বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. ফাহমিদা খাতুন-স্বাধীনতার চার দশক : অর্থনীতিতে অর্জন অনেক, অপূর্ণতাও কম নয়
ড. ফাহমিদা খাতুন বর্তমানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা বিভাগের প্রধান। ১৯৮৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে ডিস্টিংশনসহ স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯৬ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন।
শিক্ষকতা করেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দেওয়া বক্তৃতার ভিত্তিতে কালের কণ্ঠের জন্য সাক্ষাৎকারটি তৈরি করেছেন ফরহাদ মাহমুদ
কালের কণ্ঠ : স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি হয়েছে। এই সময়ে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. ফাহমিদা : স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ শুধু দরিদ্রই ছিল না, দারিদ্র্য দূর করার যে উপায়গুলো একটি দেশের থাকা প্রয়োজন, সেগুলোও বাংলাদেশের ছিল না। এই জনপদের দীর্ঘ পরাধীনতা এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল। আমরা জানি যে ১৯৪৭ সালে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম_এই দুই পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশের মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য দূর করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনের মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর চার দশকে আমাদের অর্জন অনেক। তবে সে অর্জন এখনো প্রত্যাশার সমান হতে পারেনি। সাধারণ মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষাই এখনো অপূর্ণ রয়েছে। সাধারণ মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা বাড়াতে হবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরো অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্যোগকে কাজে লাগাতে হবে এবং তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটাই ভালো। কিন্তু সেটি আমাদের সামাজিক উন্নয়নকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিচ্ছে কি?
ড. ফাহমিদা : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটি সব সময় সামাজিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করে না। যেমন : দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য শুধু প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে দেশের মাথাপিছু উৎপাদন বা জিডিপি ৬ শতাংশের বেশি হচ্ছে। ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে তা আবার বেড়েছে। কাজেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আমরা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক মনে করতে পারি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে এবং অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি মধ্যমআয়ের দেশে পরিণত হতে পারব। তবে এই প্রবৃদ্ধি তখনই আরো বেশি অর্থপূর্ণ হবে, যখন এই প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের সব মানুষ সমানভাবে পাবে। তা না করে এটি যদি সমাজে কেবল বৈষম্য বাড়াতে থাকে অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কিছু লোক যদি বিত্তবান হতে থাকে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে তাহলে সেটি স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে না। তাই আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে নিশ্চিত করতে হবে। এসব কারণেই বলা হয়ে থাকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক নয়; বরং প্রবৃদ্ধির সুফল সবার মাঝে পেঁৗছানোর জন্য অংশীদারিত্বমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এই অর্জনকে ধরে রাখতে ও প্রত্যাশিত রূপ দিতে আমরা কি সক্ষম হব?
ড. ফাহমিদা : বাংলাদেশকে একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি, উন্নয়নের টেস্ট কেইস (ঞবংঃ ঈধংব) ইত্যাদি বলা হতো। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মতো এত পিছিয়ে পড়া এবং এত সমস্যাকবলিত দেশের উন্নয়ন হলে পৃথিবীর সব দেশেই উন্নয়ন সম্ভব। যাঁরা এই ধারণা পোষণ করতেন তাঁরা এখন এই ধারণা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে চমৎকৃত হয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ। ২০০০ সালের পর থেকে এই হার বাড়তে বাড়তে ২০১০-১১ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশে। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেরই প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে কম। একদিকে জিডিপির হার বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমে আসার কারণে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রয়োজন এই অর্জনকে সুসংহত করা। এ জন্য যে বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনা করতে হবে, সেগুলো হলো : (১) যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, তা টেকসই কি না; (২) দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমাতে পেরেছি কি না; (৩) শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে কি না; (৪) উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থান-ঘন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে কি না; (৫) সব নাগরিকের নূ্যনতম সামাজিক সুরক্ষা রয়েছে কি না_এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ধাবিত হলেই কেবল আমরা বলতে পারব যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন স্বাধীনতার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে এগোচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : আগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি আরো ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
ড. ফাহমিদা : বাংলাদেশের অর্থনীতির আরো প্রবৃদ্ধি অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির ধারাটিকে রক্ষা ও টেকসই করতে হবে। আর সে জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ যত হবে, দেশের মোট উৎপাদন তত বাড়বে, দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, বিনিয়োগের পথে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও আমরা কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার কোনো কোনো দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি। যেমন, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিনিয়োগ হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ। ভারতে এই হার ৩৫, নেপালে ৩০ এবং শ্রীলঙ্কায় ২৫ শতাংশ। আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্য এই হার কমপক্ষে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালনে আরো গতি বাড়ানোর দিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। এই লক্ষ্যে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় এবং অনুৎপাদনশীল ব্যয় কমাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে কি?
ড. ফাহমিদা : বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন_কৃষির ওপর কর্মসংস্থানের যে অতিরিক্ত চাপ ছিল, তা কিছুটা কমেছে। সামান্য হলেও শিল্পে ক্রমেই কর্মসংস্থান বাড়ছে। পাশাপাশি সেবা খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অন্যান্য খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। প্রথমত, যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে তা, টেকসই কি না। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনশীলতা বাড়ছে কি না। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এখনো নিম্ন উৎপাদনশীলতা বিরাজমান সেটি কৃষি খাত, শিল্পখাত_সব খাতেই সত্য। শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতেও অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু সেখানেও উৎপাদনশীলতা অনেক নিম্নপর্যায়ের। পাশাপাশি এই খাতে নিম্ন আয় এবং কাজের অনিশ্চয়তা রয়েছে। সরকার ও জাতিসংঘ ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে চায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা করতে হলে এই বিষয়গুলো মনে রেখেই অগ্রসর হতে হবে।
কালের কণ্ঠ : কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে?
ড. ফাহমিদা : প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মতো নানা সংকটময় সময়ে দরিদ্র বা ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার বিশেষ প্রয়োজন হয়। দরিদ্ররা ওই সময়গুলোতে আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৪টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু একটি সামগ্রিক এবং সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকৌশল নেই। বেশির ভাগই খণ্ডিতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ আলাদা আলাদাভাবে বাস্তবায়ন করছে। ফলে এতে উপকার সর্বোচ্চ পরিমাণে পাওয়া যায় না। আবার এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত আইনি ভিত্তিও তৈরি করা হয়নি। কর্মসংস্থানের বা বেকারদের কাজ দেওয়ার কোনো নিশ্চয়তা এই কর্মসূচিগুলো দেয় না। এমনকি যেগুলো কর্মসৃজনমূলক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সেগুলোতেও এই নিশ্চয়তা নেই। আবার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য বরাদ্দ সম্পদ পর্যাপ্ত নয়। ২০১১ অর্থবছরে এটি ছিল জিডিপির ২.৫ শতাংশ, এশীয় দেশগুলোতে এর পরিমাণ গড়ে জিডিপির ৪ শতাংশ। স্বাধীনতার ৪০ বছরে আমাদের প্রচেষ্টার কারণে দারিদ্র্য কমেছে ঠিকই; কিন্তু যারা দরিদ্র নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারা বিভিন্ন সংকটের সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। ফলে অর্থনৈতিক মন্দা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ কম থাকে। তাই তাদের কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির জন্যও কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। তাদের জন্যও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রয়োজন রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. ফাহমিদা : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments