তমোহরকে মনে পড়ে by কণিকা মাহফুজ

বীন্দ্রনাথ বড়মাপের মানুষ। স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যু তার প্রতিভায় ছেদ টানতে পারেনি। তিনি উপলব্ধি করেছেন_ 'সত্য যে কঠিন', বলেছেন কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। কিন্তু আমরা অতি সাধারণ মানুষ। আমাদের কাছে আমাদের সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। বাবা-মা আর আমরা সাত বোন এবং এক ভাই। অনেকে ঠাট্টা করে বলত, 'সাত বোন চম্পা'। আমরা একসঙ্গে হলে অকারণে হাসতাম অথবা অকারণে নয়; প্রাণে আনন্দের কোনো ঘাটতি ছিল না, তাই হাসতে পারতাম।


রানু, কণা, রুবী, মণিকা, পাপিয়া, লুলু ও জলি_ সাত বোন আর স্বপন একমাত্র ভাই । সেজ বোন রুবী অথবা সাজির (কবি রুবী রহমান) ছেলে এবং তার স্বামী নুরুল ইসলাম এ পরিবারের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের ছেলে তমোহর ইসলাম পুচি। দেশের মানুষ নুরুল ইসলামকে যে অভাবিত ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, তার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাব। সে হয়ে গেল ছোড়দা। সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যার কথা কোনোদিন ভোলার নয়। বোনদের মধ্যে আমরা তিনজন তখন যুক্তরাষ্ট্রে। রুবী গিয়েছিল কবিতার ওয়ার্কশপ ওহাইওতে। কাজ শেষ করে মেয়ে মৌটুসীর সঙ্গে ওয়াশিংটনে কয়েকটি দিন কাটাচ্ছিল। পাপিয়ার বড় মেয়ে জারা সিরাকিউস ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করছে। সেই জারা ফোন ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, 'পুচি দাদা নেই'_ দুটি মাত্র শব্দ হাহাকারের মতো ছড়িয়ে পড়ল ঘরজুড়ে। পুচির নিজস্ব জগৎটা ছিল মূলত সঙ্গীতের জগৎ। সে গিটার বাজিয়েছে, গান লিখেছে, গান গেয়েছে, সুর দিয়েছে, কবিতাও লিখেছে। এ জগতে প্রধান সঙ্গী ছিল তার ১০ বছরের বড় মামা আমাদের একমাত্র ভাই মঞ্জুরুর রহমান স্বপন। ছোটবেলা থেকেই ওরা দু'জন বন্ধুর মতো বড় হয়েছে, গান করেছে, বিভিন্ন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়েছে। ব্যান্ড গড়েছে, ভেঙেছে। যে ব্যান্ডই হোক_ ওরা দু'জন একসঙ্গেই যোগ দিয়েছে অথবা তার থেকে বেরিয়ে গেছে। পুচি ছিল লিড গিটারিস্ট। নিজের কথায় সুর দিয়েছে, গান গেয়েছে_ এটা এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য। বাবা, মামা, নানা গান করতেন। আমাদের ভাই-বোনের মধ্যে রানু, পাপিয়া, স্বপন ও জলি গান করে। পাপিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। একবার বিদেশের এক দোকানে পুচি একটা গিটার পছন্দ করেছিল। বিক্রেতা জানাল, এটা বিক্রির জন্য নয়। পুচি জিজ্ঞাসা করল, একটু কি দেখতে পারে। দোকানি আপত্তি করল না; কিন্তু বাজাতে বাজাতে পুচি যখন তন্ময়, তখন ওই দোকানিও তন্ময়। শেষ পর্যন্ত সে গিটারটা পুচির কাছে যথেষ্ট কম দামে বিক্রি করেছে। পরদিন ছিল পুচির জন্মদিন। বিক্রেতা সুন্দর একটা গিটার কেইস জন্মদিন উপলক্ষে পুচিকে উপহার দিয়েছে। ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর সেই নৃশংস ঘটনা আরও করুণ। পুচির বন্ধুরা বলছিল, সোনা মানিককে আমরা কোথায় রাখব? 'লাশ' শব্দটা ওরা উচ্চারণ করেনি বলে আমরা ওদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের পুচি সোনা কখনও লাশ হতে পারে না। আলাস্কার ভাষায় গুডবাই বলে কোনো শব্দ নেই। ওরা কাউকে বিদায় জানায় না। ওরা বলে 'টা-টা', যার অর্থ আবার দেখা হবে। আমরাও আমাদের পুচি সোনা আর আমাদের ভাই নুরুল ইসলামকে জানাই টা-টা অথবা 'আউফ-বিদেসিন'_ আবার দেখা হবে। আর কোনো দিন দেখা হবে না_ এ কথা আমি বিশ্বাস করি না অথবা বিশ্বাস করতে পারি না। মহামিলনের স্বপ্ন নিয়ে রুবী বাঁচবে, প্রতীক্ষা করবে। আজ ২০ অক্টোবর তমোহর ইসলাম পুচির জন্মদিনে তাকে স্মরণ করি।
কণিকা মাহফুজ : অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক ও তমোহরের খালা
 

No comments

Powered by Blogger.