভিযোগের সত্যতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সঠিক হবে না। কারণ এটি এক ব্যক্তি কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগ মাত্র।
তবে অভিযোগের ধরনটি নতুন এবং চাঞ্চল্যকর। তা ছাড়া মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে দুর্নীতির বিষয় ছাড়া আরও মারাত্মক অভিযোগও রয়েছে। ওই মন্ত্রী নাকি অভিযোগকারীকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। অভিযোগকারী পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন। তার মধ্যে বড় রকমের অভিযোগ দু’টি। মন্ত্রী নাকি অভিযোগকারীর কাছ থেকে তার পদোন্নতির জন্য দুই লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন এবং এজন্য চাপ অব্যাহত রয়েছে। কার মাধ্যমে এই টাকা চাওয়া হয়েছে তাও চিঠিতে উল্লিখিত আছে। তাদের নাম ও পরিচয়ও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আরেকটি বড় অভিযোগ হলো এই যে, মন্ত্রী অবৈধভাবে বিশেষ ঠিকাদারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিশেষ ঠিকাদার একটি চারতলা বিল্ডিং নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি বলে প্রকল্প পরিচালক ঠিকাদারকে দেয়া কার্যাদেশ বাতিল করেছেন। কাজ নেয়ার আগে প্রথমত ঠিকাদার ২৪ লাখ টাকা সরকারের কাছে সোনালী ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছিলেন। অভিযোগে বলা হয়, মন্ত্রী ওই ঠিকাদারকে তার জামানতের ২৪ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন এবং অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। এ ছাড়াও আরও অভিযোগ আছে। যেমন ইনস্টিটিউটের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করার কথা মন্ত্রীর অনীহার কারণে নাকি তার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো যায়নি। মন্ত্রীর অনীহার কারণে নাকি ইনস্টিটিউটের ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। সর্বশেষ অভিযোগটি কিছু রাজনৈতিক চরিত্রের। চারদলীয় জোট সরকারের সমর্থক ৪/৫ কর্মকর্তাকে দিয়ে মন্ত্রী ইনস্টিটিউটের কার্যালয় একটি অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। অভিযোগকারীর অন্যান্য অভিযোগ যাতে বিবেচনায় নেয়া হয়, সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই অভিযোগকারী এই রাজনৈতিক বিষয়টি জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাত্ মন্ত্রীর সঙ্গে চারদলীয় জোটের সমর্থকদের যোগাযোগ আছে, এমনটা প্রমাণ করতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর নজর কাড়া যাবে, ফলে মন্ত্রীকে ঘায়েল করা সহজ হবে বলে অভিযোগকারী মনে করেছেন। তবে ঠিক এ কারণে আবার আমাদের কাছে অন্যান্য অভিযোগের গুরুত্ব কিছুটা হালকা হয়ে যায়।
উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে লিখিত নালিশপত্রে অভিযোগকারী মহাপরিচালক নিজের রাজনৈতিক পরিচয় তলে ধরেছেন এবং তিনি যে ভালো আওয়ামী লীগার তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলেই গণ্য হওয়া উচিত। নালিশপত্রে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছেন। এ পর্যন্ত না হয় চলে; কিন্তু তিনি আরও বেশি কিছু বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মী। অফিসিয়াল চিঠিতে এই প্রসঙ্গ কি প্রয়োজনীয়? সরকারি চাকরিসংক্রান্ত বিষয়ে অথবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে এসব কথা কেবল অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তরই নয়, আপত্তিকরও বটে। কারণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাজার হাজার ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মীর সন্তান হিসেবে বিশেষ ধঃঃবহঃরড়হ (এটেনশন) আশা করা আপত্তিকর। আর পুরনো রাজনৈতিক বা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে যদি সরকারি কাজে বিশেষ কিছু দাবি করা হয় তা হলে আর যাই হোক, প্রশাসন চলবে না। আর এমন কিছুকে যদি প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে হবে প্রশাসনের আওয়ামীকরণ। তৈরি হবে নতুন ধরনের প্রশাসনিক কালচার, যাকে আওয়ামী কালচার বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আমি আশা করব, অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন ভুলটি করবেন না।
দ্বিতীয়ত, এই চিঠিতে তিনি আরও দাবি করেছেন, বিগত জোট সরকারের আমলে তাকে নাকি নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অথবা উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সহানুভূতি অর্জনের জন্য এটা ভালো কৌশলও বটে। যেখানে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগটিই হচ্ছে তার নালিশপত্রের বিষয়, সেখানে অন্য প্রসঙ্গ তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক আনাটা বাঞ্ছনীয় নয়। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার যে অভিযোগকারী আওয়ামী ঘরানার লোক। না হলে সম্ভবত চাকরিরত অবস্থায় নিজের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনার সাহস পেতেন কিনা বলা যায় না।
উপরন্তু তিনি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন একজন উপদেষ্টার কাছে। কেন? পদমর্যাদার দিক দিয়ে উপদেষ্টা মন্ত্রীর উপরে নন। তিনি কি নালিশ গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি? সরকারি কর্মকর্তা যদি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতর অভিযোগ আনতে চান, তাহলে সংবিধান, দেশের আইন ও প্রশাসনিক যে নিয়মশৃঙ্খলা আছে, সেটা মেনেই তা করতে হবে। অন্যথায় যা হবে তা হলো নৈরাজ্য ও অরাজকতা। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে এরই মধ্যে নৈরাজ্য ও দলীয়করণ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে এ ঘটনা তারই একটা প্রমাণ। বড়ই অশুভ লক্ষণ।
তবে অভিযোগের পদ্ধতি যাই হোক না কেন, অভিযোগের মাত্রা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে এখনই তদন্ত করা। কারণ অভিযোগটি কোনো সাধারণ অভিযোগ নয়। অধস্তন কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করা অথবা প্রাণনাশের হুমকি দেয়া সত্যিই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অভিযোগ। তাও আবার এ অভিযোগ উত্থাপন করছেন একজন সিনিয়র অফিসার। অভিযোগ করছেন তারই বিভাগের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগটি করা হচ্ছে সরকারের আরেক মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন উপদেষ্টার কাছে অফিসিয়াল চিঠি মারফত। এহেন ঘটনা উপেক্ষা করা বা তুচ্ছজ্ঞান করে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ ঘটনা সরকারের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতির যে চিত্র তুলে ধরে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি সম্ভব?
এরূপ ঘটনা অস্বাভাবিক, নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব। তবে এটি নিঃসন্দেহে খুবই অশুভ ইঙ্গিত।
উপরের বর্ণিত ঘটনাগুলো বড় রকমের রাজনৈতিক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। আমি এখন যে ঘটনাটি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চলেছি, তা তেমন বড় মাপের রাজনৈতিক ঘটনা নয়। কিন্তু ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব আছে। বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয়ও বটে।
গত ৬ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ বড় করে খবরটি ছাপা হয়েছে। সেদিনের সব কাগজ আমার দেখা হয়নি। অন্যান্য কাগজে খবরটি কীভাবে পরিবেশিত হয়েছে ঠিক জানা নেই। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ওই সংবাদের ওপর ভিত্তি করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘মত্স্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডিজির নালিশ।’ অবাক করে দেয়ার মতোই খবর। প্রথমে আমি ভালোভাবে বুঝতেই পারিনি, আসলে খবরটি কী। খবরটি আমাকে কয়েকবার পড়তে হয়েছে। প্রথমে ভেবেছি, আমার বোঝার ভুল হচ্ছে অথবা খবরের কাগজে ভুলক্রমে কিছু ছাপা হয়েছে নাকি। কারণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারই অধীন কোনো উচ্চপদস্থ অফিসারের সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ, এরকম ঘটনা এর আগে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এ ঘটনা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার আগে দুর্নীতি বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। দুর্নীতি আমাদের দেশে বহুল আলোচিত বিষয়। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লোকমুখে দুর্নীতির খবর প্রায় সব আমলেই শোনা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপারে কখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। সরকার বদল হলে আগের সরকারের মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলা হয়। এটাও আমরা গতানুগতিকভাবে দেখে আসছি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সকারের আমলে দেশের দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল, যে কারণে তারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, দীর্ঘ সময় জামিন পাননি এবং দু’জনই দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করেন। অবশ্য এ কথা এখন সবার জানা যে, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের আধা-সামারিক ‘অদ্ভুত ধরনের’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসব মামলা করেছিল। বহুল আলোচিত মাইনাস টু থিওরি কার্যকরী করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সেই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বহু নেতার বিরুদ্ধেও অনেক দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির আগেই দুর্নীতির বিরাট বিরাট ফিরিস্তি মিডিয়াতে এসেছিল। বর্তমান সরকার নতুন করে তদন্ত করে দেখছে, এর মধ্যে কোনো কোনো মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কোনো কোনো মামলার আসলেই কিছু প্রাথমিক ভিত্তি আছে। এক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে তার সবক’টিই প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রেখে দেয়া হয়েছে। এখানেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
যাই হোক, বিগত সরকারগুলোর আমলে কর্তাব্যক্তিদের কেউ দুর্নীতি করেননি, এমন কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকারের অসত্ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার কারণে এখন যা দাঁড়াল, তা হলো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা সবাই পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে আসছেন।
যাই হোক, এবার আসা যাক মত্স্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে। এ অভিযোগ সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা আনেনি; এই অভিযোগ কোর্টেও ওঠেনি। তারই মন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তা বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম খান অভিযোগ এনেছেন। তিনি অভিযোগ বা নালিশ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে। এখানে বলা প্রয়োজন, এমন অভিযোগের সত্যতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সঠিক হবে না। কারণ এটি এক ব্যক্তি কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগ মাত্র।
তবে অভিযোগের ধরনটি নতুন এবং চাঞ্চল্যকর। তা ছাড়া মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে দুর্নীতির বিষয় ছাড়া আরও মারাত্মক অভিযোগও রয়েছে। ওই মন্ত্রী নাকি অভিযোগকারীকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। অভিযোগকারী পাঁচটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন। তার মধ্যে বড় রকমের অভিযোগ দু’টি। মন্ত্রী নাকি অভিযোগকারীর কাছ থেকে তার পদোন্নতির জন্য দুই লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন এবং এজন্য চাপ অব্যাহত রয়েছে। কার মাধ্যমে এই টাকা চাওয়া হয়েছে তাও চিঠিতে উল্লিখিত আছে। তাদের নাম ও পরিচয়ও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আরেকটি বড় অভিযোগ হলো এই যে, মন্ত্রী অবৈধভাবে বিশেষ ঠিকাদারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিশেষ ঠিকাদার একটি চারতলা বিল্ডিং নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি বলে প্রকল্প পরিচালক ঠিকাদারকে দেয়া কার্যাদেশ বাতিল করেছেন। কাজ নেয়ার আগে প্রথমত ঠিকাদার ২৪ লাখ টাকা সরকারের কাছে সোনালী ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছিলেন। অভিযোগে বলা হয়, মন্ত্রী ওই ঠিকাদারকে তার জামানতের ২৪ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন এবং অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। এ ছাড়াও আরও অভিযোগ আছে। যেমন ইনস্টিটিউটের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করার কথা মন্ত্রীর অনীহার কারণে নাকি তার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো যায়নি। মন্ত্রীর অনীহার কারণে নাকি ইনস্টিটিউটের ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। সর্বশেষ অভিযোগটি কিছু রাজনৈতিক চরিত্রের। চারদলীয় জোট সরকারের সমর্থক ৪/৫ কর্মকর্তাকে দিয়ে মন্ত্রী ইনস্টিটিউটের কার্যালয় একটি অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। অভিযোগকারীর অন্যান্য অভিযোগ যাতে বিবেচনায় নেয়া হয়, সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই অভিযোগকারী এই রাজনৈতিক বিষয়টি জুড়ে দিয়েছেন। অর্থাত্ মন্ত্রীর সঙ্গে চারদলীয় জোটের সমর্থকদের যোগাযোগ আছে, এমনটা প্রমাণ করতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর নজর কাড়া যাবে, ফলে মন্ত্রীকে ঘায়েল করা সহজ হবে বলে অভিযোগকারী মনে করেছেন। তবে ঠিক এ কারণে আবার আমাদের কাছে অন্যান্য অভিযোগের গুরুত্ব কিছুটা হালকা হয়ে যায়।
উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে লিখিত নালিশপত্রে অভিযোগকারী মহাপরিচালক নিজের রাজনৈতিক পরিচয় তলে ধরেছেন এবং তিনি যে ভালো আওয়ামী লীগার তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক বলেই গণ্য হওয়া উচিত। নালিশপত্রে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছেন। এ পর্যন্ত না হয় চলে; কিন্তু তিনি আরও বেশি কিছু বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মী। অফিসিয়াল চিঠিতে এই প্রসঙ্গ কি প্রয়োজনীয়? সরকারি চাকরিসংক্রান্ত বিষয়ে অথবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে এসব কথা কেবল অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তরই নয়, আপত্তিকরও বটে। কারণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাজার হাজার ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কর্মীর সন্তান হিসেবে বিশেষ ধঃঃবহঃরড়হ (এটেনশন) আশা করা আপত্তিকর। আর পুরনো রাজনৈতিক বা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে যদি সরকারি কাজে বিশেষ কিছু দাবি করা হয় তা হলে আর যাই হোক, প্রশাসন চলবে না। আর এমন কিছুকে যদি প্রশ্রয় দেয়া হয় তাহলে হবে প্রশাসনের আওয়ামীকরণ। তৈরি হবে নতুন ধরনের প্রশাসনিক কালচার, যাকে আওয়ামী কালচার বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আমি আশা করব, অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন ভুলটি করবেন না।
দ্বিতীয়ত, এই চিঠিতে তিনি আরও দাবি করেছেন, বিগত জোট সরকারের আমলে তাকে নাকি নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অথবা উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সহানুভূতি অর্জনের জন্য এটা ভালো কৌশলও বটে। যেখানে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগটিই হচ্ছে তার নালিশপত্রের বিষয়, সেখানে অন্য প্রসঙ্গ তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক আনাটা বাঞ্ছনীয় নয়। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার যে অভিযোগকারী আওয়ামী ঘরানার লোক। না হলে সম্ভবত চাকরিরত অবস্থায় নিজের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনার সাহস পেতেন কিনা বলা যায় না।
উপরন্তু তিনি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন একজন উপদেষ্টার কাছে। কেন? পদমর্যাদার দিক দিয়ে উপদেষ্টা মন্ত্রীর উপরে নন। তিনি কি নালিশ গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি? সরকারি কর্মকর্তা যদি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতর অভিযোগ আনতে চান, তাহলে সংবিধান, দেশের আইন ও প্রশাসনিক যে নিয়মশৃঙ্খলা আছে, সেটা মেনেই তা করতে হবে। অন্যথায় যা হবে তা হলো নৈরাজ্য ও অরাজকতা। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে এরই মধ্যে নৈরাজ্য ও দলীয়করণ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে এ ঘটনা তারই একটা প্রমাণ। বড়ই অশুভ লক্ষণ।
তবে অভিযোগের পদ্ধতি যাই হোক না কেন, অভিযোগের মাত্রা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে এখনই তদন্ত করা। কারণ অভিযোগটি কোনো সাধারণ অভিযোগ নয়। অধস্তন কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করা অথবা প্রাণনাশের হুমকি দেয়া সত্যিই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অভিযোগ। তাও আবার এ অভিযোগ উত্থাপন করছেন একজন সিনিয়র অফিসার। অভিযোগ করছেন তারই বিভাগের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগটি করা হচ্ছে সরকারের আরেক মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন উপদেষ্টার কাছে অফিসিয়াল চিঠি মারফত। এহেন ঘটনা উপেক্ষা করা বা তুচ্ছজ্ঞান করে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ ঘটনা সরকারের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতির যে চিত্র তুলে ধরে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি সম্ভব?
এরূপ ঘটনা অস্বাভাবিক, নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব। তবে এটি নিঃসন্দেহে খুবই অশুভ ইঙ্গিত।
No comments